ঢাকা, শুক্রবার, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ০৩ মে ২০২৪, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

এইডস: কক্সবাজারে ১৩ মাসে আক্রান্ত ১৪৬, মৃত্যু ১৬

সুনীল বড়ুয়া, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৫৩ ঘণ্টা, আগস্ট ৫, ২০২২
এইডস: কক্সবাজারে ১৩ মাসে আক্রান্ত ১৪৬, মৃত্যু ১৬

কক্সবাজার : জেলায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে হিউম্যান ইমিউন ডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস (এইচআইভি) এইডস রোগে আক্রান্তের হার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। গত ১৩ মাসে ১৪৬ জনের শরীরের মরণব্যাধি এ ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে।

তাদের মধ্যে ১৩৬ জনই রোহিঙ্গা। একই সময় মারা গেছেন ১৬ জন।

কক্সবাজার সদর হাসপাতালের অ্যান্টি রেট্রোভাইরাল থেরাপি (এআরটি) সেন্টার সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ডিসেম্বর থেকে গত ৩১ জুলাই পর্যন্ত সাড়ে ছয় বছরে কক্সবাজারে এইচআইভি এইডস রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ৯৮৮ জন। তাদের মধ্যে ৭৯৪ জন রোহিঙ্গা, এ দেশের নাগরিক ১৯৩ জন। মোট মৃত্যু ১১৬ জনের; তাদের মধ্যে রোহিঙ্গা ৫৯ জন।

আক্রান্ত ৯৮৮ জনের মধ্যে ৫০৯ জনই নারী। তাদের মধ্যে ৯১ জন রোহিঙ্গা। গর্ভবতী নারী রয়েছেন ৯ জন। আক্রান্তদের মধ্যে পুরুষ ৩৬৮, শিশু ১১৩ ও তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি সংখ্যা ৩ জন।

কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) এবং এআরটি সেন্টারের ফোকাল পারসন ডা. আশিকুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, কক্সবাজার এইচআইভি এইডস রোগে আক্রান্তের হার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। ২০২১ সালের জুলাই থেকে এ বছর জুন পর্যন্ত ১ হাজার ৩৪২ জনের এইচআইভি টেস্ট করা হয়। এদের মধ্যে ১২৯ জন এইচআইভি পজিটিভ। তাদের মধ্যে ১১৯ জনই রোহিঙ্গা।

এ অবস্থায় শিবিরগুলোয় ব্লক ভিত্তিক টেস্ট করানো হলে আক্রান্তের সংখ্যা আরও বাড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ডা. আশিক।

তিনি আরও বলেন, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে এইচআইভি আক্রান্ত গর্ভবতী মায়েদের জন্য ‘প্রিভেনশন মাদার টু চাইল্ড ট্রান্সমিশন’ (পিএমসিটি) নামে একটি প্রোগ্রাম চালু করা হয়েছে। এই প্রোগ্রামে এইচআইভি পজিটিভ নারীর গর্ভের সন্তানটি যেন এইচআইভি নেগেটিভ হয়, সে লক্ষে সেবাদান করা হচ্ছে। আক্রান্তদের মধ্যে ৭২৬ জন বর্তমানে চিকিৎসার আওতায় আছে বলেও তিনি জানান।

এক ভুক্তভোগী জানান, গত বছর তার স্ত্রীর এইডস ধরা পড়ে। প্রথম প্রথম জ্বর, ডায়রিয়ার মতো কিছু শারীরিক অসুস্থতা দেখা দিলেও পরে তা ঠিক হয়ে যায়। গত এক বছর ধরে তারও একই সমস্যা দেখা দেয়। পরবর্তীতে তিনি ক্যাম্পের চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। গত মাসের পরীক্ষা করার পর তার এইডস শনাক্ত হয়। তারদের পাঁচটি সন্তান, কারও এইডস’র টেস্ট করা হয়নি বলেও তিনি জানান।

উখিয়ার জামতলী ১৫ নম্বর শিবিরের এইচ ব্লকের মো. সুলতান আহমদ তার শিশু কন্যাকে নিয়ে স্থানীয় হাসপাতালে আসেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা গেছে সে এইডস রোগে আক্রান্ত। সন্তানের এইডস আক্রান্তের কারণ কী, বুঝতে পারছেন না সুলতান।

কক্সবাজার জেনারেল হাসপাতালের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আব্দুল মজিদ বাংলানিউজকে বলেন, মিয়ানমার এইডস রোগের জন্য একটি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। সেখান থেকে আসা বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কারণে আমাদের স্থানীয়দের মধ্যে চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। এইডস এর মধ্যে অন্যতম। সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে ঝুঁকি ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে। রোহিঙ্গাদের কারণে এইডস ও ডেঙ্গু মহামারি রূপ নিতে পারে বলেও তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেন।

