ঢাকা, শনিবার, ১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ৩১ মে ২০২৫, ০৩ জিলহজ ১৪৪৬

মুক্তমত

স্বাধীনতার ঘোষণা : মিথ ও দলিল

আমিরুল ইসলাম কাগজী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২:০৯, মে ২৯, ২০২৫
স্বাধীনতার ঘোষণা : মিথ ও দলিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সম্প্রচার কক্ষ। ছবি: সংগৃহীত

৫ মার্চ ১৯৭১। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার কে ব্লাড আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতার কাছে জানতে চান, ৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন কিনা? ওই নেতা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন- ‘না’।

৭ মার্চ শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা না দিয়ে জনগণের স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামের ডাক দিলেন। (সূত্র: The Cruel Birth of Bangladesh: Archer K Blood, পৃষ্ঠা: ১৭২)

আওয়ামী লীগের সাবেক উপদেষ্টা প্রয়াত এইচ টি ইমাম ২০১৪ সালের ২২ এপ্রিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের এক আলোচনা সভায় বলেছিলেন, ‘রক্তপাতের আশঙ্কায় ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। (সূত্র: দৈনিক আমার দেশ ও অনলাইন পোর্টাল আরটিএনএন, ২৩ এপ্রিল ২০১৪)।

শেখ মুজিব নিজেই ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের এক সাক্ষাতকারে জানিয়েছিলেন, ‘তিনি ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। ’ অথচ তার জ্যেষ্ঠ সন্তান শেখ হাসিনা বার বার দাবি করেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তার বাবার দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণ ছিল প্রকৃত অর্থেই স্বাধীনতার ঘোষণা।

৭ মার্চ রেস কোর্স ময়দানের জনসভা সম্পর্কে এন্থনি মাসকারেনহাস বলেন, ‘বিপ্লবী নেতা হিসেবে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিব যে সুনাম অর্জন করেছিলেন তা দিয়ে তিনি চার মাইল দূরে পূর্বাঞ্চল সেনানিবাসের প্রধান দপ্তরে (ঢাকা সেনানিবাস) লক্ষ লক্ষ দৃঢ়চেতা বজ্রমুষ্টি বাঙালিদের নেতৃত্ব দিয়ে টিক্কা খানকে আত্মসমর্পণ করাতে পারতেন। বাঙালিরা তা করতে প্রস্তুত ছিল, সামরিক বাহিনীকে উৎখাত করার জন্য কয়েক শত আত্মাহুতি দিতে প্রস্তুত ছিল। (দ্য রেইপ অব বাংলাদেশ; পৃষ্ঠা ৯৪)।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করার কোনো বাস্তব রণনীতি-রণকৌশল আওয়ামী লীগ নেয়নি। বড় কোনো যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা আওয়ামী লীগের কোনো নেতা, এমনকি শেখ মুজিবও ভাবেননি। বরং ২৫ মার্চ কালরাত্রির পর আওয়ামী নেতারা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। নিরাপত্তা কিংবা চুক্তির স্বার্থে শেখ মুজিব আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন নিজের ধানমন্ডির বাসায়। পাকিস্তান বাহিনীর প্রতিরোধ করার জন্য একজন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাও অস্ত্র হাতে তুলে নেননি। জীবন দেননি কিংবা যুদ্ধ করেননি। (মওদুদ আহমদ, বাংলাদেশ স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা, পৃষ্ঠা: ২২৩)।

আওয়ামী লীগ রণনীতি ও রণকৌশল নির্ধারণ করলে যা সম্ভব হতো সেটি নিয়ে সোজাসাপ্টা কথা বলেছিলেন পাকিস্তানের শীর্ষ সামরিক কমান্ডার সাহেবজাদা ইয়াকুব আলী খানের স্টাফ অফিসার মেজর মসিউদ্দৌলা (বাঙালি)। তিনি বলেছিলেন, নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে শেখ মুজিব যদি গোপনে বাঙালি অফিসারদের স্পষ্ট আদেশ দেন, তাহলে প্রদেশে এখনো যে সংখ্যায় বাঙালি সৈনিক রয়েছেন তাদের সক্রিয় করে পাকিস্তানিদের আসন্ন আক্রমণ প্রতিহত করা সম্ভব। (উপধারা একাত্তর; পৃষ্টা: ১৩)।

