ঢাকা: বাংলাদেশিদের জন্য ধীরে ধীরে সীমিত হয়ে পড়ছে পর্যটক ভিসা। আগে যেসব দেশে খুব সহজেই পর্যটক ভিসা পাওয়া যেত, এখন আর তা হচ্ছে না।
কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক অনিয়মের কারণে ভিসা জটিলতা তৈরি হয়েছে। আরও একটি বড় কারণ হচ্ছে ভুয়া কাগজ দিয়ে মানব পাচার।
জানা গেছে, অনেকেই পর্যটক ভিসা নিয়ে বিদেশে গিয়ে আর ফেরেন না। এছাড়া বিভিন্ন দেশে পর্যটক ভিসা দিয়ে দালাল চক্র লোক পাঠিয়ে থাকে। এতে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। এ কারণে দেশগুলো ভিসা নীতিতে পরিবর্তন এনেছে। বাংলাদেশিদের জন্য তারা ভিসায় কড়াকড়ি আরোপ করেছে। অনেক দেশ অন অ্যারাইভাল ভিসাও বন্ধ করে দিয়েছে।
বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, ইতালি, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশের ভিসা সুবিধা কমেছে। এসব দেশে ভিসা পেতে নানা জটিলতাও তৈরি হয়েছে।
থাইল্যান্ড ভিসায় জটিলতা:
বাংলাদেশের নাগরিকদের ভ্রমণে পছন্দের তালিকায় যেসব দেশ রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম থাইল্যান্ড। তবে থাইল্যান্ডের ভিসা পেতে এখন দীর্ঘ অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। চলতি বছর ২ জানুয়ারি থেকে থাইল্যান্ড বাংলাদেশিদের জন্য ই-ভিসা চালু করেছে। ই-ভিসা চালু করার ফলে প্রথমে সবাই ভেবেছিলেন খুব সহজেই থাইল্যান্ডের ভিসা পাওয়া যাবে। কিন্তু দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হচ্ছে। থাই ভিসা আবেদনকারীরা বলছেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভিসা পেতে ৪০-৫০ দিনও লেগে যাচ্ছে। আবার ঢাকার থাইল্যান্ড দূতাবাস নির্দেশনা দিয়েছে, ভিসা পেতে কমপক্ষে ৪৫ দিন আগে আবেদন করতে হবে।
ইন্দোনেশিয়ার অন অ্যারাইভাল ভিসা বন্ধ:
বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণে এক সময় চালু হয়েছিলো অন অ্যারাইভাল ভিসা। বিমানের টিকিট কেটেই বাংলাদেশিরা চলে যেতে পারতেন ইন্দোনেশিয়া। তবে সে ব্যবস্থা আর চালু থাকেনি। মানব পাচারকারীরা অস্ট্রেলিয়া যেতে ইন্দোনেশিয়াকে মানব পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে। ইন্দোনেশিয়া সরকার বিষয়টি জানতে পেরে বাংলাদেশিদের জন্য তিন বছর আগে অন অ্যারাইভাল ভিসা সুবিধা বন্ধ করে দেয়। তারপর দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অন অ্যারাইভাল ভিসা চালুর জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হলেও কাজ হয়নি। বাংলাদেশিদের জন্য অন অ্যারাইভাল ভিসা দেশটি আর চালু করেনি। সর্বশেষ গত ১ জুন তিন দিনের সফরে ঢাকায় এসেছিলেন ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্র উপমন্ত্রী আরামানথা ক্রিস্টিয়ান নাসির। তিনি বাংলাদেশিদের জন্য অন অ্যারাইভাল ভিসা চালুর আশ্বাস দিয়েছেন।
ভারতের পর্যটক ভিসা বন্ধ:
বাংলাদেশের অনেকেই ভ্রমণের জন্য প্রতিবেশী দেশ ভারতকে বেছে নেন। তুলনামূলক কম খরচে ভারতে ভ্রমণ করা যায় বলে অনেকেই ভ্রমণের ক্ষেত্রে দেশটিকে প্রাধান্য দেন। তবে ৫ আগস্ট বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ভারতে পর্যটক ভিসা গত ৯ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে। সে কারণে এখন আর কেউ ভারত ভ্রমণ করতে পারছেন না। তবে ভারতে ভ্রমণ ভিসা বন্ধ থাকলেও জরুরি চিকিৎসা ও শিক্ষার্থীদের জন্য ভিসা চালু রেখেছে দেশটি।
