নবজাতকদের মধ্যে আশঙ্কাজনক হারে উচ্চ মাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার ব্যাপক উপস্থিতি (কলোনাইজেশন) শনাক্ত হয়েছে বলে একটি সেমিনার থেকে জানানো হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) আইসিডিডিআর,বি ঢাকার মহাখালী ক্যাম্পাসের সাসাকাওয়া মিলনায়তনে ‘বাংলাদেশে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স মোকাবেলা: আর্চ গবেষণার ফলাফল’ শীর্ষক একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয়।
সেমিনারে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স ইন কমিউনিটিজ অ্যান্ড হসপিটালস (আর্চ) গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়।
বাংলাদেশে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স নিয়ে অনেক গবেষণা হলেও এই গবেষণাটিই প্রথম, যা স্থানীয় এলাকা ও হাসপাতাল উভয় ক্ষেত্রেই মানুষের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি বা কলোনাইজেশন পদ্ধতিগতভাবে তদন্ত করে।
কলোনাইজেশন বলতে শরীরে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি বোঝায় যা তাৎক্ষণিক রোগের কারণ হয় না, এই ব্যাকটেরিয়াগুলো পরবর্তীতে তার নিজের শরীর বা আশেপাশের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে রোগ সৃষ্টি করতে পারে, যা চিকিৎসা করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
২০১৯ সালে শুরু হওয়া গবেষণাটির প্রথম পর্যায়ে সুস্থ ব্যক্তি এবং হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে উচ্চ মাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া যায়।
কমিউনিটি বা লোকালয়ে থাকা ৭৮ শতাংশেরও বেশি সদস্য যারা আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ ছিলো এবং হাসপাতালের ৮২ শতাংশ রোগীর দেহে এক্সটেন্ডেড-স্পেকট্রাম সেফালোস্পোরিন-প্রতিরোধী এন্টারোব্যাকটেরিয়াল ছিল। হাসপাতালে ভর্তি ৩৭ শতাংশ এবং কমিউনিটির নয় শতাংশ মানুষের মধ্যে কার্বাপেনেম-প্রতিরোধী এন্টারোব্যাকটেরিয়াল (সিআরই) পাওয়া যায়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ছিল, কমিউনিটির ১১ শতাংশ এবং হাসপাতালের ৭ শতাংশ রোগীর মধ্যে কলিস্টিন-প্রতিরোধী এন্টারোব্যাকটেরিয়ালস পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন অংশগ্রহণকারীর দেহে মেথিসিলিন-প্রতিরোধী স্ট্যাফাইলোকক্কাস অরিয়াস (এমআরএসএ) ছিল। ২৬শ’টিরও বেশি ব্যাকটেরিয়ার জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ে প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বৈচিত্র্য দেখা যায়, যা নির্দেশ করে যে একটি স্ট্রেইনের বিরুদ্ধে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক অন্যটির বিরুদ্ধে কাজ নাও করতে পারে।
২০২৩ সাল থেকে শুরু হওয়া গবেষণাটির দ্বিতীয় পর্যায়ে সংকটাপন্ন রোগী, নবজাতক এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ওপর এএমআরের প্রভাব সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য দিয়েছে।
নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (এনআইসিইউ) ভর্তি হওয়া নবজাতকদের ৮১ শতাংশের শরীরে (মোট ৪২৩ জনের মধ্যে ৩৪২ জন) কার্বাপেনেম-প্রতিরোধী ক্ল্যাবসিয়েলা নিউমোনি (সিআর-কেপিএন ) জীবাণুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক একটি অগ্রাধিকার প্যাথোজেন হিসেবে চিহ্নিত।
এই নবজাতকদের অর্ধেকেরও বেশি (৭০%, ১৮৫ জন) হাসপাতালে ৪৮ ঘণ্টার বেশি থাকার পর সিআর-কেপিএন দ্বারা কলোনাইজড হয়েছিল, যা হাসপাতাল থেকে সংক্রমণ ঝুঁকির বিষয়টি নিশ্চিত করে। প্রাপ্তবয়স্কদের আইসিইউ-তে ৬০ শতাংশ রোগীর দেহে সিআরই ছিল এবং কলোনাইজড রোগীদের সংক্রমণ হওয়ার ও হাসপাতালে দীর্ঘ সময় থাকার সম্ভাবনা বেশি ছিল।
