ঢাকা, বুধবার, ৩০ আশ্বিন ১৪৩২, ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ২২ রবিউস সানি ১৪৪৭

মুক্তমত

বিবিসিতে তারেক রহমানের সাক্ষাৎকার: দূরদৃষ্টির অনন্য দৃষ্টান্ত

ব্রি. জে. মো. জাহেদুর রহমান (অব.)। সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:৫২, অক্টোবর ১৫, ২০২৫
বিবিসিতে তারেক রহমানের সাক্ষাৎকার: দূরদৃষ্টির অনন্য দৃষ্টান্ত ব্রি. জে. মো. জাহেদুর রহমান (অব.)।

প্রায় দুই দশক পর তারেক রহমান গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিলেন। যদিও তিনি বিভিন্ন সময়ে দল ও কর্মীদের সঙ্গে অন্তর্জালের মাধ্যমে যোগাযোগ রেখেছিলেন, সাধারণ জনগণের সঙ্গে তাঁর সরাসরি যোগাযোগ দীর্ঘদিন অনুপস্থিত ছিল।

২০০৭-০৮ সালের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তাঁকে বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। তাঁর অনুপস্থিতিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার তাঁর বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা করে এবং আদালত অনুপস্থিত অবস্থায়ই সাজা ঘোষণা করে।

মিডিয়া থেকেও তাঁকে ব্ল্যাক আউট করে রাখা হয়েছিল। ফলে জনমনে কৌতূহল, সংশয় ও প্রশ্ন জমেছিল আট হাজার কিলোমিটার দূর থেকে যিনি গত ১৭ বছর ধরে বিএনপির গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিচালনা করছেন, তিনি আসলে কেমন মানুষ?

বিবিসিকে দেওয়া তাঁর সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকার সাধারণ জনগণ, বুদ্ধিজীবী মহল ও বিএনপিকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। যদিও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা কিছুটা সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। কারণ তাঁরা জানেন, তারেক রহমান শুধু বিএনপির ক্ষতিগ্রস্ত ভাবমূর্তি পুনর্গঠন করতে পারবেন না, বরং এমন এক রাজনৈতিক ঢেউ তুলতে পারেন, যা প্রতিদ্বন্দ্বীরা রুখে দাঁড়াতে পারবে না।

বিবিসিকে কী বলেছেন তিনি, যা মানুষের মনে গভীর ছাপ ফেলেছে? জনগণের উদ্দেশে, বিশেষ করে বিএনপিকর্মীদের প্রতি তিনি কী বার্তা দিয়েছেন? বিবিসির সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনায় তিনি কেমন বাংলাদেশের ছবি এঁকেছেন?

সাক্ষাৎকারের শুরুতেই গণমাধ্যমে তাঁর দীর্ঘ অনুপস্থিতি নিয়ে করা প্রশ্নের উত্তরে তারেক রহমান মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি নিজের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন এবং সূক্ষ্মভাবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় তাদের অঙ্গীকারের কথাও স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি বিএনপি শাসনামলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা স্মরণ করিয়ে আশ্বাস দেন যে ভবিষ্যতেও সেই স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন থাকবে। বিএনপি মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তিনি বলেন, যেসব আইন ও অধ্যাদেশ স্বাধীনতা সীমিত করে, আলোচনা ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে সেগুলো সংস্কার করা হবে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচারের বিরুদ্ধেও তিনি সতর্ক করেন এবং গণমাধ্যমকে অনুরোধ করেন যেন কোনো প্রকার প্রপাগান্ডা সংবাদ হিসেবে প্রচার না পায়।

জুলাই বিপ্লব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি ছিল জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ফল এবং বিগত দশকের একনায়কতন্ত্রবিরোধী সংগ্রামের পরিণতি। তিনি শহীদ ও আহতদের পরিবারের পাশে সহমর্মিতা ও বিনয়ের সঙ্গে দাঁড়ানোর আহবান জানান এবং জুলাই অভ্যুত্থানে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অবদানকে স্বীকৃতি দেন।

নির্বাচন ও গণতন্ত্র প্রসঙ্গে তারেক রহমান স্পষ্টভাবে বলেন, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব জনগণের। জনগণের হাতে সেই ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার একমাত্র উপায় হলো নির্বাচন।

