ঢাকা, মঙ্গলবার, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২০ মে ২০২৫, ২২ জিলকদ ১৪৪৬

ফুটবল

গাজায় খেলাধুলার কবর, ফিফার মুখে ‘নিরপেক্ষতার মুখোশ’

স্পোর্টস ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:২৪, মে ২০, ২০২৫
গাজায় খেলাধুলার কবর, ফিফার মুখে ‘নিরপেক্ষতার মুখোশ’ সংগৃহীত ছবি

গাজায় চলমান গণহত্যা একাধিক নির্মম সত্য সামনে এনেছে—নৈতিকতার বাণী হয়তো আদৌ কোনোদিন বাস্তব ছিল না; কিংবা থাকলেও আজ তার আর কোনো গুরুত্ব বা তাৎপর্য নেই।

ইসরায়েলকে বহিষ্কারের ব্যাপারে বা দখলকৃত পশ্চিম তীরে অবস্থিত ছয়টি ক্লাবকে ইসরায়েল ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (আইএফএ) লিগে খেলার অনুমতি নিয়ে ফিফা এখনো কোনো তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি।

২০২৪ সালের মে মাসে, ফিলিস্তিন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (পিএফএ) ৭৪তম ফিফা কংগ্রেসে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে, যেখানে তারা ইসরায়েলকে ফিফা থেকে বহিষ্কারের আহ্বান জানায়—কারণ, ফিলিস্তিনি ক্রীড়াঙ্গনের অধিকার লঙ্ঘন করে আসছে ইসরায়েল।

এক বছর পর, ২০২৫ সালের ১৫ মে প্যারাগুয়ের আসুনসিওনে অনুষ্ঠিত ৭৫তম ফিফা কংগ্রেসে পিএফএর সহ-সভাপতি ও এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের নির্বাহী সদস্য সুসান শালাবি ফিফাকে আর সময় নষ্ট না করার আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, “আমরা কেবল শুনতে চাই, বিষয়টির বর্তমান অবস্থা কী এবং তদন্ত শেষ হবে কবে। এক কমিটি থেকে আরেক কমিটিতে ফাইল ঠেলাঠেলি করে লাভ নেই, যখন ফিলিস্তিনে ফুটবল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ”

শালাবি এক মাসের মধ্যে বিষয়টির অগ্রগতি জানাতে ফিফার গভর্নেন্স প্যানেলকে নির্দেশ দেওয়ার আহ্বান জানান, যার দায়িত্বে রয়েছেন ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো।

তার আবেগঘন বক্তব্যের সময় কংগ্রেস হলে উপস্থিত প্রতিনিধিরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে করতালি দেন—এটাই ছিল পুরো অধিবেশনের একমাত্র মুহূর্ত যেখানে ইনফান্তিনোর উৎসাহ ছাড়াই করতালির ধ্বনি ওঠে।

ইসরায়েলসহ কোনো সদস্যদেশই বক্তব্য না দেওয়ার পর ফিফার পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়। ফিফার মহাসচিব মাতিয়াস গ্রাফস্ট্রম বলেন, দুটি তদন্ত এখনো চলছে এবং নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত কমিটির সদস্যদের বিষয়টি বিস্তারিতভাবে জানানো প্রয়োজন।

তিনি জানান, “কমিটিগুলো অত্যন্ত জটিল এ বিষয়টির নিষ্পত্তিতে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ”

তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—এক বছর ধরে একটি ‘অভিযুক্ত বৈষম্যজনিত অপরাধের’ তদন্ত শেষ না হওয়া কতটা যৌক্তিক? ফিফার ডিসিপ্লিনারি কমিটি, যাদের কাজ এসব অভিযোগ তদন্ত করে সুরাহা করা, তারা এখনো কোনো রিপোর্ট দেয়নি। ইসরায়েলি ক্লাবগুলো যেহেতু দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে খেলে, বিষয়টি নিয়ে ফিফার গভর্নেন্স, অডিট ও কমপ্লায়েন্স কমিটির দীর্ঘ তদন্ত অনেকের কাছেই প্রশ্নবিদ্ধ।

ফিফার এই নীরবতা এবং দীর্ঘসূত্রিতা গাজায় চলমান হত্যাকাণ্ডের প্রতি তাদের পরোক্ষ সমর্থন বা সহোযোগিতার ইঙ্গিত দেয়। এই ধরণের সহোযোগিতা পশ্চিমা রাষ্ট্র, মিডিয়া ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দীর্ঘদিনের বৈশিষ্ট্য।

এখন পর্যন্ত ফিফা গাজায় ক্রীড়াবিদদের হত্যাকাণ্ড বা স্টেডিয়াম, ক্লাব ও অন্যান্য ক্রীড়া অবকাঠামোর ধ্বংস নিয়ে কোনো বিবৃতি দেয়নি। বরং তারা “ইসরায়েল ও হামাসের যুদ্ধ” হিসেবে ঘটনাকে নিরপেক্ষভাবে উপস্থাপন করে নিজেদের দায় এড়িয়ে গেছে।

পশ্চিম তীরে অবস্থিত ছয়টি ইসরায়েলি বসতি ক্লাবের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেয়নি ফিফা, যদিও ইউরোপিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (উয়েফা) নিয়ম অনুযায়ী, কোনো ক্লাব তার নিজ ভূখণ্ডের বাইরে খেলার জন্য সংশ্লিষ্ট অ্যাসোসিয়েশনের অনুমতি নিতে বাধ্য।