আমিরাতের ভিসা সীমিত:
বাংলাদেশিদের জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভিজিট ভিসা দীর্ঘ আট মাস ধরে বন্ধ ছিলো। তবে এখন আবার সীমিতভাবে বাংলাদেশিদের জন্য ভিজিট ভিসা চালু করেছে দেশটি। বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউএই রাষ্ট্রদূত আব্দুল্লাহ আলি আল-হামুদি সম্প্রতি জানিয়েছেন, ঢাকার আরব আমিরাত দূতাবাস বর্তমানে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৫০টি ভিজিট ভিসা ইস্যু করছে। আগামী দিনে ধীরে ধীরে ভিসার সংখ্যা বাড়বে।
অন্যান্য দেশের ভিসা নিয়ে জটিলতা:
বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য আরো বেশ কয়েকটি দেশের ভিসা পেতে জটিলতা তৈরি হয়েছে। গত তিন মাস ধরে ভিয়েতনামের ভ্রমণ ভিসা পাচ্ছেন না বাংলাদেশিরা। তবে অন্যান্য ক্যাটাগরিতে ভিসা পাওয়া যাচ্ছে। এদিকে সৌদি আরবে বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশের জন্য ব্লক ওয়ার্ক ভিসা ওমরাহ, পারিবারিক ভিজিট এবং ব্যবসা সংক্রান্ত ভিসায় সাময়িক স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়েছে। আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত এই বিধিনিষেধ কার্যকর থাকবে। এরপর এই বিধিনিষেধ উঠে যেতে পারে। এছাড়া ইতালির কর্ম ভিসা পেতেও জটিলতা তৈরি হয়েছে। দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেও ইতালির কর্ম ভিসা মিলছে না। এ নিয়ে বাংলাদেশ ও ইতালির মধ্যে বেশ কয়েক দফা আলোচনাও হয়েছে। ইতালির ভিসা পেতে জাল কাগজপত্র দেওয়া হয় বলে ভিসা প্রার্থীদের কাগজপত্র যাচাই বাছাইয়ে সময় লাগছে।
ভিসা বন্ধ নিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা যা বলছেন:
বাংলাদেশিদের জন্য বিভিন্ন দেশের ভিসা বন্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ভিসা নিয়ে বিভিন্ন দেশ যে সিদ্ধান্তগুলো আমাদের বিরুদ্ধে নেয়, তার অনেকখানির জন্য আমরা দায়ী। আমাদের দেশের মানুষ এবং ব্যবসায়ীরা দায়ী, বিশেষ করে যারা মানুষ পাঠান।
তিনি বলেন, আমার মনে হয়, আমাদের ঘর সামলাতে হবে। অনেকের হয়তো আমার কথা পছন্দ হবে না। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, এই একটি ক্ষেত্রে আমাদের অনেক কিছু করার আছে। যেভাবে নিয়ম মেনে-না মেনে লোকজন যাচ্ছে তাতে সমস্যা তৈরি হচ্ছে।
ভারতের ভিসা বন্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেছেন, ভারত যে কোনো কারণে হোক সেটা বন্ধ রেখেছে। ভিসা দেওয়া তাদের সার্বভৌম অধিকার। কোনো দেশ কাউকে যদি ভিসা না দেয়, এটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না। এটা তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত।
ইতালির ভিসার বিষয়ে জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন জানান, ইতালির বিষয়টি নিয়ে আমরা তাদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করছি। কিছু ত্রুটি আমাদেরও আছে, সেটা স্বীকার করা উচিত। প্রায় ৬০ হাজার মানুষের কাগজপত্র জমা পড়েছে, যার অনেকগুলোই যথাযথ নয়। ইতালিয়ান কর্তৃপক্ষ সেগুলো চিহ্নিত করেছে।
টিআর/এজে