৩ থেকে ২৫ মার্চ বাঙালি সেনারা তিনবার পৃথকভাবে শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করে নির্দেশ চেয়েছেন। কেননা যা ঘটবে সে সম্বন্ধে তাদের কোনো সংশয় ছিল না। প্রতিবারই শেখ মুজিব বাঙালি সেনাদের সঙ্গে মামুলি ধরনের কথাবার্তা বলেছেন। (দ্য রেইপ অব বাংলাদেশ; পৃষ্ঠা: ৯৪)।

এবার আসা যাক ১৯৭১ সালের ২৫ ও ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সন্ধিক্ষণে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কর্মতৎপরতা নিয়ে কিছু আলোচনায়। ২৫ মার্চ সন্ধ্যা থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে আওয়ামী লীগের নেতাদের ভিড়। রাস্তায় থমথমে অবস্থা। আগের দিন ২৪ মার্চ শেখ মুজিবের প্রতিনিধি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও ড. কামাল হোসেন এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রতিনিধি বিচারপতি কর্নওয়ালিস লেফটেন্যান্ট জেনারেল পীরজাদা ও কর্নেল হাসান বৈঠক করে ‘কনফেডারেশন অব পাকিস্তান’ ফর্মুলা চূড়ান্ত করেন।

কথা ছিল, ২৫ মার্চ শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া খান মুখোমুখি বসে সেই ফর্মুলা অনুমোদন দেবেন। ফোন করে সময় ঠিক করা হবে। ধানমন্ডির বাসায় বসে শেখ মুজিব সেই টেলিফোনের অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি তার দলের সিনিয়র নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, গাজী গোলাম মোস্তফা, কামরুজ্জামান, ড. কামাল হোসেনকে নিয়ে বাসার নিচতলায় বসে রাজনৈতিক আলোচনা করেন। তিনি এসব নেতাকে রাতের মধ্যেই আত্মগোপনে চলে যেতে নির্দেশ দিলেন।

তখনও মুজিব তাদের সামনে স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে কোনো আলোচনা করেননি। এমনকি নেতারা বিদায় নেওয়ার পর রাত ১০টার দিকে দলের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ একান্তে টেপ রেকর্ডার নিয়ে হাজির হন শেখ মুজিবের সামনে। অনুরোধ করলেন, ‘স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যেতে। ’ জবাবে শেখ সাহেব বললেন, ‘নাকে তেল দিয়ে ঘুমাও গিয়ে। পরশুদিন ২৭ মার্চ হরতাল ডেকে দিয়েছি। ’ (তাজউদ্দিন আহমদ : নেতা ও পিতা; পৃষ্ঠা: ৫৯)

একদিকে এসব আলোচনা চলছে আবার কিছুক্ষণ পর পর ড. কামালের কাছে তিনি জানতে চান ফোনটা এসেছে কিনা। কিন্তু সেই ফোন আর আসেনি। ড. কামাল  বলেন, এমনকি ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ আমি যখন শেখ মুজিবের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিলাম তখনও তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমি ওই টেলিফোন পেয়েছি কিনা। আমি তাকে জানালাম যে আমি তা পাইনি। (মুক্তিযুদ্ধ কেন অনিবার্য ছিল; পৃষ্ঠা: ৯৪)।

সবার শেষে রাত ১১টায় শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করেন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক, যুবলীগ নেতা শেখ মনি ও ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদ। বিদায়কালে শেখ সাহেব তাদের কলকাতার একটি ঠিকানা মুখস্থ করালেন এবং তোফায়েল আহমেদের কপালে চুম্বন করলেন। (আওয়ামী লীগের ফেসবুক)।

