ঢাকা, শনিবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

‘এর চেয়ে কষ্টের কী হতে পারে’ প্রশ্ন নুসরাতের ভাইয়ের

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০১৯
‘এর চেয়ে কষ্টের কী হতে পারে’ প্রশ্ন নুসরাতের ভাইয়ের মা ও দুই ভাইয়ের সঙ্গে নুসরাত: ছবি: সংগৃহীত

ফেনী: একজন ভাইয়ের জন্য এর চেয়ে কষ্টের কি হতে পারে-যে ভাইয়ের কোলে আদরের ছোট বোনটার অগ্নিদগ্ধ ক্ষতবিক্ষত শরীর থাকে। একজন ভাইয়ের জন্য এর চেয়ে কষ্টের কি হতে পারে যে ভাই তাঁর প্রিয় ছোট বোনটাকে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে লড়তে একসময় নিস্তব্ধ হয়ে যাওয়া দেখে? একজন ভাইয়ের কাঁধে তারই আদরের ছোট বোনের লাশের চাইতে ভারী পৃথিবীতে আর কি থাকতে পারে?

কথাগুলো ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমানের ফেসবুক ওয়াল থেকে নেওয়া। বোনের মৃত্যুকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না তিনি।

বোনের কথা মনে হলেই ডুকরে কেঁদে উঠছেন।

ফেসবুক স্ট্যাটাসে নোমান আরও লিখেছেন, আমি কি করে ভুলবো ৮০ ভাগ পুড়ে যাওয়া প্রিয় বোনটার কষ্টের প্রতিটি মুহূর্ত। আদরের ছোট বোনের শরীরের পোড়া গন্ধের চেয়ে কষ্টের কি হতে পারে?

মাদ্রাসা গেট থেকে বিদায় দেওয়ার কিছু সময় পর যখন ফোনে আগুন লাগার কথা শুনতে পাই নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। মাদ্রাসা থেকে শুরু করে সোনাগাজী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সেখান থেকে ফেনী তারপর ঢাকা। অ্যাম্বুলেন্সে থাকাকালীন বোন শুধু পানি পানি বলে হাহাকার করছিল।

ভাইয়া পানি দেন আমার শরীরে পানি দেন, আমাকে পানি খাওয়ান, আমার শরীর যে জ্বলে যাচ্ছে, তৃষ্ণায় যে বুক ফেটে যাচ্ছে...... পুরোটা সময় থর থর করে কাঁপছিলাম, বুকটা ফেঁটে চৌচির হয়ে যাচ্ছিলো।

চোখের পানিগুলো ঝরণা ধারায় ঝরছিল। ওই মূহুর্তটাতে শুধু এটুকুই চাইছিলাম, আল্লাহ আমার বোনটাকে বাঁচিয়ে দাও, আমার প্রাণের বিনিময়ে হলেও বাঁচিয়ে দাও।

আমি এমন এক হতভাগা ভাই, যার অতি আদরের ছোট বোনটি মৃত্যুর আগ মুহূর্তে আকুতি জানিয়ে একফোটা পানি চেয়েছিল অথচ আমি ডাক্তারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মাত্র একফোঁটা পানি দিতে পারিনি।

বোন আমার আইসিইউতে থাকাকালীন বলেছিল অসহ্য যন্ত্রণা আর কান্নাভরা কণ্ঠে ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলেছিল ভাইয়া আম্মু জিজ্ঞেস করলে বলবি আমি ভালো আছি, না হলে আম্মু কষ্ট পাবে।

এখন সন্ধ্যার পর ফোন দিয়ে কে বলবে, ভাইয়া তাড়াতাড়ি বাসায় আয় না হলে আম্মুরে দিয়ে ফোন করাচ্ছি। অর্ধেক কাপ চা খাওয়ার পর কাপটা কেড়েঁ নিয়ে কে বলবে, ভাইয়া চা বেশি খেলে ক্ষতি করবে এ বলে নিজেই খেয়ে নেবে। আপনাদেরতো বোন আছে, আমারতো বোন নেই, আমি মনকে কি দিয়ে শান্তনা দেব বলতে পারেন?

