চাপা ক্ষোভ আর আক্ষেপের সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন দিনমজুর জহিরুল। বয়স ৪০ ছুঁই ছুঁই।
>>>শ্রমিকদের সময় কাটছে সংসার-সন্তান নিয়ে
করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধে দেশব্যাপী টানা সরকারি ছুটির মধ্যে চলছে অঘোষিত ‘লকডাউন’। সব শ্রেণির লোকজনকে ঘরে অবস্থান করতে বলা হচ্ছে। কিন্তু দৈনিক মজুরির ওপর নির্ভরশীল বহু মানুষের জীবন-জীবিকার জন্য কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই। কোলাহল আর মানুষে ঠাসা মহানগরের এমন রূপ এর আগে আর কখনও এমন দেখেনি কেউ। জনমানবশূন্য শহরে তার দিনমজুর ও খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের আয়-রোজগার গিয়ে ঠেকেছে একেবারেই শূন্যের কোটায়।
রাজশাহী মহানগরের গোরহাঙ্গা রেলগেইট এলাকা। এখানে রোজ কাক ডাকা ভোরে জড়ো হন শ্রমজীবী মানুষ। সমাজের সব দৃশ্যপট পরিবর্তন হলেও এখন চিত্র ভিন্ন। এখানে করোনা আতঙ্ক নেই। তবে মানুষের সংখ্যা কম থাকায় শ্রমিকের সংখ্যাও কম। জীবন-জীবিকার তাগিদে তবুও সেখানে আসছেন শ্রমজীবী মানুষ।
রাজশাহীর পুঠিয়া, দুর্গাপুর, চারঘাট, বাঘা, পবার পারিলা, দারুশাসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে আসছেন কাজের সন্ধানে। কিন্তু কাজ নেই। মহানগরের লোকজন আগে এখানে এসে শ্রমিক ভাড়া করে নিয়ে যেতেন। কিন্তু এখন এলাকাটি প্রায় ফাঁকা। এদিক ওদিক তাকিয়ে হাতেগোনা কয়েকজন শ্রমিকের দেখা মেলে। কিন্তু কাজের সংকটে তাদের খালি হাতেই ফিরে যেতে হয়। ফলে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা।
একাধিক শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিম্নআয়ের মানুষের মাথায় এখন রাজ্যের দুশ্চিন্তা। পেটের জ্বালায় তাদের বাইরে বের হতে হয়। অনেক সময় পুলিশ তাদের অযথা হয়রানি করে। কিন্তু ক্ষুধার তাড়নায় বাড়িতে থাকার কোনো উপায় নেই তাদের। রাজশাহীর রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে ফুটপাতের হকার, পরিবহন শ্রমিক ও দোকান কর্মচারী সবারই একই অবস্থা।
রেলগেইট এলাকায় প্রতিদিনের মতো বুধবারও (১ এপ্রিল) কোদাল ও ডালি হাতে কাজের সন্ধানে এসেছেন বশির উদ্দিন। বয়স পঞ্চাশের কোটায়। কিন্তু সারাদিন কোনো কাজ না পেয়ে দুপুরে ফিরে যেতে হয় খালি হাতেই। তার কাছে গিয়ে প্রশ্ন করতেই বলে উঠলেন, খোঁজ নিয়ে লাভ কী বাবা; কাজ দেন, না হলে সাহায্য করেন কিছু চাল ডাল দিয়ে। তাও বাড়িতে গিয়ে কিছু খেয়ে বাঁচি। ৮-১০ দিন থেকে কোনো কাজ নেই। খালি হাতে এসে খালি হাতেই ফিরে যেতে হচ্ছে। কোনো সাহায্য পাই না। কেউ ফিরেও তাকায় না। প্রতিদিন বাড়ি ফেরার সময় স্ত্রী বলেন আজও কাজ হলো না; এ কষ্ট রাখি কোথায় বলেন?
আরেক শ্রমিক মোতালেব হোসেন। তিনি আক্ষেপের সুরে বলেন, শুধু কানে শুনছি যে বিত্তবানরা সাহায্য করছেন। কিন্তু আমাদের কাছে সাহায্য আসে না। আমরা প্রতিদিন ৫০-১০০ জন শ্রমিক এখানে কাজের সন্ধানে আসি, কিন্তু আমাদের কেউ খোঁজ নেয় না। কেউ কাজ নিয়ে এলে আমরা সবাই ছুটে যাই তার কাছে। কিন্তু আগের মতো এখন আর কাজ পাচ্ছি না। আপনারা যদি মেয়র বা সরকারের দৃষ্টিতে আমাদের কথাগুলো তুলে ধরেন তাহলে আমরা কিছুটা খেয়ে পরে বাঁচতে পারি!
দুপুরে বিনোদপুর মোড়ে কথা হয় রিকশাচালক কামাল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিদিন আমি ৬০০-৭০০ টাকা উপার্জন করতাম। এখন ২০০ টাকা পেতে কষ্ট হয়ে যায়। ঘরে খাওয়ার লোক পাঁচজন। পুলিশ আমাদের রাস্তায় নামতে নিষেধ করছে। ঘরে বসে থাকলে তো কেউ আমাকে খাবার দেবে না। করোনা ভাইরাসের ভয়ে কাজ না করলে ছেলে-মেয়েদের কী খাওয়াবো?
এদিকে, রাজশাহী জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা আমিনুল হক বাংলানিউজকে বলেন, রাজশাহীর ৪০ হাজার পরিবারকে সহযোগিতা করছে জেলা প্রশাসন। করোনা ভাইরাসের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়ায় পরিবারগুলোকে চাল ও নগদ অর্থ দিয়ে সহায়তা করা হচ্ছে। রাজশাহী মহানগরী ছাড়াও জেলার নয়টি উপজেলার ৪০ হাজার ৪০০ পরিবারকে ৪০৪ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ৫ লাখ টাকা সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। মহানগর ও উপজেলাগুলোর জন্য বরাদ্দ আছে ৫০ হাজার টাকা। ২৯ মার্চ থেকে এই ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮২৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ০২, ২০২০
এসএস/এনটি