ঢাকা: চর্বি জমে বা অন্য কোনও কারণে হৃদযন্ত্রের রক্তনালী সংকুচিত হয়ে রক্ত চলাচল বন্ধ বা বন্ধের উপক্রম হলে, ওষুধের মাধ্যমে তা ঠিক না হলে হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিক ক্রিয়া সচল রাখতে রিং বা করোনারি স্টেন্ট পরানো হয়।
দেশে রিং বা করোনারি স্টেন্টের দাম নির্ধারণ করে দেয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য মতে, দেশে রিংয়ের দাম ১৪ হাজার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১ লাখ ৮৮ হাজার টাকা।
ভারতের রিংয়ের দামের সঙ্গে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আয়ারল্যান্ডের এবোট ভাসকুলারের জিয়েন্স প্রাইম রিংয়ের দাম বাংলাদেশে ৬৬ হাজার ৬০০ টাকা, ভারতে এটার দাম ২২ হাজার ৫০০ রুপি যা বাংলাদেশি টাকায় ৩২ হাজার ৯৫ টাকা। জিয়েন্স আলপাইন রিংয়ের দাম এক লক্ষ ৪০ হাজার ৫০০ টাকা, ভারতে দাম ৫৪ হাজার ৫৮৩ টাকা। জিয়েন্স এক্সপেডিশানের দাম বাংলাদেশে ৭১ হাজার ৫০০ টাকা, ভারতে ৫৪ হাজার ৫৮৩ টাকা।
যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন সাইন্টিফিকের সিনার্জি রিংয়ের দাম ভারতে ৫৪ হাজার ৫৮৩ টাকা হলেও বাংলাদেশে এক লাখ ১৭ হাজার টাকা, প্রমাস এলিটের দাম ভারতে ৩২ হাজার ৯৫ টাকা, বাংলাদেশে ৭৯ হাজার টাকা।
ভারতে তৈরি মেটাফর ব্র্যান্ডের স্টেন্টের দাম বাংলাদেশে ৪০ হাজার টাকা, ভারতে ৩২ হাজার ৯৫ টাকা। বায়োমাইম রিংয়ের দাম বাংলাদেশে ৪৫ হাজার টাকা, ভারতে যার দাম ৩২ হাজার ৯৫ টাকা।
আয়ারল্যান্ডের তৈরি রিসোলুট ওএনওয়াইএক্স রিংয়ের দাম বাংলাদেশে এক লাখ ৪০ হাজার ৫০০ টাকা হলেও ভারতে ৫৪ হাজার ৫৮৩ টাকা। রিসোলুট ইন্টেগ্রিটির রিং দেশের বাজারে ৭৮ হাজার ৪০০ টাকা, ভারতে বিক্রি হয় ৩২ হাজার ৯৫ টাকায়।
জাপানের আল্টিমাস্টার তেনসেই রিংয়ের দাম বাংলাদেশে ৬৬ হাজার টাকা, ভারতে ৫৪ হাজার ৫৮৩ টাকা। সুইজারল্যান্ডের ওরসিরো ব্র্যান্ডের দাম বাংলাদেশে ৬৩ হাজার টাকা, ভারতে ৫৪ হাজার ৫৮৩ টাকা।
দুই দেশের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বেশ কিছু ব্র্যান্ডের একই মানের রিংয়ের দাম ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে বেশি। কিছু কোম্পানির রিংয়ের দাম দ্বিগুণ এবং কিছু রিংয়ের দাম প্রায় তিন গুণ।
এছাড়া হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর হার্টে রিং বসানোর নামে নানা অনিয়মেরও অভিযোগ রয়েছে। রোগীদের জিম্মি করে একটি চক্র, কিছু অসাধু চিকিৎসক ও কর্মচারীর যোগসাজশে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
রাজধানীর পুরান ঢাকায় বসবাস করা পঞ্চাশোর্ধ ফজলুর রহমান প্রায় বছর দুয়েক আগে বুকে ব্যথা অনুভব করলে মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি হোন। চিকিৎসকেরা তখন তাকে হার্টে রিং লাগানোর পরামর্শ দেন।
ফজলুর রহমানের রিং লাগানোর মতো আর্থিক সক্ষমতা না থাকার বিষয়টি চিকিৎসককে জানান। তখন চিকিৎসক তাকে কিছু নিধি নিষেধ, নিয়ম-কানুন মেনে চলার সঙ্গে কিছু ওষুধ নিয়মিত সেবনের পরামর্শ দিয়ে বলেন, সুযোগ পেলে যেন রিং লাগিয়ে নেন। তিন মাস পরে আবারও চিকিৎসকের কাছে গেলে তাকে আগের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ চালিয়ে যেতে বলেন। ফজলুর রহমান এখনও মোটামুটি ভালো আছেন।
