ঢাকা, শনিবার, ১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ৩১ মে ২০২৫, ০৩ জিলহজ ১৪৪৬

মুক্তমত

জিয়ার মৃত্যু, খালেদার প্রশ্ন, ইউনূসের নির্বাচন

মন্‌জুরুল ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১:৩১, মে ২৯, ২০২৫
জিয়ার মৃত্যু, খালেদার প্রশ্ন, ইউনূসের নির্বাচন মন্‌জুরুল ইসলাম

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি আসার ১৩ দিন পর জিয়া মারা গেছেন কেন? আপনি বোরকা পরে বর্ডার পাড়ি দিচ্ছিলেন কেন? তবে কি আপনার মনে কোনো ভয় ছিল?’ ২০১৪ সালের ২২ জুন বেগম খালেদা জিয়া জয়পুরহাটের রামদেও সরকারি উচ্চবিদ্যালয় মাঠে জনসভায় এ প্রশ্ন করেছিলেন। আগামীকাল শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকী।

প্রশ্ন হচ্ছে-প্রেসিডেন্ট জিয়ার কেন এমন নৃশংস অকালমৃত্যু হলো? দেশিবিদেশি কোন পক্ষের শক্ত প্রতিপক্ষ ছিলেন তিনি? তাঁকে হত্যার পেছনে কার অদৃশ্য হাত ছিল? অনেক দিন ধরে এ প্রশ্নগুলো নানান মহলে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু পরিষ্কার হচ্ছে না। বেগম খালেদা জিয়া একটি শক্ত প্রশ্ন করেছেন। কিন্তু বিস্ময়কর যে, জিয়া ও খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক দল বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে এ প্রশ্নটি এখনো কোনো ধরনের বোধোদয় তৈরি করতে পারেনি।

অনেক বছর পর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি এবার জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী স্বাধীনভাবে পালন করবে। চন্দ্রিমা উদ্যানের সমাধিটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য বিগত সরকার কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েছিল। বেশ কয়েকবার জিয়ার সমাধিতে যাওয়ার বেইলি ব্রিজটি তুলে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। সমাধিতে জিয়ার লাশ আছে কি নেই, সে প্রশ্নও নিষ্ঠুরভাবে তুলেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী, পতিত সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। বিএনপির ওপর গত ১৬ বছর ভয়াবহ ধকল গেছে। জাতীয়তাবাদী শক্তির একমাত্র ঠিকানা বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া মৃত্যুর মুখ থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছেন। সবকিছু ঠিক থাকলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও খুব শিগগিরই দেশে ফিরবেন। সংস্কার, নির্বাচনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বর্তমান সময়টা বিএনপির জন্য যথেষ্ট অনুকূল নয়। তার পরও জয়পুরহাটের রামদেও স্কুল মাঠে বেগম জিয়া যে প্রশ্নটি করেছিলেন, সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য দলের নেতা-কর্মীদের এখনই সোচ্চার হওয়ার শ্রেষ্ঠ সময়। শেখ মুজিব হত্যার বিচার যদি ৩৫ বছর পর হতে পারে তাহলে জিয়া হত্যার নেপথ্যের কুশীলবদের নিয়ে যে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, তার উত্তর খুঁজে পাওয়াও সম্ভব হবে।

একজন মানুষ যত বড় মাপের বা যত ছোটই হোন না কেন, তার মৃত্যু সত্যি অপূরণীয় ক্ষতি। মানুষের শূন্যতা কোনো কিছুতেই পূরণ করা সম্ভব নয়। বিখ্যাত মানুষের মৃত্যুর পর তার শোকবাণীতে ‘অপূরণীয় ক্ষতি’ শব্দ দুটি লেখা হয়ে থাকে প্রথাগতভাবে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর কথা চিন্তা করলে অনুমান করা যায়, তাঁর শূন্যতায় দেশের কত ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে। তাঁর যদি স্বাভাবিক মৃত্যু হতো, তিনি যদি তাঁর স্বপগুলো পূরণ করতে পারতেন, বহুদলীয় গণতন্ত্র সুসংহত করতে পারতেন, ১৯ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারতেন, সার্ককে যদি শক্তিশালী করতে পারতেন, তাহলে বাংলাদেশকে হয়তো আজকের বাস্তবতার মুখোমুুখি হতে হতো না। দেশে বহুদলীয় টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে হয়তো গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও নির্বাচনের জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে হায়ার করতে হতো না।