তিনি রাষ্ট্র পুনর্গঠনের লক্ষ্যে অংশগ্রহণমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির ওপর জোর দেন। সংবিধানের কাঠামোর মধ্যে থেকে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর জোট গঠন ও রাজনীতি করার স্বাধীনতাকে তিনি স্বাগত জানান। প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের মনোভাবকেও তিনি গণতন্ত্রের অপরিহার্য উপাদান হিসেবে উল্লেখ করেন এবং পুনরায় বলেন, বিএনপি বহুদলীয় রাজনীতি ও জবাবদিহিতায় বিশ্বাসী। প্রার্থী নির্বাচনের মানদণ্ড নিয়ে তিনি বলেন, মনোনয়নপ্রত্যাশীকে শুধু দলের নয়, পুরো নির্বাচনী এলাকার মানুষের সমর্থন পেতে হবে। তাঁর জনগণের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ থাকতে হবে এবং এলাকার সমস্যাগুলো সমাধানে সক্ষম হতে হবে। বিএনপি বিজয়ী হলে তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন কি না এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বিনয় ও প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। তিনি বলেন, সিদ্ধান্ত জনগণ ও দলের ওপর নির্ভরশীল। তিনি পারিবারিক উত্তরাধিকারের রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, নেতৃত্বের জন্য প্রয়োজন ব্যক্তিগত যোগ্যতা, ত্যাগ ও রাজনৈতিক কষ্ট সহ্য করার মানসিকতা।

দুর্নীতি, সুশাসন ও আইনের শাসন বিষয়ে তাঁর বক্তব্য ছিল সুস্পষ্ট। তিনি বলেন, দুর্নীতি এখন সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। আগের বিএনপি সরকারের সময় দুর্নীতি দমনে পর্যাপ্ত অগ্রগতি না হওয়ার কথা স্বীকার করে তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, সুযোগ পেলে ধীরে ধীরে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা হবে। তিনি জানান, দলের ভেতরে চাঁদাবাজি বা অসদাচরণের অভিযোগ কঠোরভাবে মোকাবেলা করা হয়েছে এবং বিএনপিকর্মীদের বিরুদ্ধে চালানো মিথ্যা প্রচারণার প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি আশ্বাস দেন, দলের কোনো সদস্য অনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই সঙ্গে তিনি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে আইন অনুযায়ী নিরপেক্ষভাবে কাজ করার আহবান জানান এবং বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে দায়িত্ব পালন করবে।

তিনি আওয়ামী লীগের অনুসারীদের দ্বারা সংঘটিত হত্যাকাণ্ড, গুম, নির্যাতন ও দুর্নীতিকে তীব্র নিন্দা জানান এবং বলেন, এসব অপরাধের দায়ীদের বিচার হতে হবে। এমনকি আওয়ামী লীগ দল হিসেবেও যদি কোনো অপরাধে জড়িত থাকে, সেটিও আইনের আওতায় আসা উচিত। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনি বলেন, জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে তারা কি এমন একটি দলকে সমর্থন করবে, যে দল হত্যা, গুম, দুর্নীতি ও অর্থপাচারে লিপ্ত।

তিনি জোর দিয়ে বলেন, বিএনপির মৌলিক নীতি হলো ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’ বা ‘বাংলাদেশ সবার আগে’। কূটনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি এই মূলনীতির ওপর ভিত্তি করেই পরিচালিত হবে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ন্যায় ও সমতার ভিত্তিতে গড়ে তোলা হবে। তিনি আশ্বাস দেন, জনগণের অনুভূতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করা হবে।

সংস্কার প্রসঙ্গে তিনি মনে করিয়ে দেন যে গণতন্ত্রের মর্মবস্তু হলো ভিন্নমতকে গ্রহণ করা। তিনি আইনি ও সাংবিধানিক পথ অনুসরণ করে জুলাই চার্টারে অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন এবং প্রতিশ্রুতি দেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলে ঐকমত্যে পৌঁছানো বিষয়গুলো বাস্তবায়নের পাশাপাশি ঘোষিত ‘৩১ দফা’ রাজনৈতিক অঙ্গীকারও বাস্তবায়ন করবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সম্পর্কটি রাজনৈতিক হলেও বন্ধুত্বপূর্ণ। তিনি সরকারের প্রচেষ্টা স্বীকার করেন, তবে স্বভাবগত সীমাবদ্ধতার কথাও তুলে ধরেন। তিনি ১/১১ সরকারের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, সেটি ছিল অসৎ উদ্দেশ্যসম্পন্ন একটি সরকার, যার উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক ব্যবস্থা ধ্বংস করা।

সারসংক্ষেপে, তারেক রহমান বাংলাদেশের মানুষ ও গণতন্ত্রের জন্য নতুন এক আশার আলো দেখিয়েছেন। তিনি এমন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছেন, যেখানে থাকবে অংশগ্রহণমূলক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জবাবদিহিমূলক গণতন্ত্র; মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং দুর্নীতিমুক্ত সমাজব্যবস্থা। একজন নাগরিক হিসেবে আমি এই স্বপ্নে বিশ্বাস রাখতে চাই।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা; সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, ফাউন্ডেশন ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।