গবেষণায় মা ও শিশুর মধ্যে জীবাণু ছড়িয়ে পড়া এবং এর দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি বোঝার জন্য তাদের ওপরও ১ বছর বয়স পর্যন্ত গবেষণা পরিচালিত হয়। প্রায় ৪০ শতাংশ শিশুর জীবনে প্রথম বছরের মধ্যেই সিআরই এবং প্রায় ৯০ শতাংশের মধ্যে ইএসসিআরইই-এর কলোনাইজেশন বা উপস্থিতি পাওয়া যায়। যেসব শিশু জন্মের পর ৭২ ঘণ্টার বেশি হাসপাতালে ছিল, তাদের মধ্যে কলোনাইজেশনের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি ছিল। এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই এই শিশুদের ৮০ শতাংশেরও বেশি অন্তত একবার অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করেছে, যা তাদের শরীরের স্বাভাবিক জীবাণুর উপস্থিতিকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
আশার কথা হলো, আর্চ গবেষণাটি দেখিয়েছে যে সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ (আইপিসি) ব্যবস্থা, যেমন স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে হাত ধোয়ার অভ্যাস জোরদার করা এবং পরিবেশগত পরিচ্ছন্নতা উন্নত করার মাধ্যমে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া দ্বারা কলোনাইজেশন রক্তের ইনফেকশন উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারে। সেমিনারে তুলে ধরা এই ফলাফলগুলো প্রমাণ করে যে সীমিত-সম্পদযুক্ত হাসপাতাল সেটিংয়েও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ দুর্বল রোগীদের রক্ষা করতে পারে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে অনলাইনে যোগ দিয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ড. মো. সায়েদুর রহমান বলেন, আমি এই গবেষণার ফলাফলগুলোকে অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং একইসাথে মূল্যবান বলে মনে করি। এগুলো আমাদের কৌশল ও ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতিকে আরও সূক্ষ্মভাবে সাজাতে সাহায্য করবে। আমরা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের ক্রমবর্ধমান হুমকি মোকাবেলায় সম্পূর্ণরূপে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
আইসিডিডিআর,বির নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ বলেন, আমরা অতীতে প্রেসক্রিপশন ছাড়া ঘুমের ওষুধের বিক্রি সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। অপব্যবহার সীমিত করতে এবং অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের মহামারি ধারণ করতে আমাদের অবশ্যই শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষেত্রে একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে।
ইউএস সিডিসির ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর মিস্টার ব্রায়ান হুইলার বলেন, আমরা আইসিডিডিআর,বি এবং সরকারের মধ্যে চলমান গবেষণাকে সমর্থন করার জন্য উন্মুখ। এটি একটি জটিল সমস্যা যা বৈশ্বিক প্রকৃতির, এবং এর সমাধান বহু-মাত্রিক। প্রতিটি সমাধানেরই একটি খরচ আছে, যা এটিকে কেবল একটি বৈজ্ঞানিক বিষয় নয়, বরং স্বাস্থ্য অর্থনীতি এবং নীতিরও একটি বিষয় করে তোলে।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ড. তাহমিনা শিরিন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. শেখ সায়িদুল হক এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ড. মো. শিব্বির আহমেদ ওসমানী বক্তব্য রাখেন।
সেমিনারে ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক, হাসপাতাল ব্যবস্থাপক এবং উন্নয়ন সহযোগীরা উপস্থিত ছিলেন।
বক্তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য জীবন রক্ষাকারী ওষুধ কার্যকারিতা রক্ষা করতে শক্তিশালী নজরদারি, হাসপাতাল সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ এবং যুক্তিসংগত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের জরুরি প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
আরকেআর/এএটি