দেশ এখন কিছু মৌলিক সংকটে আছে। সংস্কার, নির্বাচন, ফ্যাসিস্টদের বিচার-এ তিন বিষয়ে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করছে ড. ইউনূসের সরকার। এ তিনটির সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক দলের দ্বিমত নেই। দ্বিমত শুধু অগ্রাধিকার ও সময় নিয়ে। একটি উত্তাল সময়ে দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি একজন সম্মানিত মানুষ। সব রাজনৈতিক দল ও দেশবাসী তাকে সম্মান করে। কিন্তু সঙ্গীদের কজনের কারণে রাজনৈতিক দলগুলো কখনো কখনো তার প্রতি আস্থার সংকটে পড়ে যাচ্ছে। কয়েকজন সঙ্গী আছেন, যারা মনে করেন তাদের মতো জ্ঞানী, পূতপবিত্র, দক্ষ, দেশপ্রেমিক বাংলাদেশে বিরল। কয়েকজন সঙ্গী মনে করেন দেশের খারাপ মানুষগুলোই রাজনীতি করে। সে কারণে গত ৫৩ বছরে দেশে কিছু হয়নি। ৫৩ বছরে দেশে যা হয়নি তারা তা করে দেখাবেন। কেউ কেউ আবার নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব বাদ দিয়ে অন্য কাজে ব্যস্ত। আবার শোনা যাচ্ছে ড. ইউনূসের চারদিকে একটি দেয়াল তৈরি করা হয়েছে, যে দেয়ালের কারণে তিনি বাইরের আলো-বাতাস, রোদবৃষ্টি, তাপমাত্রার খবর পাচ্ছেন না। এই নানান কারণে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে রাজনীতিবিদদের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। দেশবাসীর যে শ্রদ্ধা ও পূজনীয় ইমেজ নিয়ে তিনি যাত্রা করেছেন সে ইমেজের পারদ কিছুটা হলেও নিচের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ইমেজের অধোযাত্রা বন্ধের একমাত্র পথ হলো দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা। নির্বাচন এবং সংস্কার সমানতালে চলতে কোনো সমস্যা নেই। তা ছাড়া এমন অনেক সংস্কার আছে যেগুলো রাজনৈতিক সরকার ছাড়া করা সম্ভবও নয়। কারণ যে কোনো সংস্কারের সঙ্গে অনেক অংশীজন জড়িত থাকে। নির্বাচিত সরকার ছাড়া ওই সব স্টেকহোল্ডারের আস্থা অর্জন দুরূহ ব্যাপার। বর্তমান সরকারের সংস্কারের যে প্রতিশ্রুতি, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা হলো অন্যতম। একটি স্মরণীয় নির্বাচন যদি এ সরকার সম্পন্ন করতে পারে তাহলে বিগত ৫৩ বছরে যা করা সম্ভব হয়নি তা হতে পারে।