এরপর এলো সেই ভয়াল ক্ষণ। পাক হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়লো ঢাকাবাসীর ওপর। হামলা চালানো হলো পিলখানা ইপিআর ক্যাম্পে, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে। শাহাদাত বরণ করলো হাজার হাজার মানুষ। আর পাক সেনাদের হাতে ‘স্বেচ্ছাবন্দি’ হন শেখ মুজিব।

এ ঘটনা নিয়ে তাজউদ্দিন আহমদ : নেতা ও পিতা বইয়ের ৫৯ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে- বেগম মুজিব শোবার ঘরেই সুটকেসে মুজিব কাকুর জামাকাপড় ভাঁজ করে রাখতে শুরু করলেন। ঢোলা পায়জামায় ফিতা ভরলেন। পাকিস্তানি সেনার হাতে মুজিব কাকুর স্বেচ্ছাবন্দি হওয়ার এইসব প্রস্তুতি দেখার পরও আব্বু হাল না ছেড়ে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে বিভিন্ন ঐতিহাসিক উদাহরণ টেনে মুজিব কাকুকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন।

বাঙালি জাতির সেই ঘোর দুঃসময়ে চট্টগ্রামে মৃত্যর ঝুঁকি নিয়ে তরুণ সেনা অফিসার মেজর জিয়া আটক করলেন তারই কমান্ডার পাক জেনারেল জানজুয়াকে। দৃঢ়কন্ঠে উচ্চারণ করলেন, ‘উই রিভোল্ট’। রাত তখন ২টা বেজে ১৫ মিনিট। ২৬ শে মার্চ প্রথম প্রহর। সেনানিবাসে বাঙালি সেনা অফিসার এবং জওয়ানদের উদ্দেশে স্বাধীনতার ঘোষণা করলেন মেজর জিয়া বললেন, ‘এই মুহূর্ত থেকে শুরু হয়ে গেলে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ। ’ পরে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান তার স্বাধীনতার ঘোষণায় নিজেকে ‘বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি’ হিসেবে তুলে ধরে বিশ্ববাসীকে বাংলাদেশের মুক্তিপাগল জনগণের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।

আওয়ামী লীগ নেতাদের পরামর্শে ২৮ মার্চ শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন মেজর জিয়া, যা প্রচারিত হয় ৩০ মার্চ পর্যন্ত। তার এই ঘোষণার সময় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের পরিবেশ সম্পর্কে তুলে ধরেন শব্দ সৈনিক বেলাল মুহাম্মদ। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে নিজের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘ওই সময়েই দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ ২৭শে মার্চ, ১৯৭১ আমি আমার বন্ধু মাহমুদ হোসেনসহ (শহীদ) পটিয়ায় গিয়ে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি ট্রান্সমিটার ভবন নিরাপত্তায় পাহারার ব্যবস্থা করেন এবং সেদিনই সন্ধ্যায় বেতারে তার ঐতিহাসিক ঘোষণা প্রচার করেন। (পৃষ্ঠা: ২৬)।

বেলাল মোহাম্মদ দিয়েছেন, ‘অফিস কক্ষে শুধু আমরা দুজন। আমি ও মেজর জিয়াউর রহমান। বলেছিলাম, আচ্ছা মেজর সাহেব, আমরা তো সবাই ‘মাইনর’; আপনি ‘মেজর’ হিসেবে স্বকণ্ঠে কিছু প্রচার করলে কেমন হয়। কথাটা ছিল নিতান্তই রসিকতা। তিনি নিয়েছিলেন গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব হিসেবে। সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ। কিন্তু কি বলা যায় বলুন তো। আমি একপাতা কাগজ এগিয়ে দিলাম। তিনি নিজের পকেট থেকে কলম হাতে নিয়েছিলেন। প্রথম তিনি লিখেছিলেন ,‘I, Major Zia do hereby declare independence of Bangladesh.’ সেই সান্ধ্য অধিবেশনে মেজর জিয়াউর রহমানের স্বকণ্ঠ ঘোষণার পর অনুবাদটিও অন্যদের কণ্ঠে বারবার প্রচারিত হয়েছিল। ঘোষণাটি প্রধানত আমার সঙ্গে আলোচনা করে রচিত। (পৃষ্ঠা: ৫৯)

