ঢাকা, সোমবার, ২ আষাঢ় ১৪৩২, ১৬ জুন ২০২৫, ১৯ জিলহজ ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা

গৌতম ঘোষ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭:৪৫, জুন ১৬, ২০২৫
ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা সংগৃহীত ছবি

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সরাসরি সামরিক সংঘাত শুরুর পর সারা বিশ্বে আতঙ্ক ও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। এই সংঘাতে মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানির বাজার ও বিশ্ব বাণিজ্য বিপর্যস্ত হতে পারে।

সংঘাত দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর সরাসরি এবং বহুমাত্রিক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্য বিশ্বের অন্যতম প্রধান জ্বালানি উৎপাদনকারী অঞ্চল। সেখানেই বিশ্বের বৃহত্তম তেলের মজুত। সৌদি আরব ও ইরাকের পর ইরান এই অঞ্চলের তৃতীয় বৃহত্তম তেল উৎপাদক। এই সংঘাত যদি দীর্ঘমেয়াদে চলে এবং হরমুজ প্রণালিতে জাহাজ চলাচল ব্যাহত হয় কিংবা ইরানের জ্বালানি অবকাঠামোতে হামলা হয় তাহলে বাংলাদেশে বিনিয়োগ, আমদানি ও রপ্তানিতে প্রভাব পড়বে, উৎপাদনে অনিশ্চয়তা দেখা দেবে, জাহাজ চলাচলে বাধা, রেমিট্যান্স প্রবাহে ধাক্কা, মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এখনই সরকার ও ব্যবসায়ীদের সমন্বিত প্রস্তুতি গ্রহণ করা জরুরি, যাতে সম্ভাব্য অভিঘাতের ঝুঁকি কমানো যায়। বিশ্ব সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলে বাংলাদেশের একটা আওয়াজ তুলতে হবে। বাংলাদেশ যেহেতু শান্তির পক্ষে তাই কূটনৈতিক উপায় হোক আর যে উপায়ে হোক এটার সমাধান করতে হবে। কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। এখন থেকেই আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রয়োজনে আমাদের আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের গবেষণা পরিচালক ড. মাহফুজ কবীর বাংলানিউজকে বলেন, ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। প্রথমত মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল আনতে যে হরমুজ প্রণালি ব্যবহার করা হয়, সেটা যদি ইরান বন্ধ করে দেয় তাহলে অনেক সমস্যা হবে। সমুদ্র পরিবহন খাত পুরো ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে। সময় মতো আমরা তেল, এলএনজি পাব কি না, সে ঝুঁকি তৈরি হবে, দাম বেড়ে যাবে। এতে বাংলাদেশের ম্যানুফ্যাচারিং খাত ও ট্রান্সপোর্ট খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে৷ একইসঙ্গে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে।

তিনি বলেন, জ্বালানির ওপর বেশিরভাগ শিল্প নির্ভরশীল৷ তাই জ্বালানি সংকট বাড়লে পরিবহন ব্যবস্থার ওপর ও তৈরি পোশাক শিল্পের উৎপাদন কমে যেতে পারে। মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব পড়তে পারে, প্রবৃদ্ধির ওপর চাপ পড়বে, কর্মসংস্থান, বিনিয়োগের ওপর প্রভাব পড়তে পারে। বাংলাদেশে যাতে সাধারণ মানুষের ওপর প্রভাব না পড়ে সেজন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাজ করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, বিশ্ব অর্থনীতি সংকুচিত হতে পারে। ইতোমধ্যে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেছে। দীর্ঘমেয়াদে যদি এই অস্থিরতা চলতে থাকে অদূর ভবিষ্যতে বিশ্ব অর্থনীতি সংকুচিত হতে পারে। একই সঙ্গে শ্রমশক্তি রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমে যেতে পারে। নতুন শ্রমশক্তি পাঠানোও হুমকির মুখে পড়বে। আমাদের শেরবাজারের অবস্থা আরও খারাপ। পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। তখন শেয়ার বাজারে প্রভাব পড়তে পারে।  

ড. মাহফুজ কবীর আরও বলেন, বিশ্ব অর্থনীতি ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এতে বিদেশি বিনিয়োগ, একইসঙ্গে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি কমে যেতে পারে। এভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে। ইতোমধ্যে মূল্যস্ফীতি উঁচু, বিনিয়োগ কম, কর্মসংস্থান কম এবং প্রবৃদ্ধিও কম। এ অবস্থায় যদি আরও চাপ তৈরি হয় তাহলে অর্থনীতিতে আর গতি আসবে না। সাধারণ মানুষের জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।

এর থেকে উত্তরণের দুটি উপায় আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটা হলো—বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, যাতে পরিস্থিতি যাই হোক জ্বালানি সরবরাহ স্বাভাবিক থাকে৷ নতুন রুটে জ্বালানি সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে হবে, দাম যাতে না বাড়ে সে ব্যবস্থা করতে হবে। সেজন্য কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিশ্ব সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলে বাংলাদেশের একটা আওয়াজ তুলতে হবে। বাংলাদেশ যেহেতু শান্তির পক্ষে তাই কূটনৈতিক উপায় হোক আর যে উপায়ে হোক এটা সমাধান করতে হবে। যুদ্ধ আসলে কারো জন্য ভালো কিছু বয়ে আনে না। সুতরাং যে সমস্যাগুলো আছে সেগুলো আলোচনা করে সমাধান করা যায়, সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। জ্বালানি কিনে মজুত করতে হবে, যাতে এ ধরনের যুদ্ধের জন্য আমরা আমাদের জ্বালানির সরবরাহে বিঘ্ন হতে না দেই৷