অভিযোগ রয়েছে, কারও কারও হার্টে রিং পরানোর প্রয়োজনীয়তা না থাকলেও কিছু অসাধু চিকিৎসক কমিশনের লোভে পড়ে রোগীদের রিং লাগিয়ে দেন অথবা রিং লাগানোর পরামর্শ প্রদান করেন। যদিও চিকিৎসকেরা এসব অভিযোগ একেবারেই অস্বীকার করেন।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, ফজলুর হার্টে যে পরিমাণ ব্লক ছিল, ওষুধ দিয়ে হয়তো তার চিকিৎসা করানো সম্ভব ছিল। তাই নিয়মিত ওষুধ খেয়ে তিনি এখন ভালো আছেন। তবে তাকে নিয়মিত একজন চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক চলতে হবে। কিছু অসাধু চিকিৎসক প্রয়োজন না থাকলেও ওষুধের পরিবর্তে রিং বসানোর জন্য উৎসাহিত করেন, যা একেবারেই নৈতিকতা বিরোধী।
কোনো রকম কমিশন প্রদানের কারণে রিংয়ের দাম কম বেশি হয় কি না জানতে চাইলে স্থানীয় একজন আমদানীকারক এবং মেডিকেল ডিভাইস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমাদের রিংয়ের যে প্রাইসিং করা আছে, সেখানে রিটেলারদের জন্য একটা কমিশন দেওয়া আছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সেটা নেন।
মেডিকেল ডিভাইস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের আরেক নেতা বলেন, প্রত্যেকটা কার্ডিওলজিস্টের একটা নির্দিষ্ট পছন্দ আছে, যে আমি এই কোম্পানির রিং ব্যবহার করবো। দেশে যে সব রিং কোম্পানি আছে, যে যাকে, যেভাবে ম্যানেজ করতে পারে, সেটা তাদের ব্যাপার।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, দেশে প্রায় এক কোটি মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত। টাকার অভাবে অনেক রোগী হার্টে রিং বসাতে পারছেন না। অনেকেই আবার বহুকষ্টে ভিটেমাটি বিক্রি করে টাকা জোগাড়ের পর চিকিৎসা নিতে গিয়ে প্রতারিত হচ্ছেন। উন্নত মানের রিং লাগানোর কথা বলে নিম্নমানের রিং লাগানো হচ্ছে। তাই এ বিষয়ে কঠোর নজরদারি দরকার।
দেশে রিংয়ের দাম ভারতের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি কেন, জানতে চাইলে জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা শতভাগ ব্যবসা করে, পাঁচ টাকার পণ্য কিনলে তাদের ১০ টাকা বিক্রি করতে হবে। অন্যান্য দেশে এতো লাভে ব্যবসা করার সুযোগ নেই। সরকারের ট্যাক্স দাম বাড়ার ক্ষেত্রে একটা কারণ হতে পারে। ডলার ক্রাইসিসও একটা কারণ হতে পারে। ডলারের দাম বাড়ার ছুতো দিয়ে তারা পণ্যের দাম দুই আড়াইগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। মনোপলি করে দুই চারজন লোক এই ব্যবসাটা করে। তাদেরও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, ঠিকমতো এলসি খুলতে পারে না, পর্যাপ্ত পরিমাণ আনতে পারে না, এসব কারণেই হয়তো দেশে রিংয়ের দাম বেশি।
চিকিৎসকরা কমিশন নেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব অনেক আগের গল্প, এখন এসব নেই। কারণ আমাদের এখানে যে রিংয়ের দাম সত্তর হাজার টাকা, অ্যাপোলো হাসপাতালেও সেটা সত্তর হাজার টাকায় বিক্রি হয়। বাইরে থেকে যেসব ইক্যুপমেন্ট এনে মানুষের দেহে লাগানো হয়, সেগুলোর দাম সরকার কর্তৃক নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট করে দেওয়া দাম থেকে বেশি নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ফলে চিকিৎসকদের এখান থেকে কমিশন নেওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। তবে হ্যাঁ, কোনো চিকিৎসক হয়তো কোনো কোম্পানির রিং বেশি ব্যবহার করেন, তাকে সেই কোম্পানি হয়তো লভ্যাংশ থেকে বিদেশে কোনো কনফারেন্সে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। সরাসরি কমিশন গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। আমরা বিভিন্ন কোম্পানির ওষুধ প্রেসক্রিপশন করি, অনেক সময় কোম্পানি আমাদের এটা সেটা উপহার দেয়, রিংয়ের ক্ষেত্রেও বিষয়টা সেই পর্যায়ে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. রেজয়ানুল হক বুলবুল বলেন, বড় মার্জিন রেখেও এদেরকে কন্ট্রোল করা যাচ্ছিল না, রিংয়ের দাম আরও বেশি ছিল। আমরা সার্জারি করি, আমরাও সঠিক দাম জানতে পারি না, তবে আমাদের একটা ধারণা আছে কত দাম হতে পারে। তবে সঠিক দাম আমরা কোনোভাবেই জানতে পারি না। ট্রেড সিক্রেট হিসেবে এটার দাম তারা কখনো বলে না। সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে, সেটাও আসলে বেশি।
