ঢাকা, সোমবার, ২৭ আশ্বিন ১৪৩২, ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ২০ রবিউস সানি ১৪৪৭

মুক্তমত

ট্রাম্প না পেলেও শান্তির নোবেল ‘আমেরিকার স্বার্থে’

হুসাইন আজাদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯:৩৫, অক্টোবর ১২, ২০২৫
ট্রাম্প না পেলেও শান্তির নোবেল ‘আমেরিকার স্বার্থে’

‘মাতবর’ মানসিকতার আমেরিকাকে এখনো না গুনে চলা লাতিন অঞ্চলের কয়েকটি দেশের একটি ভেনেজুয়েলা। বিপ্লবী হুগো চাভেজ জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন থেকে শুরু করে সর্বত্র বুক চিতিয়ে যেমন আমেরিকার যুদ্ধনীতি ও আগ্রাসনবাদী চিন্তাধারার সমালোচনা করেছেন, তেমনি জায়নবাদের গুপ্ত-প্রকাশ্য সব লবির যাবতীয় ঝুঁকি মাথায় নিয়েই কণ্ঠ সোচ্চার রেখেছিলেন ফিলিস্তিনিদের মুক্তির পক্ষে।

চাভেজ ফিলিস্তিনিদের মুক্তি দেখে যেতে পারেননি। ২০১৩ সালে তার প্রয়াণের পর আমেরিকা ও তার মিত্রদের নানা নিষেধাজ্ঞায় ভঙ্গুর হয়ে পড়া অর্থনীতির দেশটির নেতৃত্বের আসনে বসেন নিকোলাস মাদুরো।

এই মাদুরোও তার পূর্বসূরি নন্দিত নেতার রাজনৈতিক আদর্শেরই মশাল জেলে রেখেছেন। আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা, হুমকি-ধমকিকে যেমন থোড়াই কেয়ার করছেন, তেমনি জারি রেখেছেন চিরনিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের মুক্তির স্লোগান। এমনকি দখলদার ইসরায়েলি বাহিনীর আগ্রাসনেরও কঠোর সমালোচনা করতে দেখা গেছে তাকে। সবশেষ দুই বছরেও গাজায় গণহত্যার নিন্দা জানিয়ে কয়েকবার বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েছেন মাদুরো।

জায়নবাদবিরোধী এই মাদুরো কয়েকবার হত্যাচেষ্টার শিকার হয়েছেন। এতে জড়িত সন্দেহে কয়েকবার আমেরিকানসহ কিছু বিদেশি নাগরিক—যাদের মধ্যে সামরিক অফিসার ছিলেন—আটক হয়েছেন। ফলে হত্যাচেষ্টায় কোন শক্তি জড়িত, সেটা সবার কাছেই স্পষ্ট। এভাবে তাকে উৎখাতের চেষ্টার পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবেও দুর্বল করার চেষ্টা করা হয়েছে এবং হচ্ছে। একদিকে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ভঙ্গুর অর্থনীতিকে আরও ভঙ্গুর করে দেশটিতে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা হয়েছে, অন্যদিকে ‘অনুগত’ ভৃত্যদের মাঠে নামিয়ে তাদের নায়ক/নায়িকা বানানোর যাবতীয় প্রচারণা-চেষ্টা চলছে সমানতালে।

এমনই এক ‘সুবিধাভোগী নায়িকা’ মারিয়া কোরিনা মাচাদো। ভেনেজুয়েলার এই ‘আমেরিকান নন্দিত’ নায়িকাকে এবার নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, কী যোগ্যতায় শান্তির নোবেল পাওয়ার ভাগ্য হলো তার? নোবেল কমিটির ভাষ্যে, ‘শান্তির সাহসী ও নিবেদিতপ্রাণ যোদ্ধা এমন এক নারীর হাতে ২০২৫ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার যাচ্ছে, যিনি গভীর হতে থাকা অন্ধকারের মাঝেও গণতন্ত্রের শিখা জ্বালিয়ে যাচ্ছেন। ’

মাতবরদের সুনজরে এবং গোপনে দেওয়া নিরাপত্তা ব্যবস্থায় রাস্তায় মিছিল-সমাবেশ করে মাদুরোকে ধরাশায়ী করার চেষ্টা চালিয়ে তিনি যদি নোবেল শান্তি পুরস্কার পেতে পারেন, তবে এমন বিরোধী রাজনীতিক তো প্রায় সব দেশেই পাওয়া যাবে, যারা সরকারে থাকা পক্ষকে মনে করেন ‘গণতন্ত্র হরণকারী’, আর নিজে ‘গণতন্ত্রের উদ্ধারকর্তা বা কর্ত্রী’।