গণহত্যা চলতে থাকায় ফিফার ৩৭ সদস্যবিশিষ্ট কাউন্সিলের কেউ—এমনকি ইনফান্তিনো নিজেও—গাজার পক্ষ নিয়ে কিছু বলবেন, এমন আশাও করা যাচ্ছে না। এধরনের নীরবতা এক কর্পোরেট-রাজনৈতিক স্বার্থের সংস্কৃতিরই বহিঃপ্রকাশ।

খেলাধুলা, সংস্কৃতির একটি অংশ হিসেবে, মানবতার সেবক হওয়া উচিত। যখন এটি কেবল মুনাফা, বিনোদন বা ক্ষমতাধরদের বন্ধন রচনার হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়, তখন এর মূল উদ্দেশ্যই হারিয়ে যায়। ফলে, ক্রীড়া পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি—না হলে তারা নিজেদের মূল্যবোধকেই ধ্বংস করে দেবে।

ইনফান্তিনো সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফরসঙ্গী হয়েছিলেন। তিনি কাউন্সিল সভাগুলো বারবার ভার্চুয়ালভাবে আয়োজন করছেন—প্যারাগুয়ের কংগ্রেসের আগেও তৃতীয়বারের মতো অনলাইন সভার আয়োজন করেন।

স্পোর্টস সাংবাদিক সামিন্দ্রা কুন্তি লিখেছেন, “এই নিয়ে পরপর তিনবার কাউন্সিল সভা ভার্চুয়ালভাবে হচ্ছে। ইনফান্তিনোর অধীনে এই কাউন্সিল কার্যত ‘রাবার স্ট্যাম্প’ হয়ে গেছে। বছরে আড়াই লাখ ডলার বেতন পেলেও খুব কম সদস্যই কোনো প্রশ্ন তোলেন। কাউন্সিলের ভাইস প্রেসিডেন্টরা, যারা একইসাথে কনফেডারেশনের সভাপতিও, তারা বছরে তিন লাখ ডলার করে নেট বেতন পান। ”

ইনফান্তিনোর কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ২০২২ সালের বিশ্বকাপ আয়োজন করেছে কাতার, যেখানে বর্তমানে ইনফান্তিনোর বেস। ২০৩৪ বিশ্বকাপ আয়োজন করবে সৌদি আরব।

ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর সখ্যতা এতটাই যে, ইনফান্তিনোর মধ্যস্থতায় এসব রাষ্ট্র ট্রাম্পের প্রতি আরও উদার হবে বলে আশা করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ইনফান্তিনোর সমর্থনে ট্রাম্পের পকেটে ঢুকেছে আরও বিলিয়ন ডলার।

ইনফান্তিনো প্যারাগুয়ের কংগ্রেসে দুই ঘণ্টা দেরিতে উপস্থিত হন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে উয়েফা’র প্রতিনিধিরা কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে যান এবং অভিযোগ তোলেন যে ইনফান্তিনো ব্যক্তিগত স্বার্থকে খেলাধুলার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।

গাজায় ক্রীড়া জগত আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত। অথচ ফিফা মুখে কুলুপ এঁটেছে।

ফিলিস্তিনি ক্রীড়া সাংবাদিক নেলি মাসরির সঙ্গে আলাপে ক্রীড়া সম্প্রচারক শায়মা আবু আল-জিবিন (২৮) বলেন, “যুদ্ধ শুরু হতেই সব থেমে যায়। আমাদের তুফাহ মহল্লা পুরো যুদ্ধজুড়ে অবরুদ্ধ ছিল। কয়েকবার আমরা ঘর হারিয়েছি—প্রথমে গাজার উত্তর, এরপর গাজা শহর এবং শেষে দেইর আল-বালাহ। ”

ইসরায়েলি বোমা বর্ষণের সময় ঘরছাড়া হওয়া শায়মা আফসোস করে বলেন, “আমার রেডিও স্টেশনটি ধ্বংস না হলে আজ আমি কিছুটা স্থিরতা পেতাম। ” তিনি বলেন, “বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাবার চিকিৎসার জন্য অনেক পথ হেঁটেছি। চিকিৎসা পাওয়া যায়নি। কিছুদিনের মধ্যেই বাবা মারা যান। ”

আরেক সাংবাদিক নাসরিন হালাস জানান, প্রথম হামলার পর থেকেই তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। যুদ্ধ শেষে গাজায় ফিরে এলেও জীবনে আর কোনো স্বাভাবিকতা ফেরেনি। “সব ধ্বংস হয়ে গেছে—স্টেডিয়াম, ক্লাব, কর্মস্থল। কোনো চাকরি নেই। আমরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতাম সারি বেঁধে। ”

স্পোর্টস ফটোগ্রাফার নিহমা বাসলা (৩৩) বলেন, “যুদ্ধ যেন খেলাধুলাকেই নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। আমার ক্যামেরার চোখ দিয়ে আর কোনো আশার ছবি ধরা পড়ে না। আমি পরিবার নিয়ে উত্তরে রয়ে গেছি—যেখানে জীবনই এখন কেবল সংগ্রাম। ”

তথ্যসূত্র: দ্য প্যালেস্টাইন ক্রনিকলদ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া

এমএইচএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।