ঢাকা, সোমবার, ২৭ আশ্বিন ১৪৩২, ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ২০ রবিউস সানি ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

বিএনপিতে এবার ‘এক পরিবার এক প্রার্থী’

সিফাত বিনতে ওয়াহিদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২:২৫, অক্টোবর ১২, ২০২৫
বিএনপিতে এবার ‘এক পরিবার এক প্রার্থী’

ঢাকা: আগামী বছর ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপ অনুযায়ী, ডিসেম্বরের মধ্যেই ঘোষণা হতে পারে তফসিল।

ইতোমধ্যে নির্বাচনের ট্রেনে উঠে পড়েছে পুরো বাংলাদেশ, প্রস্তুতি নিচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোও। পিছিয়ে নেই বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।

দলটি এরইমধ্যে আসন চূড়ান্ত করার কাজ প্রায় শেষ করেছে। পাশাপাশি চলছে বিভিন্ন আসনে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নিরসনের প্রক্রিয়া। নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করার চেষ্টায় মনোনয়ন প্রত্যাশীরা দৌড়ঝাঁপ করছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের দ্বারে দ্বারে। তবে দলের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম এবার একটি পরিবার থেকে কেবল একজনকেই দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতিতে নতুন এক দৃষ্টান্ত তৈরি করবে বিএনপি। বহুদিন ধরেই দেশের রাজনীতিতে পারিবারিক প্রভাব, আত্মীয়তার সূত্রে প্রার্থী মনোনয়ন এবং রাজনৈতিক বংশানুক্রমের অভিযোগ প্রচলিত। এবার সেই ধারা ভাঙতে যাচ্ছে দলটি, যা রাজনীতির মাঠে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে, অনেকের কাছে এটি ইতিবাচক বার্তাও।

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি ‘এক পরিবার এক প্রার্থী’ নীতি গ্রহণের মধ্য দিয়ে দলীয় মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনার চেষ্টা করলেও, পুরোপুরি পরিবারতন্ত্রের বাইরে যেতে পারেনি। তাদের মতে, বিএনপির বিভিন্ন অঞ্চলে এমন বহু ত্যাগী ও যোগ্য নেতা আছেন, যারা বিগত দেড় দশক ধরে দলের দুঃসময়ে মাঠে ছিলেন, মামলা-হামলা মোকাবিলা করেছেন। কিন্তু সেসব এলাকায় অনেক ক্ষেত্রেই দলের শীর্ষ নেতাদের পরিবার থেকেই মনোনয়ন প্রত্যাশী নির্ধারণের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ফলে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে, দলের প্রতি নিবেদিত, ত্যাগী কর্মীরা কি কেবল নেতৃত্বের পরিবারের কারণেই বঞ্চিত হবেন?

তাদের বক্তব্য, দলের নেতৃত্ব যদি পরিবারের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে মাঠের ত্যাগী ও পরিশ্রমী নেতাদের জন্য পথ আরও কঠিন হয়ে পড়বে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি যদি সত্যিই পরিবারতন্ত্র ভাঙতে চায়, তাহলে পরিবার ছাড়াও দলীয় ত্যাগী নেতাকর্মীদের যোগ্যতা ও অবদানকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।  

এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র ভাঙা সহজ নয়। বিএনপির এই নীতি ইতিবাচক হলেও, বাস্তবায়নের সময় দেখা যাবে- কতটা তারা দলের ভেতরে গণতন্ত্র চর্চা করতে পারে। এটা শুধু প্রার্থিতা নয়, দলীয় সংস্কৃতির বিষয়ও। যদি দলের শীর্ষ নেতৃত্ব এখনও পরিবারকেন্দ্রিক থাকে, তাহলে এই নীতি বাস্তবে মাঠপর্যায়ে কোনো পরিবর্তন আনবে না। বিএনপিকে দেখাতে হবে যে তারা সত্যিই ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করতে প্রস্তুত। ’

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ বলছেন, বিএনপির বেশ কিছু সিনিয়র নেতার পরিবারের সদস্যরাও বিগত ১৫–১৬ বছরে দলীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। যখন মামলার কারণে বা রাজনৈতিক হয়রানিতে অনেক নেতাকে এলাকা ছেড়ে দূরে থাকতে হয়েছে, তখন তাদের স্ত্রী, পুত্র বা কন্যারা নানা উপায়ে নির্বাচনী এলাকায় দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছেন। কেউ জুলুম-নির্যাতন সহ্য করেছেন, কেউ কারাগারে থেকেও দলীয় কর্মীদের মনোবল ধরে রেখেছেন। বিশ্লেষকদের মতে, এই দীর্ঘ সময়ে দলের প্রতি তাদের ত্যাগ ও নিবেদনও উপেক্ষা করা যায় না।