আসলে নোবেল কমিটি যে যোগ্যতার কথা বলেনি, সেটা এরই মধ্যে সবাই জানে। এই মাচাদো হলেন তিনি, যিনি প্রেসিডেন্ট মাদুরোর ইমেজের ক্ষতি করতে না পেরে নির্লজ্জ কায়দায় বহির্শক্তির হস্তক্ষেপ কামনা করেছিলেন। মাদুরোর শাসনকে চ্যুত করার জন্য ২০১৮ সালে আর্জেন্টিনা ও ইসরায়েলেকে ‘শক্তি খাটাতে’ চিঠি দিয়েছিলেন।

এই মাচাদো হলেন তিনি, যিনি ২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসনের প্রাক্কালে নেতানিয়াহুর প্রতি নগ্ন সমর্থন জানিয়েছিলেন। এই মাচাদো হলেন তিনি, যিনি বলেছিলেন, ‘ইসরায়েল হলো মুক্তির প্রকৃত বন্ধু’। এই মাচাদো হলেন তিনি, যিনি কোনো সময় ভেনেজুয়েলার ক্ষমতায় এলে তার দেশের দূতাবাস তেলআবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তরের অঙ্গীকার করেছেন, যাতে ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানীও ইসরায়েলের দখলে চলে যায়, ধূলিস্যাৎ হয় ফিলিস্তিনিদের আজীবনের লালিত স্বপ্ন।

নরওয়ের আইনপ্রণেতা বেয়র্নার মক্সনেসের মতে, এই মাচাদো হলেন তিনি, যিনি ২০২০ সালে নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টির সঙ্গে একটি সহযোগিতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন, যে লিকুদ পার্টিই সংসদে গাজায় গণহত্যার অনুমোদন দিয়েছে।

নোবেল শান্তি পুরস্কার ঘোষণার কিছু দিন আগে থেকে এই সম্মাননাটি পাওয়ার যাবতীয় আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। পরিস্থিতি এমন জায়গায় দাঁড়ায়, দ্য গার্ডিয়ানের মতো প্রভাবশালী পশ্চিমা গণমাধ্যমেও তার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার শঙ্কা জানিয়ে বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন দেখা যায়। বলা হয়, ট্রাম্পকে নোবেল পুরস্কার না দেওয়া হলে তিনি কী পদক্ষেপ নেবেন, দুই দেশের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে শঙ্কিত নরওয়ের নেতৃত্ব। তারা বাড়তি শুল্ক, ন্যাটোতে বাড়তি চাঁদা, এমনকি নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি নিয়েও চিন্তিত হয়ে পড়ছিলেন।

অথচ বিজয়ী হিসেবে মাচাদোর নাম ঘোষণার পর সেই ট্রাম্প তেমন কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখালেন না। কেন? অনেকের মতে, আমেরিকা আর তার ‘ভ্রাতৃরাষ্ট্র’ ইসরায়েলের ‘একান্ত অনুগত’ সমর্থক মাচাদোই পুরস্কারটি পেয়েছেন বলে ট্রাম্পকে বোঝাতে পেরেছে হোয়াইট হাউসের নীতি-নির্ধারক মহল। এই বুঝটা আরও সহজ করে দিয়েছেন মাচাদোই, তিনি নোবেল পুরস্কারটি সেই ট্রাম্পকেই উৎসর্গ করেছেন, যিনি গাজায় আগ্রাসন বন্ধে মধ্যস্থতার নাটক করলেও সবার চোখের সামনে ইসরায়েলকে গণহত্যার রসদ যুগিয়ে গেছেন। যিনি এর আগে হাজার হাজার শিশু লাশ হওয়ার প্রেক্ষাপটে গাজায় গণহত্যা বন্ধে জাতিসংঘে প্রস্তাব উঠলেও ভেটো দিয়েছেন। যার ইচ্ছের কাছে আটক আছে ভূমিপুত্র ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্র পাওয়ার অধিকার।

সেই ট্রাম্পের অনুগত, তার ‘নেতানিয়াহু-তোষণ’ নীতির উগ্র সমর্থক মাচাদো পুরস্কার পেলে প্রেসিডেন্ট আর নাখোশ হবেন কেন? তারই তো ঘরে এলো!

হে শান্তির ফেরিওয়ালা নোবেল কমিটি, তোমাদের হৃদয়ের শান্তি হোক। বিশ্ব দেখলো, গণহত্যার সমর্থকও তাহলে পেতে পারে ‘শান্তির নোবেল’!
 


হুসাইন আজাদ: কবি, লেখক ও সাংবাদিক

এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।