এ তধ্যে একমত পোষণ করেন আওয়ামী লীগের আরেক সাবেক সংসদ সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভূইয়া তার ‘মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস’ গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন, ‘ঘণ্টা দেড়েক চেষ্টার পর মেজর তার ঐতিহাসিক ভাষণটি তৈরি করে নিজেই পাঠ করেন। ’

মেজর জিয়ার সেই ভাষণের স্বীকৃতি দিয়ে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, আবদুর রাজ্জাক, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, ড. ওয়াজেদ আলী মিয়া, এ কে খন্দকার, মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ, মেজর রফিকুল ইসলাম, অধ‌্যপক সৈয়দ আলী আহসান, প্রফেসর এমাজ উদ্দীন আহমদ, লেখক মঈদুল হাসান, হুমায়ুন আহমদ, বিদেশি নেতাদের মধ্যে ভারতের জেনারেল জ্যাকব, জেনারেল সুখান্ত সিংসহ আরও অনেকে।

দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হয় মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা। লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার ২৯ মার্চ সংখ্যায় লেখা হয় পূর্ব পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল শহর চট্টগ্রামে মেজর জিয়া খান (হবে মেজর জিয়াউর রহমান) নিজকে বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মির প্রধান ঘোষণা দিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছেন। (International press coverage on Bangladesh Liberation War)

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পরম বন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বক্তৃতায় বলেন, ‘স্বাধীনতার ডাক এসেছিল শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হবার পরে, তার আগে নয়। আমার জানা মতে তিনি কোনো সময় স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। (The cry for independence arose after Sheikh Mujib was arrested and not before. He himself, so far as I know, has not asked for independence even now. (Bangladesh Documents, vol-11)

মিথ
বলা হয়ে থাকে শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা টেলিগ্রামের মাধ্যমে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরীর কাছে পাঠানো হয়। আবার বলা হয় সেটা তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নানের হস্তগত হয় এবং সেটা তিনি শহরে মাইকিং করেন। এ প্রসঙ্গে এম এ হান্নানের বক্তব্য- ‘২৫ মার্চ রাতে আবার আমরা এম আর সিদ্দিকী সাহেবের বাড়িতে চট্টগ্রামের সকল নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা মিলিত হই। রাত ১০টায় শেখ মুজিবর রহমান এম আর সিদ্দিকী সাহেবের নিকট জরুরি সংবাদ দেন। সংবাদটির মূল বিষয়বস্তু ছিল পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা। (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র: পঞ্চদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা-১২৮)।

একই বইয়ের পরের পৃষ্ঠায় তিনি আবার বলছেন, ‘২৫ মার্চ গভীর রাত্রে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট হতে টেলিফোনে আওয়ামী লীগ অফিসে বলা হয় সেনানিবাসের চারপাশে বেশ কিছু ছাত্র-যুবক ও উৎসাহী জনতাকে পাঠানোর জন্য। সংবাদ পাওয়া মাত্র সকলকে অবহিত করা হয়। ২৬ মার্চ খুব সকালে আমি আতাউর রহমান কায়ছার ও এম এ মান্নানসহ সেনানিবাসের দিকে যাই। (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র: পঞ্চদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা-১২৯)।

