ঢাকা: অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সব ধরনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ার পর দলটির নিবন্ধনও স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এখন প্রশ্ন উঠেছে— স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সেই চেয়ারম্যানদের ভবিষ্যৎ কী হবে, যারা দলীয় ‘নৌকা’ প্রতীক নিয়ে ভোটে জিতে চেয়ারে বসেছিলেন।
ইউনিয়ন পরিষদ আইন এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন আইনে চেয়ারম্যান বা নির্বাচিত প্রার্থীদের অপসারণ বা বরখাস্ত করার বেশ কিছু বিধান রয়েছে। তবে নিবন্ধন বাতিল বা স্থগিত হলে কিংবা দলীয় কার্যক্রম সরকারের পক্ষ থেকে নিষিদ্ধ করা হলে তাদের সরানো যাবে— এমন কোনো বিধান নেই।
সাধারণত দুর্নীতি, কুশাসন, অর্থ-সম্পত্তির ক্ষতিসাধন, ফৌজদারি অপরাধে সাজা, রাষ্ট্রীয় স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর কাজে জড়িত থাকাসহ বিভিন্ন কারণে চেয়ারম্যানদের অপসারণ করা যায়।
ইউপি চেয়ারম্যানের অপসারণ নিয়ে কী বলছে আইন?
স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন-২০০৯ অনুযায়ী, ফৌজদারি মামলায় অভিযোগপত্র আদালত আমলে নিলে, সেক্ষেত্রে যদি কর্তৃপক্ষের কাছে চেয়ারম্যানের ক্ষমতা প্রয়োগ পরিষদের স্বার্থবিরোধী অথবা প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমীচীন না হয়, তাহলে সরকার তাকে সাময়িক বরখাস্ত করতে পারে। এ ছাড়া অপসারণযোগ্য অপরাধ বা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকলেও সাময়িক বরখাস্ত করা যায়।
চেয়ারম্যান পরপর তিনটি সভায় অনুপস্থিত থাকলে; পরিষদ বা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর কোনো কাজে জড়িত থাকলে বা দুর্নীতি বা অসদাচরণ (ক্ষমতার অপব্যবহার, কর্তব্যে অবহেলা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ইচ্ছাকৃত কুশাসন) বা নৈতিক স্খলনজনিত কোনো অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে দণ্ডপ্রাপ্ত হলে; দায়িত্ব পালনে অস্বীকার কিংবা শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে দায়িত্ব পালনে অক্ষম হলে; অসদাচরণ বা ক্ষমতার অপব্যবহারে দোষী হলে বা পরিষদের কোনো অর্থ-সম্পত্তি ক্ষতিসাধন বা আত্মসাৎ বা অপপ্রয়োগের চেষ্টা করলে; বার্ষিক ১২টি সভার মধ্যে ন্যূনতম নয়টিতে অনুপস্থিত থাকলে, নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব দাখিল না করলে; বিনা অনুমতিতে দেশত্যাগ বা অনুমতি নিয়ে দেশ ত্যাগের পর সেখানে অনুমতি ছাড়া অবস্থান করলে- সরকার তাকে অপসারণ করতে পারে।
এ ছাড়া, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করলে, আদালত থেকে অপ্রকৃতিস্থ ঘোষিত হলে, নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে অন্যূন দুই বছর সাজা হলে এবং মুক্তিলাভের পাঁচ বছর সময় অতিবাহিত না হলে, প্রজাতন্ত্র বা পরিষদের বা অন্য কোনো স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কোনো কাজে লাভজনক সার্বক্ষণিক পদে অধিষ্ঠিত থাকলে, জাতীয় সংসদ সদস্য বা অন্য কোনো স্থানীয় সরকারের সদস্য হলে, চেয়ারম্যান বা তার ওপর নির্ভরশীল কোনো পরিষদের কাজ বা মালামাল সরবরাহের জন্য ঠিকাদার হলে বা পরিষদের সঙ্গে কোনো আর্থিক স্বার্থ থাকলে বা সরকার থেকে নিযুক্ত অত্যাবশ্যক কোনো দ্রব্যের ডিলার হলে, ঋণ খেলাপি হলে, পরিষদের কাছে অতীতের কোনো দায়-দেনা থাকলে, পরিষদের অর্থ নয়-ছয়ের কারণে দণ্ডপ্রাপ্ত হলে, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক আদালত বা ট্রাইব্যুনাল থেকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত হলে, কোনো আদালত থেকে ফেরারি আসামি হলে কোনো ব্যক্তি চেয়ারম্যান পদে থাকার অযোগ্য হয়ে যান।
নির্বাচন কমিশনের ব্যাখ্যা কী?