সব রাজনৈতিক দলেরই একমাত্র টার্গেট রাষ্ট্রক্ষমতা। দেশে এখন নতুন-পুরান অনেক রাজনৈতিক দল। নতুন নতুন আরও অনেক দল জন্মের অপেক্ষায়। নির্বাচনের আগে কতগুলো দল নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পাবে তা এখনই বলা মুশকিল। ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ-বিএনপি ছিল চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রধান দল। প্রতিদ্বন্দ্বী দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শেখ হাসিনা শত্রুতে পরিণত করেছিলেন। দেশে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরির এজেন্ডা নিয়ে শেখ হাসিনা ১৬ বছর দেশ শাসন করেছেন। সেই দুঃশাসনের বিচারেই তার আওয়ামী লীগ আজ নিষিদ্ধ দলে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বেশি কর্মী-সমর্থকের দল বিএনপি। এ দলের প্রতিষ্ঠাতা মহান স্বাধীনতার ঘোষক, একজন সেক্টর কমান্ডার এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি। এ দলের বর্তমান চেয়ারপারসন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে এ দলটি বিগত ১৬ বছর রাস্তায় ছিল। জুলাই বিপ্লবেরও অন্যতম অংশীদার। সে কারণে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে জনগণের ভোটে এ দলটি ক্ষমতায় যাবে, এমন প্রত্যাশা এ দলের সব নেতা-কর্মীর থাকবে এটাই স্বাভাবিক। দেশের আরেকটি পুরোনো রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এ দলটির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আছে। এ অভিযোগে শেখ হাসিনার শাসনামলে আদালতের রায়ে এ দলের সিনিয়র পাঁচজন নেতাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। দলটির আরেক নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলাম অভিযোগ থেকে মঙ্গলবার মুক্তি পেয়েছেন। এ দলের দুই নেতা মন্ত্রী ছিলেন। গত ১৬ বছরে এ দলটির ওপরও অত্যাচার কম হয়নি। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও জুলাই বিপ্লবের অংশীদার হিসেবে এ দলটিও ক্ষমতার প্রত্যাশা করছে। জুলাই বিপ্লব না হলে এখনো হয়তো শেখ হাসিনার স্টিমরোলার চলত জাতির ওপর। ড. ইউনূসকে হয়তো এতদিনে জেলখানায়ই থাকতে হতো। ছোটবড় রাজনৈতিক দলের নেতারা যেভাবে এখন কথা বলছেন, তা হয়তো সম্ভব হতো না। এ বিপ্লবে প্রধানত যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটির নেতাদের জনপরিচিতির বয়স নয় মাস। এর আগে তাদের তেমন কেউ চিনত না। নয় মাস সময়ের মধ্যে তারা এখন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডার। এ দলের নেতাদের অনেকেই সমীহ করে চলেন। কেউ সমীহ করেন ভালোবেসে। কেউ করেন ভয়ে। কেউ সমীহ করেন যাতে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ ট্যাগ না লাগে। কেউ সমীহ করেন মব সংস্কৃতি থেকে বাঁচার জন্য। এ দলের নেতারা বয়সে তরুণ হলেও ৫৩ বছরের রাজনৈতিক সংস্কৃতি তারা বদলাতে চান। যেহেতু তারা একটি বড় বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছেন সে কারণে আগামী নির্বাচনে তারা ক্ষমতায় যেতে চান। অন্য ইসলামি দলগুলোও ক্ষমতায় যেতে চায়। ক্ষমতায় যেতে চাওয়া বা ক্ষমতার প্রত্যাশা করা দোষের নয়। সবার চাওয়া বা প্রত্যাশা পূরণের একমাত্র পথ দ্রুত নির্বাচন। একটি সুচিন্তিত নির্বাচনি রোডম্যাপ, শান্তিপূর্ণ-অবাধ-নিরপেক্ষ সর্বকালের সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ বেছে নেবে তাদের প্রতিনিধি। রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রয়োজনীয় সব সংস্কারের অঙ্গীকার নিশ্চিত করে নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার মধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকারের সার্থকতা।

দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এখনো নাজুক। এমন কোনো সেক্টর নেই, যে সেক্টর নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করা যায়। আইনশৃঙ্খলার উন্নতিতে কচ্ছপগতি। পুলিশ ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু বারবার হোঁচট খাচ্ছে। এখনো সেনাবাহিনীর পাহারায় চলছে পুলিশি কার্যক্রম। ব্যবসাবাণিজ্যের অবস্থা খুবই খারাপ। দেশি বিনিয়োগকারীরা দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করছেন। চারদিকে শুধু আন্দোলন আর আন্দোলন। সরকারি কর্মচারীরা কদিন সচিবালয় অবরুদ্ধ করে রাখেন। এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও আন্দোলনে। প্রাথমিক শিক্ষকরা আন্দোলনে। এমনিতেই শিক্ষার বারোটা বেজে গেছে। সরকারের উপদেষ্টারা কোনো কিছুই সামাল দিতে পারছেন না। বেসামাল এ অবস্থার মধ্যে নতুন করে শুরু হয়েছে বিভেদের রাজনীতি। শুধু রাজনীতিতে নয়, সমাজের সব ক্ষেত্রেই বিভেদ তৈরি হচ্ছে। যে লক্ষ্যে জুলাই বিপ্লব হয়েছে, সে লক্ষ্য অর্জন শুধু ‘জুলাই সনদ’ নামক কাগুজে চুক্তির মধ্যে রাখলেই হবে না। দেশ নতুনভাবে গড়তে হলে সব বিভেদ ভুলে অটুট জাতীয় ঐক্য দরকার। সেই জাতীয় ঐক্যই যদি না হয়, তাহলে কোনো বিপ্লব বা সংস্কারেই দেশবাসীর মৌলিক উপকার হবে না। এত কিছুর পরও স্থায়ী কোনো পরিবর্তন না হলে, কিছুদিন পরপরই সত্যজিতের সেই হীরক রাজার দেশের মতো জনগণ সমস্বরে বলবে, ‘রশি ধরে মারো টান, রাজা হবে খানখান। ’

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।