তিনি আরও বলেছেন, ‘এম এ হান্নান যদি শেখ সাহেবের স্বাধীনতার ঘোষণা ২৬ মার্চ রাতে হাতে পাইতেন তাহলে উক্ত নেতাদের কাছে তিনি সেটা কি প্রকাশ করতেন না ‘ তিনি আরও লিখেছেন, ‘২৭ মার্চ বিকালে মেজর জিয়াউর রহমান রেডিও মারফত স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। মেজর জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণার পর ‘ঘোষণার বক্তব্য’ নিয়ে জনমনে কিছুটা বিভ্রান্তি দেখা দেয়। তাই সেদিন রাত্রে আমি মীর্জা আবু মনসুর ও মোশারফ হোসেন ফটিকছড়িতে প্রাক্তন মন্ত্রী একে খান সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। পুনঃঘোষণার জন্য তিনি একটা খসড়া করে দেন। আমরা ফটিকছড়ি হতে কালুরঘাট ট্রান্সমিটার সেন্টারে উপস্থিত হই। সেখানে মেজর জিয়ার নিকট একে খান কর্তৃক লিখিত খসড়াটি দেই। পুনরায় ২৮ মার্চ সকালে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মেজর জিয়াউর রহমান সর্বাধিনায়ক হিসেবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ’

এইখানেই আসল তথ্য দিয়েছেন হান্নান সাহেব। তার ভাষ্যমতে মেজর জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার যে ঘোষণা দিয়েছেন সেই ঘোষণাপত্র সম্পাদনা করার কাজটি করেন সাবেক মন্ত্রী একে খান। তাহলে ঢাকা থেকে পাঠানো শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র কোথায় গেল?

এম এ হান্নান সাহেব আরেকজন সেনা অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। তিনি হলেন ১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলাম (বীরউত্তম)। তিনি বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারদলীয় এমপি এবং সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। তার লেখা বই ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ স্বাধীনতার ঘোষণা অংশটুকু পড়লে এর উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে।

তিনি লিখেছেন, ‘২৬ মার্চ সকালে টেলিফোনে আমি জনাব হান্নান, জহুর আহমদ চৌধুরী এবং জনাব সিদ্দিকীকে অনুরোধ করলাম চট্টগ্রাম শহরে আমরা যে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি এ বিষয়টি জনগণকে জানাবার জন্য তারা যেন রেডিওতে একটা ঘোষণার বন্দোবস্ত করেন। সেই অনুযায়ী আওয়ামী লীগের নেতারা একটা খসড়া তৈরি করেন এবং তা সংশোধন করে দিলেন ডা. জাফর। এই ঘোষণাবাণীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ থেকে নিরীহ বাঙালিদেরকে রক্ষা করার জন্য বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন ছাড়াও বাঙালিদের যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান করা হয়। ২৬ মার্চ আনুমানিক ২টা ৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম শহরের কয়েক মাইল বাইরে কালুরঘাট রোডস্থ চট্টগ্রাম রেডিওর ট্রান্সমিশন সেন্টার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি জনাব এম এ হান্নান এই ঘোষণা বাণীটি পাঠ করেন। (পৃষ্ঠা: ১৫৩)। এই বই কেউ চ্যালেঞ্জ করেনি। তাহলে এম এ হান্নানের স্বাধীনতার ঘোষণা কোথায় বসে (মেজর রফিকের দপ্তরে) তৈরি হয়েছিল তার নমুনা এখানে পাওয়া গেল।

মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে মেজর রফিক লিখেছেন, “সেদিন (২৭ মার্চ) অপরাহ্নেই তারা (এম এ হান্নান, জহুর আহমদ চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকী ও ডা. জাফর) কালুরঘাট ব্রিজের পূর্বপ্রান্তে গিয়ে দেখেন মেজর জিয়া তখনও সেখানে আছেন। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের অনুরোধে ২৭ মার্চ বিকেল বেলা মেজর জিয়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আসেন এবং সেদিন সন্ধ্যায় তিনি সেখানে থেকে বক্তৃতা দেন। রেডিওতে তার প্রথম ভাষণে তিনি নিজেকে ‘রাষ্ট্র প্রধান’ বলে উল্লেখ করলেন। নিজেকে ‘রাষ্ট্র প্রধান’ বলে উল্লেখ করে ভাষণ দেওয়াটা সম্ভবত সে সময়ের ‘উত্তেজনাকর মানসিক’ অবস্থায় অসাবধানতার কারণেই হয়েছিল। ”

শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রের রচয়িতা ডা.জাফর?
একই মত দিয়েছেন কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রের শব্দ সৈনিক বেলাল মোহাম্মদ। চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান ২৬ মার্চ দুপুরে পাঁচ মিনিটের একটা বিক্ষিপ্ত অধিবেশনে নিজের নাম পরিচয়সহ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন। সেই ঘোষণাপত্রের রচয়িতা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ডাক্তার আবু জাফর। (স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র; পৃষ্ঠা: ৪২)।

আওয়ামী লীগ নেতা শেখ সেলিম লিখেছেন, ‘২৬ মার্চ  প্রথম প্রহরে রাত ১২টার পর শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণাটি তৎকালীন ইপিআর ওয়্যারলেস সেটের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়। ঘোষণায় তিনি বলেন, ‘ইহাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। ’ স্বাধীনতার এই ঘোষণা শেখ মুজিব প্রথমে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী বেতারকেন্দ্র দখল করায় সেটা সম্ভব হয়নি। পরে সেই ঘোষণাপত্র পাঠানো হয় চট্টগ্রামে জহুর আহমেদ চৌধুরীর কাছে ২৬ মার্চ। সেটা জহুর আহমেদ চৌধুরীর কাছ থেকে সংগ্রহ করে আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান বাংলায় অনুবাদ করে চট্টগ্রামে মাইকিং করে ঘোষণা করেন। পরে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে ২৬ মার্চ এম এ হান্নান নিজে বেলা দুটোর সময় পাঠ করেন। ২৭ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ মিনিটে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণাটি বেলাল মোহাম্মদের অনুরোধে মেজর জিয়াউর রহমান পাঠ করেন। (বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ; পৃষ্টা: ৫২১)।

শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণা বেলাল মোহাম্মদের হাতে থাকলে তিনি সেটাই মেজর জিয়াউর রহমানের হাতে তুলে দিতে পারতেন। সাদা কাগজের এক্সারসাইজ খাতা কেন দিলেন?

এই একই কথা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ৫ ডিসেম্বর পিলখানায় বিডিআর জোয়ানদের এক কুচকাওয়াজে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে যখন এই পিলখানা ইপিআর ঘাঁটিতে হামলা করা হয় তখন আমি আমার স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রাম ইপিআর হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়েছিলাম। আমার ঘোষণা বাংলা অনুবাদ করে গ্রামে গ্রামে পাঠানো হয়। ’

এই বক্তব্যের পর মেজর রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১১টায় আমার ইপিআর হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে সব ওয়্যারলেস যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আমরা ঢাকার সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। আমি বাঙালি জওয়ানদের নিয়ে রেলওয়ে হিলে অবস্থান নেই। (লক্ষ্য প্রাণের বিনিময়ে, পৃষ্টা: ১১৮)।

এতে বোঝা যায়, শেখ সেলিম ও শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণা ইথারে ভাসছিল, চট্টগ্রামে ল্যান্ড করতে পারে নাই।