আমার আদরের ছোট বোনটাকে যারা নৃশংসভাবে খুন করেছে, এর সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সবার শাস্তি চাই, সর্বোচ্চ শাস্তি চাই। আমার বোনটাকে যেন আল্লাহ জান্নাতবাসী করেন।

গত ৬ এপ্রিল (শনিবার) সকালে আলিম পরীক্ষা দিতে মাদ্রাসায় যায় নুসরাত। তখন তার সহপাঠী নিশাতকে ছাদের ওপর কেউ মারধর করছে বলে নুসরাতকে ডেকে নিয়ে যায় এক বোরকাপরিহিত ছাত্রী। সেখানে গেলে এই ছাত্রীকে মুখোশপরা ৪/-৫ জন অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে মামলা ও অভিযোগ তুলে নিতে চাপ দেয়। অস্বীকৃতি জানালে তারা নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়। তখন তাকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় চারদিন সর্বাত্মক চিকিৎসা চললেও সবাইকে কাঁদিয়ে ১০ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যায় নুসরাত।

এদিকে এ ঘটনায় ৮ এপ্রিল রাতে অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা ও পৌর কাউন্সিলর মাকসুদ আলমসহ ৮ জনের নাম উল্লেখ করে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান।

ওই মামলায় এখন পর্যন্ত এজহারভুক্ত ৮ জনসহ মোট ১৮ জন গ্রেফতার হয়েছে। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে পাঁচ জন। ১৫ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মাদ্রাসা কমিটির সহ-সভাপতি রুহুল আমিনকেও আটক করা হয়েছে। আদালতের নির্দেশে মামলার তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন।  

এছাড়া শ্লীলতাহানির অভিযোগ করতে থানায় যাওয়ার পর নুসরাতের ভিডিও ধারণ করে ছড়িয়ে দেওয়ায় ১৫ এপ্রিল সোনাগাজী থানার ওই সময়ের ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে আইসিটি আইনে মামলা করা হয়েছে। এ মামলাও তদন্তের জন্য পিবিআইকে দায়িত্ব দিয়েছেন আদালত।

হত্যা মামলায় যে পাঁচজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে, তাদের মধ্যে উম্মে সুলতানা পপি (শম্পা) জানায়, নুসরাতকে হত্যা করার জন্য পরীক্ষার কেন্দ্র থেকে সে-ই ছাদে ডেকে নিয়ে গেছে। তার নাম পপি হলেও হত্যাকাণ্ডের দিন হত্যাকারীরা তার পরিচয় গোপন রেখে ‘শম্পা' নামে ডাকে। সেজন্য নুসরাতও তাকে ডেকে নেওয়া বোরকাপরিহিত ছাত্রীটির নাম শম্পা বলে গিয়েছিল।

আর সিরাজ উদদৌলার ঘনিষ্ঠ নুর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন শামীম জানায়, জাবেদ ও পপি (শম্পা) সরাসরি কিলিং মিশনে অংশ নেয়। জাবেদ নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় আর পপি ওড়না দিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেলে। এসময় তাদের সঙ্গে আরও তিনজন ছিলো।

শামীম তার জবানবন্দিতে জানায়, নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়ার পর সে দৌড়ে নিচে নেমে উত্তর দিকের প্রাচীর টপকে বের হয়ে যায়। বাইরে গিয়ে মোবাইল ফোনে বিষয়টি রুহুল আমিনকে জানায়। প্রত্যুত্তরে রুহুল আমিন বলেন, ‘আমি জানি। তোমরা চলে যাও। ’ 

** পরিবারের মধ্যমনি ছিলো ‘নুসরাত’
** প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞ নুসরাতের বাবা

বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০১৯
এসএইচডি/ওএইচ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

জাতীয় এর সর্বশেষ