ঢাকা, শুক্রবার, ১ কার্তিক ১৪৩২, ১৭ অক্টোবর ২০২৫, ২৪ রবিউস সানি ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

পর্যাপ্ত উৎপাদন সত্ত্বেও নিরাপদ খাদ্যের ঘাটতি

রেজাউল করিম রাজা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪:৩৫, অক্টোবর ১৬, ২০২৫
পর্যাপ্ত উৎপাদন সত্ত্বেও নিরাপদ খাদ্যের ঘাটতি

বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার গৌরব অর্জন করেছে। চাল, ডাল, মাছ, মাংস, সবজি, পোলট্রি, দুধসহ প্রায় সবক্ষেত্রেই উৎপাদন বেড়েছে আগের তুলনায় কয়েকগুণ।

কিন্তু এই সাফল্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভয়ংকর এক বাস্তবতার নাম নিরাপদ খাদ্যের ঘাটতি।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল প্রায় সাত কোটি। চলতি বছরে জনসংখ্যা হয়েছে ১৭ কোটি। জনসংখ্যা অর্ধেকের কম থাকা সত্ত্বেও ১৯৭৪ সালে দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়। বিগত ৫০ বছরের বেশি সময়ে এ দেশের জনসংখ্যা আড়াই গুণের বেশি বেড়েছে। জনসংখ্যা বাড়লেও বিগত ৫০ বছরের অধিক সময়েও দেশে আর কোনো দুর্ভিক্ষ হয়নি।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের তথ্য অনুসারে, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে বার্ষিক ধান উৎপাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় এক কোটি টন, ২০২৪ সালে এসে উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তিন কোটি ৬০ লাখ টন।  ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কৃষি ও পল্লি ঋণ নীতিমালা থেকে জানা যায়, বিশ্বে চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ বর্তমানে তৃতীয় স্থানে অবস্থান করছে। এ ছাড়াও মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে দ্বিতীয়, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, ছাগল উৎপাদনে পঞ্চম, আলু উৎপাদনে সপ্তম এবং রসুন উৎপাদনে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।

তথ্য বলছে, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে মোট খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছিল ৫০১ দশমিক ১৭ লাখ মেট্রিক টন যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় ৭ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশে মোট কৃষিজ উৎপাদন প্রায় ৩ দশমিক ৫ গুণ বেড়েছে। গত এক দশকেই খাদ্যশস্য উৎপাদন বেড়েছে ১২৯ দশমিক ৫১ শতাংশ।

মৎস্যখাতে মোট উৎপাদন ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে থাকা ৪১ দশমিক ৩৪ লাখ মেট্রিক টন থেকে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ৫০ দশমিক ৮০ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। এ ছাড়া দুধ ও মাংস উৎপাদন গত এক দশকে যথাক্রমে ২ দশমিক ১৫ গুণ এবং ১ দশমিক ৫৭ গুণ বেড়েছে।  

বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, বাজারে থাকা ভোগ্যপণ্যের একটি বড় অংশেই ব্যবহৃত হচ্ছে কেমিক্যাল ও শিল্পোৎপাদিত রং। এ ছাড়াও খাদ্য শস্য উৎপাদনের সময়েও মাত্রাতিরিক্ত সার এবং কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। বৃষ্টি বা বন্যার পানিতে এসব কেমিক্যাল আমাদের নদ-নদীর পানি ও মাটিতে মিশে যাচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষ খাদ্য গ্রহণের পাশাপাশি শরীরে ঢুকিয়ে নিচ্ছে বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত উপাদান। এতে দীর্ঘমেয়াদে আমাদের শরীরে ডায়াবেটিস, হাইপার টেনশন, ক্যানসার, কিডনি ও লিভারের জটিল সব রোগ বাড়ছে।

খাদ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্য উৎপাদনে যতটা জোর দেওয়া হয়েছে, তার অর্ধেকটাও যদি নিরাপত্তার দিকে দেওয়া হতো তাহলে বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। শুধু ভেজালবিরোধী অভিযান করেই সংকটের সমাধান সম্ভব নয়, স্থায়ী ব্যবস্থা না নিলে খাদ্য সংকট নয়, নিরাপদ খাদ্যের সংকটই ভবিষ্যতে বড় বিপদ হয়ে দেখা দেবে।