কক্সবাজার টুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো.রেজাউল করিম বলেন, বর্তমানে কক্সবাজারে এইডস’র যে বিস্তার দেখা দিয়েছে তা উদ্বেগজনক। পর্যটনের জন্যও এটি বিরাট হুমকি। খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছি,এখানকার কিছু কিছু হোটেল-মোটেলসহ স্পা সেন্টারগুলোয় অসামাজিক কর্মকাণ্ড হয়। যা এইডস’র জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। যে কারণে অসামাজিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে- প্রত্যেক স্পা সেন্টারের ফ্রন্ট ডেস্কে এইডস সচেতনতা মূলক লিফলেট/ফেস্টুন রাখা; স্পা সম্পর্কিত সেবা ও তার মূল্যতালিকা দৃশ্যমান রাখা; আগামী ১০ আগস্টের মধ্যে এসব সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বিস্তারিত তথ্য ট্যুরিস্ট পুলিশ কার্যালয়ে জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোকে তিন মাস পরপর এইচআইভি টেস্টের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।

 কক্সবাজার সিভিল সার্জন ডা. মাহবুবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, এইডস প্রতিরোধে স্বাস্থ্য বিভাগের নানা প্রচার প্রচারণা, কাউন্সিলিং ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা গণসচেতনতায় কাজ করছে। কক্সবাজার সদর হাসপাতাল ও উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিনামূল্যে এইচআইভি পরীক্ষা করা হচ্ছে। এছাড়া সদর হাসপাতালে অ্যান্টি রেট্রোভাইরাল থেরাপি (এআরটি) সেন্টার আছে; যেখানে এইডস রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও কাউন্সিলিং করানো হয়। হাসপাতালে সাধারণ চিকিৎসা নিতে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে কারও লক্ষণ আছে মনে হলেই, তাদের এইচআইভি পরীক্ষা করা হচ্ছে বলেও তিনি জানান।

বাংলাদেশে প্রথম এইডস রোগী শনাক্ত হয় ১৯৮৯ সালে। প্রথম যিনি শনাক্ত হয়েছিলেন, তিনি এখনো সুস্থভাবে বেঁচে আছেন। নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছেন। সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে বর্তমানে এইডস সংক্রমিত হয়েছেন ১৪ হাজার জন। আক্রান্তদের মধ্যে ৮৪ শতাংশ রোগী চিকিৎসার আওতায় আছেন।

কক্সবাজারের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মো. মাহবুবুর রহমান বেনারকে বলেন, ভাইরাসটি বিস্তারের প্রধান কারণ অসচেতনতা। এটি প্রতিরোধের জন্য অনিরাপদ যৌন বর্জন করতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত ইনজেকশনের সিরিঞ্জ ব্যবহার থেকে বিরত থাকা, রক্ত নেওয়ার সময় এইচআইভি পরীক্ষা করে নেওয়া, যে কাজ করলে এইচআইভি ছড়াতে পারে তা থেকে বিরত থাকলে সংক্রমণ কমানো সম্ভব।

করোনাভাইরাসের মতো বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে এইচআইভি টেস্টও বাধ্যতামূলক করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এ বিশেষজ্ঞ বলেন, এখনও পর্যন্ত  বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ক্লিনিকসহ অনেক হাসপাতালে অপারেশনের যন্ত্রপাতি যথাযথভাবে জীবাণুমুক্ত করে ব্যবহার করা হয় না। বিশেষ করে কক্সবাজার শহরের হাসপাতাল সড়কসহ বিভিন্ন স্থানে যত্রতত্র গড়ে তোলা অনুমোদনহীন ডেন্টাল চেম্বারগুলোয় এই প্রবণতা বেশি। যে কারণে এসব চিকিৎসা কেন্দ্র থেকেও এইডস ছড়াচ্ছে।

মিয়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পূর্বাপর বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা এখন প্রায় ১২ লাখ। তারা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি অস্থায়ী আশ্রয় শিবির এবং নোয়াখালীর ভাসানচরে অবস্থান করছেন। তাদের মধ্যে এইডস ছড়ানোর প্রবণতা সবচেয়ে বেশি।

বাংলাদেশ সময় : ১৯৫৫ ঘণ্টা, ৫ আগস্ট, ২০২২
এসবি/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।