ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৬ মে ২০২৪, ০৭ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

ভ্যানচালক বাবার স্বপ্ন পূরণ, মেয়ে মেডিক্যালে-ছেলে ঢাবিতে

ডিস্ট্রিক্ট করেসপনডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩১ ঘণ্টা, এপ্রিল ৭, ২০২২
ভ্যানচালক বাবার স্বপ্ন পূরণ, মেয়ে মেডিক্যালে-ছেলে ঢাবিতে

ঠাকুরগাঁও: অভাবের কারণে বড় মেয়েকে পড়াতে পারেননি আফতাবর রহমান। তাই স্কুলের গণ্ডি না পেরুতেই বিয়ে দেন তাকে।

সন্তানদের নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখেও কিছু করতে পারেননি তিনি। কোনো উপায় ছিল না তার। কারণ সম্বল হিসেবে অল্প একটু জমি আর একটি ভ্যান। সাত সদস্যের পরিবারের একমাত্র আয়ের ভরসা আফতাবরের ভ্যানটি।

তবে স্বপ্ন দেখা বন্ধ করেননি তিনি। বড় মেয়েকে পড়াতে না পারলেও দৃঢ় সংকল্প করেন বাকী সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার। নিজের সবকিছুর বিনিময়ে হলেও সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করার দৃঢ় প্রত্যয় নেন তিনি।  

ঠাকুরগাঁওয়ের বালীয়াডাঙ্গী উপজেলার বড় পলাশবাড়ী ইউনিয়নের বেলসাড়া গ্রামের বাসিন্দা আফতাবর রহমান। স্ত্রী, এক ছেলে, তিন মেয়ে আর বৃদ্ধা মাকে নিয়ে সাত সদস্যদের সংসার তার। পৈতৃক ভিটেমাটি, একটি ভ্যান, আর অল্প একটু চাষাবাদের জমি ছাড়া কিছুই নেই তার।

ভ্যান চালিয়ে যা রোজগার হয় তা দিয়ে সংসার চালানোর পাশাপাশি খরচ করতেন সন্তানের পড়াশোনায়। নিজের চাষাবাদের জমি বিক্রি করে সন্তানদের পড়াশোনার খরচ চালিয়েছেন তিনি। ছেলে মুন্নাকে ভর্তি করিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, আর সম্প্রতি মেডিক্যাল কলেজ ভর্তি পরীক্ষায় দ্বিতীয় মেয়ে আলপনা আক্তার ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে। আর ছোট মেয়ে এইচএসসিতে পড়াশোনা করছে।

ভ্যানচালক আফতাবরের সন্তানদের এমন সফলতায় পরিবারসহ আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছেন তারা।

আলপনার সহপাঠী রুনা আক্তার বলেন, আলপনা আমার বান্ধবী ও প্রতিবেশী। ছোটবেলা থেকেই একসঙ্গে পথচলা আমাদের। একসঙ্গে স্কুল আর কলেজ। ক্লাসে অনেক মেধাবী ছিল সে। তার এই সফলতায় আমরা সকলে খুশি।

স্থানীয় প্রতিবেশী রুহুল কবির বলেন, এখন আমাদের ভাতিজি আমাদের গর্বের বিষয়। আমাদের এলাকায় অনেক দরিদ্র মানুষ বসবাস করেন। সে ডাক্তার হলে আমাদের এলাকার জন্য ভালো কিছু করতে পারবে এই প্রত্যাশা রইল।

উপজেলার সংবাদকর্মী মাজেদুল ইসলাম বলেন, আমাদের উপজেলায় কৃতি সন্তানের তালিকায় আলপনার নাম যোগ হতে যাচ্ছে। আমরা আশা করছি সে একজন মানবিক ডাক্তার হবে। অসহায় ও দারিদ্র্য পরিবারের জন্য ভালো কিছু করতে পারবে।
 
আলপনা আক্তার বলেন, আমার এই ক্ষুদ্র সফলতায় আমি মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি। যার অনুপ্রেরণায় আমার এ সফলতা তিনি হলেন আমার বাবা। সারাদিন ভ্যান চালিয়ে রোজগার করেন পরিবার চালান। আর আমাকে স্বপ্ন দেখান ডাক্তার হওয়ার। বাবার পাশাপাশি আমার মা অনেক পরিশ্রম করেছেন। আমার কেমন ফলাফল হবে এটা আমার চেয়ে আমার মা আগেই বলে দিতে পারতেন। আমার বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আমাকে অনেকভাবে সহযোগিতা করেছেন। আমি প্রথমে মানবিক শাখায় ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু বিদ্যালয়ের স্যারেরা আমাকে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হওয়ার জন্য পরামর্শ দেন। সেখান থেকে আমার স্বপ্নটি আরও বেগবান হয়। আর আমাদের মত পরিবারের ছেলে মেয়েরা স্বপ্ন দেখতে ভয় পাই। তবে আমি মনে করি দারিদ্র্যতা সফলতার অন্তরায় না। পরিশ্রম করলে সফল হওয়া সম্ভব।

আলপনার মা মাজেদা খাতুন বলেন, আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম মেয়েকে ডাক্তার বানাবো। আজকে তার যাত্রা শুরু হলো। আমার মেয়ে বলতো মেয়ে মানুষকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। কিন্তু আমরা বলতাম তোমার মেধা আছে তুমি পড়াশোনা কর। যত কষ্টই হোক না কেন আমরা তোমার খরচ বহন করবো। আজকে সে আমাদের আশা পুরন করেছে। আমাদের কোনো অর্থ নেই তবে স্বপ্ন আছে।

আলপনার বাবা আফতাবর রহমান বলেন, টাকার অভাবে বড় মেয়েকে পড়াতে পারিনি। পরে স্বপ্ন দেখেছি বাকি সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করবো। একদিন আমি ভ্যান চালিয়ে রাতে বাসায় আসলাম। খাওয়ার সময় ছেলেটা বললো বাবা দোয়া করিও আমি যাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে পারি। আলহামদুলিল্লাহ সে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা নিয়ে চতুর্থ বর্ষে পড়াশোনা করছে। সেভাবে আমার মেয়েকেও আমি কষ্ট করে পড়াশোনা করিয়েছি। আমি সারাদিন ভ্যান চালিয়ে কষ্ট করতাম শুধুমাত্র তাদের জন্য। আমার ২৫ শতক আবাদি জমি ছিল। ছেলেকে ভর্তি করার জন্য ৫ শতক বিক্রি করতে হয়। পরে ছেলে ও মেয়েকে পড়াশোনা করানোর জন্য বাকি ২০ শতক জমিও বিক্রি করতে হয়। এখন ভ্যান আর ভিটেমাটি ছাড়া কিছুই নেই আমার। তারপরেও আজকে আমি অনেক খুশি। আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ডাক্তারি পড়ানো অনেক খরচ। আমি চেষ্টা করবো আমার সাধ্যমত। তবে যদি সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা করা হয় তাহলে আমার কষ্টটা কম হবে।

সরকারি সুযোগ সুবিধা আলপনা পাবে কি না এ বিষয়ে জানতে চাইলে বালীয়াডাঙ্গী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা যোবায়ের হোসেন বলেন, যদি আলপনার বাবা চান তাহলে তার পড়াশোনার খরচের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিবে উপজেলা প্রশাসন।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩০ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৭, ২০২২
কেএআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।