অপরদিকে বৈশ্বিক খাদ্যসংকট নিয়ে প্রকাশিত ‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস ২০২৫’ এর রিপোর্ট থেকে জানা যায়, তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থাকা বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে চতুর্থ স্থানে আছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের পাঁচটি সংস্থা মিলে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সংস্থাগুলো হলো এফএও, ইফাদ, ডব্লিউএফপি, ডব্লিউএইচও ও ইউনিসেফ।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) দেওয়া ‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস’ শীর্ষক পৃথক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে তীব্র খাদ্য সংকটে থাকা ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ।

দুই প্রতিবেদন অনুসারে, শুধু খাদ্য নিরাপত্তার সংকটেই নয়, স্বাস্থ্যকর বা সুষম খাদ্য গ্রহণের দিক থেকেও বাংলাদেশ পিছিয়ে। এ বিষয়ে গত সাত বছরে অনেকটা উন্নতি হলেও এখনও দেশের ৭ কোটি ৭১ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পায় না। দেশের ১০ শতাংশের বেশি মানুষ অপুষ্টির শিকার। বাংলাদেশে যথেষ্ট খাদ্য মজুত আছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এই প্রতিবেদনগুলো নিয়ে তাদের প্রশ্ন রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জীবন ধারণের জন্য খাদ্য অপরিহার্য উপাদান। সেই খাদ্য হতে হবে নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যকর, নতুবা হিতেবিপরীত হতে পারে। সুস্থ থাকার জন্য খাবার খেয়ে, সেই খাবারের জন্যেই যদি আবার শরীরে বহুবিধ সমস্যা তৈরি হয়, তার থেকে দুঃখজনক আর কিছুই হতে পারে না।  

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সের পুষ্টিবিদ ড. শারমিন হোসাইন বাংলানিউজকে বলেন, অন্যান্য দেশেও খাদ্য শস্য উৎপাদনে সার প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সার ব্যবহারের যথাযথ প্রয়োগ অনেকেই জানে না। এ কারণে আমাদের দেশের কৃষকরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত সার বা কীটনাশক দিয়ে থাকেন। ফলে আমাদের পরিবেশ, মাটি ও পানি দূষিত হচ্ছে। ফলে কীটনাশক শাকসবজি ও মাছ-মাংস খাবারের মাধ্যমে আমাদের দেহে ঢুকছে এবং শরীরের জন্যেও ক্ষতিকর হয়ে যাচ্ছে।

নিরাপদ খাদ্য প্রসঙ্গে হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় প্রধানত দুটি কারণে। খাদ্য উৎপাদনের প্রথম পর্যায় থেকে শুরু করে খাবার টেবিল পর্যন্ত আসার সময়ে না জায়গায় খাদ্য দূষণের শিকার হয়। যেমন যে মাটিতে শস্য চাষ করা হয়, চাষের উপযোগী করার জন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত রাসায়নিক সার সেখানে ব্যবহার করা হয়। শস্য বপনের পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য যে পরিমাণ কীটনাশক ব্যবহার করা হয়, সেটিও বিপজ্জনক পর্যায়ে। এরপর যখন খাদ্য শস্যকে সংরক্ষণ করা হয়, সেখানেও নানাবিধ রাসায়নিকের ব্যবহার করা হয়। আবার কোন কোন শস্যকে পাকানোর জন্যেও রাসায়নিকের ব্যবহার করা হয়। খাবারের জন্য যখন প্রক্রিয়াজাত করা হয়, তখনো নানা কিছু মেশানো হয়। এভাবেই আমাদের খাবার টেবিলে আসা পর্যন্ত নানাভাবে দূষণের শিকার হয়।

এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, খাদ্য দূষণমুক্ত রাখার জন্য সরকারের যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তারা যথাযথ নজরদারি করে না। ফলে আমাদের দেশে ক্যানসার, কিডনি ডিজিজ, লিভার, থাইরয়েড সমস্যা, বন্ধ্যাত্ব, অপুষ্টি আবার কারও অধিক ওজন হচ্ছে, চূড়ান্তভাবে আমাদের বিভিন্ন রোগ বাড়ছে, সুস্থ থাকা বিঘ্নিত হচ্ছে। খাবার নিরাপদ না হওয়ার আমরা বেশি বেশি অসুস্থ হচ্ছি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিরাপদ খাবার দেশের মানুষের সুস্বাস্থ্যের অন্যতম একটি উপাদান। সুস্থ সবল কর্মঠ জাতি গঠনে খাবার উৎপাদনের পাশাপাশি খাবারের নিরাপত্তার বিষয়টি অতি গুরুত্বপূর্ণ। সব অংশীজনের সমন্বয়ে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে না পারলে জনস্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে, যা আমাদের কারোই কাম্য নয়।

আরকেআর/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।