শেখ মুজিব যে ২৫ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি তার আরেকটি নিদর্শন পাওয়া যায় কলকাতা থেকে আনন্দবাজার প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত ‘বাংলা নামে দেশ’ গ্রন্থে। এই গ্রন্থের মুখবন্ধে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে লেখা চিঠি থেকে সেটা স্পষ্ট হয়ে যায়। স্বাধীনতার মাত্র ৪ মাসের মাথায় ১৯৭২ সালের ২০ মার্চ লেখা মুখবন্ধে শেখ মুজিব ২৫ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণার দাবি উল্লেখ না করে ৭ মার্চের দাবি আদায়ের কৌশলের কথা উল্লেখ করেছেন।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তার ‘আমার একাত্তর’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘২৭ মার্চে জানা গেল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। আমি নিজে অবশ্য শুনিনি, তবে ক্যাম্পাসে অনেকেই শুনেছিলেন। এইসঙ্গে আমরা সবাই খুব উল্লাসিত হলাম (পৃষ্ঠা: ৩৭)।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ওপর যত দলিল আছে, তাতে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে শুধুমাত্র মেজর জিয়াউর রহমানের নামই উল্লেখিত হয়েছে। অপরপক্ষে শেখ মুজিবর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার একমাত্র দলিল হচ্ছেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী এবং এম এ হান্নান। তারা কোন টেলিপ্রিন্টার থেকে ওই ঘোষণা পত্র সংগ্রহ করলেন তার নাম ঠিকানা বলেননি। আবার সেটা কোন সময়ে চট্টগ্রামের বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচার করা হলো, তার ভাষা কি ছিল, তার কোনো দালিলিক প্রমাণ কেউ হাজির করেননি। জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র থাকলে তিনি কেন মেজর রফিকের নির্দেশে আরেকটা নতুন ঘোষণা পত্র লিখবেন?

আবার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের জুন মাসে বাংলাদেশের নেতারা স্বীকৃতি দানের প্রশ্নে ভারত সরকারকে খুব বেশি পীড়াপীড়ি শুরু করেন। তখন স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে ভারত সরকার গুরুতর সন্দেহ প্রকাশ করে। তারা বলেন, ‘স্বাধীনতা ঘোষণার কোনো প্রমাণ, কোনো দলিল, কোনো জীবিত সাক্ষ্য আপনাদের আছে কি?’ ভারত সরকার বাংলাদেশ মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ও অন্য প্রধান নেতাদের জিজ্ঞাসা করেছে, ‘কাউকে কিছু বলে গেছেন কিনা শেখ মুজিবুর রহমান?’ এর মধ্যে জহুর আহমদ চৌধুরীও ছিলেন। প্রত্যেকেই বলেছেন, কাউকেই তিনি স্বাধীনতার ঘোষণার কথা বলে যাননি। জহুর আহমদ চৌধুরী নিজে তাজউদ্দীনকে বলেছেন, ‘তাকে কিছু বলা হয়নি ‘ (মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর, পৃষ্ঠা: ২৯)।

সাবেক মন্ত্রী এবং মুক্তিযুদ্ধের ডেপুটি কমান্ডার ইন চিফ একে খন্দকার বলেন, ‘কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের কয়েকজন কর্মীর অনুরোধে মেজর জিয়াউর রহমান সেখানে যান এবং তাদের অনুরোধে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। সেটা ভুল ভাবেই দেন। সেই ঘোষণায় তিনি নিজেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। এই ঘোষণায় সবাই হতবাক হয়ে যান। এমন ঘোষণা তো তার দেওয়ার কথা নয়। এরপর তার সংশোধন করা হয়। এটা প্রচার করা হয় ২৭ মার্চ সন্ধ্যার কিছু আগে। (মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর, পৃষ্ঠা: ২৬)।

আরেকটি কথা খুবই জরুরি; ঢাকায় শেখ মুজিব কেন্দ্রীয় সিনিয়র নেতাদের অন্ধকারে রেখে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নেতাদের ওপর এত আস্থা রাখলেন কীভাবে?

ঢাকা থেকে কলকাতা যাওয়ার পথে পদ্মার তীরবর্তী গ্রাম আগারগাঁও সুকুর মিয়া নামের আওয়ামী লীগের এক কর্মীর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম। ২৮ মার্চ দুপুরে রেডিওতে মেজর জিয়ার কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে তিনি বলেছিলেন, ‘মেজর জিয়ার আহ্বান বেসামরিক, সামরিক তথা বাংলার সর্বশ্রেণির মানুষকে সংগ্রামে উজ্জীবিত করে। (স্বাধীনতার দলিল পত্র পঞ্চদশ খণ্ড ,পৃষ্ঠা ৬৩)।