ভারতের চেয়ে দাম বেশি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার জানামতে ভারতে কোনো প্লান্ট নাই। প্লান্ট থাকলে হয়তো তারা কমদামে দিতে পারতো। আমাদের দেশে ব্যবহৃত স্টেন্ট কত লেন্থ, কত গ্রেড, কত ডায়ামিটার এই বিষয়গুলো সব তথ্য নিয়ে ভারতের সাথে মিলিয়ে দেখা দরকার। হেড টু হেড কম্পারিজম করতে পারলে বোঝা যাবে যে আমাদের দেশে চুরি ডাকাতি কোথায় হচ্ছে।
দেশে স্টেন্টের দাম প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, শুধু রিং না, অন্যান্য ওষুধের ক্ষেত্রেও যে এতো দাম বৃদ্ধি হইছে, ঔষধ প্রশাসন যেভাবে দাম নির্ধারণ করে সেই সমস্যার কারণে। দাম নির্ধারণে জনগণের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টা প্রতিফলিত হয় না। কেনো হয় না, কারণ ওইখানে যারা আছেন, ডিজি কিংবা অন্যান্য পরিচালক, তারা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন না, ওনারা চাকরি করেন। এছাড়া যারা এগুলো আমদানি করেন, তারা বিভিন্ন সরকারের রাজনৈতিক আনুকূল্য নিয়ে যে পরিমাণ প্রভাব রাখেন, তারা যা বলেন, অধিদপ্তরে যারা থাকেন তারা সেটা মেনে নিতে বাধ্য হোন।
তিনি আরও বলেন, আমরা কখনো কখনো শুনি প্রয়োজন না থাকলেও রিং পরানো হয়, এটাও একটা সমস্যা। কারণ এখানে একটা বড় ব্যবসা জড়িত। সরকারি-বেসরকারি যেকোনো হাসপাতাল এই ধরনের জোচ্চুরি যদি করে, তাহলে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, শুধু জরিমানা নয়, অত্যাবশ্যকীয়ভাবে জেল যেন হয়, সেটা নিশ্চিত করলে আমাদের দেশে স্বাস্থ্যসেবা মানুষের সাধ্যের মধ্যে থাকবে। মানুষ স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে নিঃস্ব হবে না।
চলতি বছরের ১৩ এপ্রিল রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের এক প্রজ্ঞাপন থেকে জানা যায়, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে সভাপতি করে ১৭ সদস্য বিশিষ্ট কার্ডিয়াক পরামর্শক স্টান্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে।
উক্ত কমিটির কার্য পরিধিতে বলা হয়েছে, কমিটি কার্ডিয়াক ডিভাইস আমদানিকারক প্রতিনিধিদের সাথে সভা করে রেফারেন্স প্রাইসিং মূল্য নির্ধারণের বিষয়ে মতামত প্রদান করবেন। এক্ষেত্রে প্রতিবেশী চারটি দেশের ডিভাইসের দাম ও আরোপিত কর/শুল্ক কাঠামো বিবেচনায় নিয়ে ডিভাইসের মূল্য নির্ধারণে সুপারিশ করবেন।
রিংয়ের দাম বেশি কেন, সে প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক এবং মুখপাত্র ড. আকতার হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, আগে যদি এসব হয়ে থাকে, সেটা হয়তো হয়েছে, এখন সেই সুযোগ নেই। হার্টের রিংয়ের দাম এখন নিয়ন্ত্রিতভাবেই হয়। নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি নিয়মিত কাজগুলো করছে। নতুন কমিটির মিটিং শিগগিরই হবে। মিটিংয়ে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত আসবে। এর আগে সমস্যা ছিল বলেই হয়তো মন্ত্রণালয় চিন্তা করেছে, আমরাও পজিটিভলি আগাচ্ছি।
আরকেআর/এজে