দলের দায়িত্বশীল সূত্রের দাবি, 'এক পরিবার এক প্রার্থী'র এই সিদ্ধান্ত এসেছে সরাসরি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে। তিনি সম্প্রতি একাধিক সিনিয়র নেতাকে ফোন করে স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন- একটি পরিবার থেকে কেবল একজন প্রার্থীই নির্বাচন করতে পারবেন। এমনকি তিনি প্রত্যেক রাজনৈতিক পরিবারকে পারিবারিকভাবে আলোচনার মাধ্যমে একজন প্রার্থীর নাম নির্ধারণ করে মনোনয়ন বোর্ডে জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

সম্প্রতি বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও প্রার্থীতা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে যোগ্যতার মানদণ্ড বেঁধে দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। বিবিসি বাংলাকে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে এক পরিবারের এক প্রার্থীকে নমিনেশন দেওয়ার ব্যাপারে কথা না বললেও তারেক রহমান জানিয়েছেন, একটি পার্টিকুলার এলাকা থেকে তারা দলের এমন একজন ব্যক্তিকেই নমিনেশন দিতে চাইছেন, যিনি ওই এলাকার সমস্যা সম্পর্কে সচেতন। যার সঙ্গে ওই এলাকার মানুষের সম্পৃক্ততা আছে, ওঠাবসা আছে, যিনি ওই এলাকার মানুষের সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম। তিনি বলেন, ‘যার প্রতি জনগণের সমর্থন আছে- সেরকম মানুষ দেখেই আমরা নমিনেশন দেবো। ’

তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, যদি একজন নেতার পরিবারকে একাধিক আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়, অন্যরাও একই দাবি তুলবেন। তাতে অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ বাড়বে। তাই দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান চান, আসন্ন নির্বাচনের প্রার্থিতা নির্ভর করুক ব্যক্তির যোগ্যতা, জনপ্রিয়তা ও দলের প্রতি অবদানের ওপর, আত্মীয়তার ওপর নয়। দলের একাধিক নেতার সূত্র মতে, একই পরিবারের একাধিক সদস্য যোগ্য ও সক্রিয় হলেও মনোনয়ন বোর্ড তাদের মধ্যে থেকে একজনকে বেছে নেবে বলে এখন পর্যন্ত নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বাকিদের পরবর্তী সময়ে সংগঠনভিত্তিক দায়িত্বে রাখা হতে পারে। ফলে এটি কেবল নিয়ন্ত্রণমূলক সিদ্ধান্ত নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে দল পুনর্গঠনের এক কৌশলও।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির এই সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে রাজধানী ঢাকার রাজনীতিকে ঘিরে। সাভার-আমিনবাজারের জনপ্রিয় নেতা বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান বহু বছর ধরে ঢাকা-২ আসনে নির্বাচনী মাঠে সক্রিয়। ১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত টানা চারবার জয়লাভ করা ডাকসুর সাবেক এই ভিপি ২০১৮ সালের নির্বাচনে মামলার কারণে অংশ নিতে পারেননি। সে সময় তার ছেলে ইরফান ইবনে অমি মনোনয়ন পান। এবারও বাবা-ছেলে দুজনই মনোনয়ন প্রত্যাশী, তবে ‘এক পরিবার, এক প্রার্থী’ নীতির কারণে ধারণা করা হচ্ছে, আমানই পেতে যাচ্ছেন ঢাকা-২ আসনের দলীয় মনোনয়ন।

ঢাকা-৩ আসনে রয়েছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী বাবু গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। ২০০৮ ও ২০১৮ সালে তিনি এই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। গয়শ্বর চন্দ্র রায় কখনো সংসদ সদস্য পদে জয়লাভ না করলেও ১৯৯১ সালে বিএনপি আমলে টেকনোক্র্যাট কোটায় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছিলেন। তার পুত্রবধূ ও ঢাকা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নিপুণ রায় চৌধুরীও এলাকায় জনপ্রিয় মুখ। আওয়ামী লীগ আমলে তিনি দলীয় কার্যক্রম সচল রেখেছিলেন। তবে দলীয় নির্দেশ অনুযায়ী, এবার এই পরিবার থেকেও মনোনয়ন পাবেন মাত্র একজন।

নিপুণ রায়ের বাবা নিতাই রায় চৌধুরী, দলের ভাইস চেয়ারম্যান। তিনিও মাগুরা-২ আসনে প্রার্থী হতে চান। ২০০৮ ও ২০১৮ সালে এখান থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। এবারও নিতাই রায় চৌধুরী একই আসন থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী, তবে দলীয় নেতাকর্মীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, মেয়ে নিপুণের জন্যও তিনি মনোনয়ন চাইছেন। যদিও দলীয় সূত্র বলছে, দুজনের মধ্যে একজনকেই বেছে নেওয়া হবে।