ওই একই স্থানে ছিলেন তাজউদ্দিন আহমেদও। সেখানে তারা শুনতে পান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা। ২৭ মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত এই ঘোষণাটি আব্বুসহ সামরিক ও বেসামরিক সকল বাঙালিকে অনুপ্রাণিত করে। (তাজ উদ্দিন আহমদ: নেতা ও পিতা, পৃষ্ঠা: ১০৭)।

যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের পিএস মঈদুল হাসান ‘মূলধারা ৭১’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘২৭ মার্চ সন্ধ্যায় ৮ম ইবির বিদ্রোহী নেতা মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করেন। মেজর জিয়া তার প্রথম বেতার বক্তৃতায় নিজেকে ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ হিসেবে ঘোষণা করলেও পরদিন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের পরামর্শে শেখ মুজিবের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার কথা প্রকাশ করেন।

১৯৮৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক মেঘনায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে তৎকালীন বাকশাল নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আবদুর রাজ্জাকের মুখ থেকে শুনতে পাই, ‘২৭ মার্চ সকালে চায়না বিল্ডিংয়ের কাছে আমার বন্ধু আতিয়ারের বাসায় গেলাম। তার কাছ থেকে একটা লুঙ্গি আর একটা হাফ শার্ট নিয়ে রওনা হলাম নদীর ওপারে জিঞ্জিরায়। নৌকায় শুনলাম হঠাৎ কোনো বেতার কেন্দ্র থেকে বলা হচ্ছে, আই মেজর জিয়াউর রহমান ডিক্লেয়ার ইন্ডিপেনডেন্স অব বাংলাদেশ। আমরা তো অবাক। বলে কি? পরে আবার শুনেছি জিয়া বলছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।

আলোচনার বিভিন্ন পর্যায়ে দেখা গেছে,  মেজর জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে চট্টগ্রাম সেনাকুঞ্জে বাঙালি অফিসার ও জওয়ানদের উদ্দেশ্যে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পাক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। (একটি জাতির জন্ম, দৈনিক বাংলা, ১৯৭২)। পরে  কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন মেজর জিয়া। এখানে তিনি নিজেকে ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ হিসেবে ঘোষণা করেন। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে কেউ দ্বিমত পোষণ করেন নাই। সমস্যা দেখা দিয়েছে শেখ মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে। শেখ মুজিব থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের নেতা, মন্ত্রী, এমপি, লেখক, বুদ্ধিজীবী সবার বক্তব্য একটাই; আর সেটা হল- তিনি গ্রেপ্তার হওয়ার আগে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। কিন্তু এর স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ উপস্থিত করা যায় না। কারণ, চট্টগ্রামে যারা এই বার্তা গ্রহণ করেছেন তাদের কারো কথায় মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। বিষয়টি নিয়ে আরও গবেষণা হতে পারে এবং হবে। সঠিক ইতিহাস একদিন উদঘাটিত হবেই।

তথ্য সূত্র-
১.Cruel Birth of Bangladesh :Archar K Blood
২.International Media on Bangladesh Liberation War
৩. দ্যা রেইপ অব বাংলাদেশ : অ্যান্থনী মাসকারেনহাস
৪..বিবিসি
৫. মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর : এ কে খন্দকার, মঈদুল হাসান, এস আর মীর্জা
৬. ৭১: ভেতর ও বাইরে : এ কে খন্দকার
৭. তাজউদ্দীন আহমদ : নেতা ও পিতা- শারমিন আহমদ
৮. মেজর রফিকুল ইসলাম : লক্ষ্য প্রাণের বিনিময়ে
৯. শেখ সেলিম : বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ
১০. তোফায়েল আহমেদ : আওয়ামী লীগ ফেসবুক
১১. আবদুর রাজ্জাক : সাপ্তাহিক মেঘনায় সাক্ষাৎকার
১২. ড. কামাল হোসেন : মুক্তিযুদ্ধ কেন অনিবার্য ছিল
১৩. মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস: মেজর জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভূইয়া
১৪. শব্দ সৈনিক বেলাল মোহাম্মদ: স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।