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, বাংলাদেশ একটি জ্বালানিনির্ভর দেশ এবং আমদানি করা জ্বালানি—বিশেষ করে এলএনজি ও পরিশোধিত তেলের ওপর আমাদের নির্ভরতা বেশি। ফলে তেলের দাম বেড়ে গেলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচও বাড়বে, যার প্রভাব শিল্প, কৃষি, পরিবহন ও ভোক্তা পর্যায়ে ব্যাপকভাবে পড়বে। ফলে দ্রব্যমূল্য বাড়বে এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা চাপে পড়বে। জ্বালানি আমদানির ব্যয় বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ পড়বে, টাকার মান দুর্বল হতে পারে, যার ফলে আমদানি ব্যয় বাড়বে এবং মুদ্রাস্ফীতি আরও ত্বরান্বিত হবে।

তিনি বলেন, হরমুজ প্রণালি বন্ধ থাকলে আমদানি-রপ্তানিতে বিলম্ব ও খরচ বাড়বে। তৈরি পোশাক খাত, যেটি বাংলাদেশের রপ্তানির প্রধান উৎস, সেখানে ক্রয়াদেশ বাতিলের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।

‘মধ্যপ্রাচ্যে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করেন। যুদ্ধের কারণে তাদের কর্মসংস্থান অনিশ্চয়তায় পড়তে পারে, রেমিট্যান্স কমে যেতে পারে। এজন্য সরকারকে এখনই বিকল্প জ্বালানির উৎস খুঁজতে হবে। এলএনজি সরবরাহে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ ও রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ’

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ইসরায়েল-ইরানের যে পাল্টাপাল্টি আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ও বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বিরাট একটা আশঙ্কার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে কতটুকৃ নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সেটা নির্ভর করবে এই যুদ্ধের স্থায়িত্বের ওপর। কিন্তু স্বল্পমেয়াদেও আমরা দেখতে পাচ্ছি ফুয়েলের দাম বেড়ে গেছে ১০ শতাংশের মতো। ৬৪ থেকে ৬৬ ডলারের মতো হয়ে গেছে। অনুমান করা হচ্ছে এটা চলতে থাকলে ১০০ ডলার হতে পারে। তেল যদি ১০০ ডলারে যায় তাহলে নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক কিছুর দাম বেড়ে যাবে।

তিনি বলেন, আমরা যেহেতু তেল আমদানির ওপর নির্ভরশীল। আমরা দেখেছি কীভাবে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে তেলের দাম বাড়ার ফলে আমাদের রিজার্ভ ও ফরেন এক্সচেঞ্জ রেটে চাপ পড়েছে। এটা আমাদের জন্য আশঙ্কার ব্যাপার। এটা ছাড়াও যদি হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে এই প্রণালি দিয়ে যে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ট্রেড হয়, সেই জাহাজগুলো আফ্রিকা হয়ে ঘুরে আসবে এতে সময় বেশি লাগবে ও খরচ বেশি হবে। এতে আমাদের আমদানি-রপ্তানি করা পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। একইসঙ্গে আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এসবই নির্ভর করবে সংঘাতের স্থায়িত্বের ওপরে।

অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, মধ্যপ্রাচ্য যদি এই সংঘাতের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে তাহলে আমাদের রেমিট্যান্সের ওপরে বড় প্রভাব পড়বে। একইসঙ্গে কর্মসংস্থান, মূল্যস্ফীতিতো আছেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে পণ্যের চাহিদা হ্রাস পেতে পারে, যার সুস্পষ্ট প্রভাব বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এসব কিছুতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, তবে সেটা এই সংঘাত কতটা স্থায়ী হয় সেটার ওপর নির্ভর করবে।

তিনি বলেন, সরকারকে আগে থেকেই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। তেলের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির সুবিধা নিতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে ভালো সম্পর্কের ভিত্তিতে কী করা যায়, সেটা দেখতে হবে। এখন থেকেই আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রয়োজনে আমাদের আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে।

এ বিষয়ে খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ, পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ও ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ড. আবু আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, ইসরায়েল-ইরান সংঘাতে বাংলাদেশের তেলের দাম বেড়ে যাবে। শুধু এটা বাংলাদেশের জন্য না আন্তর্জাতিক অনেক দেশের জন্য ক্ষতিকর। বাংলাদেশের শেয়ার বাজার ওঠে না, এর একটা কারণ হলো যুদ্ধ। এই সংঘাত পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে প্রভাবিত করবে।

তিনি বলেন, ইরান যদি হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেয় তাহলে তেলের দাম অনেক বেড়ে যাবে। যার প্রভাবে উৎপাদন থেকে শুরু করে আমদানি রপ্তানি বাজারেও পড়বে। কর্মসংস্থান কম হবে, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। সরকারকে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। টাকা থাকলে আমাদানি করে মজুদ করতে হবে।

জিসিজি/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।