বিএনপির বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক সালাহউদ্দিন আহমেদ ঢাকা-৫ আসনের (আগে-৪ আসন) মনোনয়ন প্রত্যাশী। এই আসনে সালাহউদ্দিন তিনবারের সংসদ সদস্য। ২০২০ সালের উপনির্বাচনেও তিনি এই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তার ছেলে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্যসচিব তানভীর আহমেদ রবিন ঢাকা-৪ আসনে মনোনয়ন চাইছেন। তরুণ এই নেতাকে দল থেকে ইতোমধ্যে কাজ করার জন্য সংকেত দেওয়া হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, রবিন ঢাকা-৪ আসন থেকে মনোনয়ন পেলে এবার দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করা হবে না সালাহউদ্দিন আহমেদের।

ঢাকার রাজনীতিতে আরেক প্রভাবশালী নেতা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। তিনি ছিলেন অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরশনের মেয়র এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী। বরাবরই তিনি ঢাকা-৮ আসনে নির্বাচন করে আসছেন। শুধু ২০০৮ সালে মামলার কারণে নির্বাচন করতে পারেননি। এবার তিনি ঢাকা-৮ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী হলেও ঢাকা-৯ আসনে তার স্ত্রী ও মহিলা দলের সভানেত্রী আফরোজা আব্বাসের জন্য মনোনয়ন চাইছেন। ২০১৫ সালের ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপারেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন আফরোজা আব্বাস। তবে দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মির্জা আব্বাসকেই শুধু মনোনয়ন দেওয়ার ব্যাপারে গ্রিন সিগনাল দিয়েছেন।

২০০৫ সালে নরসিংদী-১ আসন থেকে উপ-নির্বাচনে জয়লাভ করেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন। ডাকসুর সাবেক এই জিএসকে এবার একই আসন থেকে সবুজ সংকেত দেখানো হয়েছে। তবে তিনি তার স্ত্রী বিএনপির স্বনির্ভরবিষয়ক সম্পাদক শিরীন সুলতানার জন্যও একটি আসনে মনোনয়ন চাইছেন বলে জানা গেছে। শিরীন সুলতানা মহিলা দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। ঢাকার আন্দোলন-সংগ্রামে তার অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। জানা গেছে, তিনি ঢাকার যেকোনো একটি আসনে মনোনয়ন চাচ্ছেন। তবে দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে এ বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া দেওয়া হয়নি।

জাতীয় রাজনীতিতে এক সময় প্রভাবশালী নেতা হিসেবে সুখ্যাতি ছিল বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খানের। সাবেক এই তথ্য ও পরিকল্পনামন্ত্রী নরসিংদী-২ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী। মঈন খানের মনোনয়নও ইতোমধ্যে চূড়ান্ত বলে জানা গেছে। তবে তিনি তার মেয়ে আমেরিকা প্রবাসী মাহরীন খানের জন্যও নরসিংদীর একটি আসনে মনোনয়ন চাচ্ছেন বলে জানা গেছে দলীয় সূত্রে। মাহরীন আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট টেকনোলজিতে (এমআইটি) পিএইচডি করেছেন। ইতোমধ্যেই নরসিংদীতের মাহরীনের নামসংবলিত বিভিন্ন ফেস্টুন ও ব্যানারও দেখা গিয়েছে। দলীয় মহলে অনেকে একে ‘নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বের সিগন্যাল’ বলছেন, যদিও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো আসেনি।

টাঙ্গাইল জেলার রাজনীতির প্রভাবশালী নেতা এবং সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু। কারাগারে থাকা অবস্থায় ২০১৬ সালে তিনি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। প্রায় ১৭ বছর পর ২০২৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর কারামুক্তি লাভ করেন এই নেতা এবং বর্তমানে তিনি আবারও রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন। আসন্ন নির্বাচনে তিনি টাঙ্গাইল-২ আসনে মনোনয়ন চাইছেন বলে জানা গেছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে এই আসনে তার ছোট ভাই বিএনপির প্রচার সম্পাদক ও যুবদলের সাবেক সভাপতি সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু নির্বাচন করেন। ইতোমধ্যেই টুকুকে টাঙ্গাইল-৫ আসনে কাজ করার জন্য সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে পিন্টু আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