ইসির আইন শাখার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, কমিশনের কাজ গেজেট করা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। পরের সব কার্যক্রম স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। পরিষদের চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হওয়া ও পদে না থাকতে পারার কিছু অযোগ্যতা আইনে উল্লেখ করা হয়েছে। সে অনুযায়ী সরকার তথা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তা কার্যকর করে। এক্ষেত্রে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরখাস্ত করতে পারেন। পরে মন্ত্রণালয় স্থায়ীভাবে বরখাস্ত বা অপসারণ করতে পারে।
তিনি বলেন, পদে না থাকতে পারার যে আইন আছে, সেখানেও নিবন্ধন কার্যক্রম স্থগিত হওয়ার বিষয়টি নেই। কাজেই নিবন্ধন স্থগিতের স্পিরিট আমলে নিয়েও আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যানদের বরখাস্ত করা যাবে না। অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকার এই দল ও এর অঙ্গ-সংগঠনের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে। ইসি সে আলোকে নিবন্ধন স্থগিত করেছে। কাজেই নিবন্ধন তো আছে। এর অর্থ নিষেধাজ্ঞা না ওঠা পর্যন্ত ইসি সব কাজে দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা স্থগিত রেখেছে।
এই কর্মকর্তা বলছিলেন, সরকার দলটিকে নিষিদ্ধ করেনি। কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে। আইন অনুযায়ী, দলের চেয়ারম্যান পদে থাকা ব্যক্তিদের স্বপদে থাকার বিষয়টি তো নিষিদ্ধ করেনি। কাজেই দলীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধকরণ বা নির্বাচন স্থগিতকরণ— কোনো প্রজ্ঞাপনের ভিত্তিতেই চেয়ারম্যান পদ থেকে দলটির প্রার্থীদের সরিয়ে দেওয়া যাবে না। অতীতেও এমন নজির রয়েছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিলের পর দলটির দুই নেতার সংসদ সদস্যপদ বাতিল করা যায়নি। কাজেই সেটিও অনুসরণীয় হবে।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, আদালতের ২০১৩ সালের এক আদেশে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়। কিন্তু তখন দলটির নেতা হামিদুর রহমান আযাদ কক্সবাজার-২ আসনের এবং মাওলানা মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম চট্টগ্রাম-১৪ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় তাদের সংসদ সদস্য পদ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। তবে কোনো দলের প্রতীক নিয়ে কোনো প্রার্থী নির্বাচিত হওয়ার পর সেই দলের নিবন্ধন বাতিল হলে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর সংসদ সদস্য পদ বাতিলের বিধান না থাকায় তারা টিকে গিয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগের ইউপি চেয়ারম্যানদের পদ টিকবে তো?
ইসি সচিব আখতার আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, নিবন্ধন স্থগিত করায় ইউনিয়ন পরিষদে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত চেয়ারম্যানরা পদে থাকতে পারবেন কি না, এটি একটি ভালো প্রশ্ন। বিষয়টির জবাব আইনি পর্যালোচনার মাধ্যমে পাওয়া যাবে।
এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন করা স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান তোফায়েল আহমেদ বলেন, সরকার আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে। এর ভিত্তিতেই দলটির নিবন্ধন স্থগিত করেছে ইসি। প্রার্থী ওই দলের হলেও তিনি তো চেয়ারম্যান। চেয়ারম্যানের পদে থাকার ওপর তো কোনো নিষেধাজ্ঞা বা স্থগিতাদেশ আসেনি। কাজেই আইনিভাবে তাদের পদে থাকতে কোনো অসুবিধা নেই। এখন তাদের নড়াচড়া করারই বা দরকার কী? যদি কাজ করতে পারে, করুক না। সংস্কার কার্যক্রম হয়ে গেলে তো দলীয়ভাবে আর স্থানীয় নির্বাচনই হবে না।
কয়েকটি দলের আন্দোলনের মুখে গত ১০ মে আওয়ামী লীগের সকল কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় সরকার। পরে ১২ মে দলটির নিবন্ধন স্থগিত করে ইসি। ২০০৮ সাল থেকে নিবন্ধন ছাড়া কোনো দল নিজ প্রতীকে ভোটে অংশ নিতে পারে না।
ইইউডি/আরএইচ