ফেনী-৩ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু। তবে তিনি তার ভাই আকবর হোসেনের জন্যও ফেনীর যে কোনো একটি আসনে মনোনয়ন চাচ্ছেন বলে জানা গেছে। আকবর হোসেন দাগনভূঞা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি ফেনী-৩ আসনে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। তবে দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আব্দুল আউয়াল মিন্টুকে ফেনী-৩ আসনে নির্বাচনী কাজ শুরু করার নির্দেশ দেওয়া হলেও তার ভাইয়ের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি।

বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বর্তমানে বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। ১৯৯১ সালে তিনি দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছেড়ে দেওয়া চট্টগ্রাম-৮ আসনে জয়ী হন এবং পরে একই আসনে একাধিকবার নির্বাচিত হন। ২০০১ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী। এবারও চট্টগ্রাম-১০ (হালিশহর) এবং চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনের যেকোনো একটিতে তার দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত। তবে অন্য আসনটিতে ছেলে ইস্রাফিল খসরুর জন্য মনোনয়ন চান বর্ষীয়ান এই নেতা। ইস্রাফিল খসরু বিএনপির গবেষণা সেলে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন এবং বর্তমানে বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির সদস্য। তবে দলের ঘনিষ্ঠ সূত্র মোতাবেক, আসন্ন নির্বাচনে শুধু আমীর খসরুকেই মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।

চট্টগ্রামের রাজনীতির আরেক প্রভাবশালী নেতা বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মীর মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক এই মেয়র ও মন্ত্রী ২০১৮ সালের নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী) আসনে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। কিন্তু এবার চট্টগ্রাম-৫ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী তার ছেলে মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন। নিজের সাংগঠনিক দক্ষতায় নগর ও জেলার রাজনীতিতে হেলালের প্রভাব তৈরি হয়েছে। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক এবং জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামসহ বিএনপির বিভিন্ন সংগঠনে যুক্ত আছেন। সেক্ষেত্রে মীর নাসির চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালি) আসনে মনোনয়ন চাইতে পারেন এমন আলোচনা আছে। তবে হেলাল সবুজ সংকেত পেলে আসন্ন নির্বাচনে মীর নাসির মনোনয়ন নাও পেতে পারেন বলে মনে করছেন দলের শীর্ষস্থানীয় কেউ কেউ।

এই মুহূর্তে বিএনপির অন্যতম জনপ্রিয় নেতা এবং মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত সালাহউদ্দিন আহমদ। গুমের শিকার হয়ে দীর্ঘ ৯ বছর ভারতের শিলংয়ে নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ২০২৪ সালের ১১ আগস্ট দেশে ফিরেন তিনি। ১৯৯৬ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে রাজনীতির মাঠে নামা এই নেতা কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনে টানা তিনটি নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। ২০০১ সালে চারদলীয় জোটের আমলে তিনি ছিলেন যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী। ২০০৯ সালে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের আমলে কারাগারে থাকায় এই আসনে নির্বাচন করেছিলেন তার স্ত্রী হাসিনা আহমেদ। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে হাসিনা আহমেদ কক্সবাজার-১ এবং সালাহউদ্দিন আহমদ কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনে মনোনয়ন চাচ্ছেন বলে আলোচনা আছে। তবে দলীয় সূত্রে জানা গেছে, কেবল সালাহউদ্দিন আহমদকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে সবুজ সংকেত দেখানো হয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপির এই সিদ্ধান্ত পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির বিরুদ্ধে একটি স্পষ্ট বার্তা। একইসঙ্গে এটি দলের অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নেতৃত্ব বাছাইয়ের নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. জিন্নাত আরা নাজনীন বাংলানিউজকে বলেন, ‘বিএনপির এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে দেশের রাজনীতিতে একটি নতুন ধারা তৈরি করতে পারে। দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশে পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি একটি বড় সমস্যা। যদি বিএনপি সফলভাবে এই নীতি কার্যকর করতে পারে, তবে তা অন্যান্য দলেও প্রভাব ফেলবে এবং একটি সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক হবে। ’

রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিএনপির এই ‘এক পরিবার, এক প্রার্থী’ নীতি কেবল মনোনয়ন নীতির পরিবর্তন নয়, বরং এটি হতে পারে দলের রাজনীতিতে একটি বড় সাংগঠনিক সংস্কার। একই পরিবারের একাধিক প্রার্থীর জায়গায় যদি তরুণ ও মাঠপর্যায়ের নেতাদের সুযোগ দেওয়া হয়, তবে এটি বিএনপির পুনর্গঠন প্রক্রিয়াকে আরও শক্তিশালী করবে বলেও মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।

এসবিডব্লিউ/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।