ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

পরিবারের মধ্যমনি ছিলো ‘নুসরাত’

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০১৯
পরিবারের মধ্যমনি ছিলো ‘নুসরাত’ মা ও দুই ভাইয়ের সঙ্গে নুসরাত: ছবি: সংগৃহীত

ফেনী: ছোট ভাই রাশেদুল হাসান রায়হান বোন নুসরাতের সঙ্গে একই মাদ্রাসায় পড়তো। বোন আলিমে (উচ্চ মাধ্যমিক) আর ভাই দাখিলে (মাধ্যমিক)। দুই ভাই-বোন এক সঙ্গেই মাদ্রাসায় যেতো।

রাগ-অভিমান আর খুনসুটিসহ দুই ভাই-বোনের মধ্যে ছিলো দারুন বন্ধুত্ব। বোনটা ভাইয়ের সঙ্গে সব শেয়ার করতো।

বোনের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে কখোনোই একা মাদ্রাসায় যেতে দিতো না, দু’জন একসঙ্গে যেতো।  

রায়হান তার ফেসবুক স্টেটাসে লিখেছে, ‘প্রতিদিন সন্ধ্যায় যখন বাড়ি ফিরে দেখি আপুর রুমটা খালি পড়ে আছে। যেই টেবিলে বসে পড়ালেখা করতো সেখানে বই খাতাগুলো ঠিকই আছে। আছে আপুর ব্যবহৃত জিনিসপত্রগুলো। নেই শুধু আমার কলিজার টুকরা আপু। বিশ্বাস করুণ, একবুক চাপা কষ্ট-বেদনায় আমার ছোট্ট হৃদয়টি দুমড়ে মুচড়ে যায়। ’
 
প্রতিটি মুহূর্তে মনে পড়ে যায় আপুর কথা। ঘুমের ঘোরে জেগে উঠি আপুর শেষ দিনগুলির নির্মম কষ্টের স্বপ্নে দেখে। শেষ রাতে চোখে একফোঁটা ঘুম আসে না আপুর কথা ভেবে।  

শুধু ছোট ভাই রায়হান নয়- বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমানেরও কলিজার টুকরো ছিলো নুসরাত। বুধবার (২২এপ্রিল) সোনাগাজী পৌর এলাকার উত্তর চর চান্দিয়া এলাকায় নুসরাতের বাড়িতে গিয়ে বড় ভাই মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে কথা বললে সে জানায়, কোনোভাবেই পরম আদরের ছোট বোনটাকে সে ভুলতে পারছে না। বোনের মুখটি বার বার ভেসে উঠছে। বোনের কথা কেউ বললেই অজানায় চোখের কোনে পানি এসে যায়।

নোমান তার ফেসবুক স্টেটাসে লিখেছে ‘এখন সন্ধ্যার পর ফোন দিয়ে কে বলবে, ভাইয়া তাড়াতাড়ি বাসায় আয় না হলে আম্মুরে দিয়ে ফোন করাচ্ছি। অর্ধেক কাপ চা খাওয়ার পর কাপটা কেড়ে নিয়ে কে বলবে, ভাইয়া চা বেশি খেলে ক্ষতি করবে এই বলে নিজেই খেয়ে নিবে। আপনাদেরতো বোন আছে, আমারতো বোন নাই, আমি মনকে কি দিয়ে শান্তনা দিব বলতে পারেন?
 
আমার আদরের ছোট বোনটাকে যারা নৃশংসভাবে খুন করেছে, খুনের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সবার শাস্তি চাই, সর্বোচ্চ শাস্তি চাই। রাফির আরেক ভাই দেশের বাইরে থাকেন নোমান জানান সেও ছোট বোনটাকে অনেক আদর করতো।  

দুই ভাই ছাড়াও- মায়ের সঙ্গেও নুসরাতের ছিলো দারুন সখ্যতা। সারাক্ষণ হাসি খুশি মেয়েটা বাড়িতে যতক্ষণ থাকতো মায়ের পিছে পিছেই থাকতো।  

মা শিরিন আখতার বলেন, মেয়েটা আমার পিছু ছাড়তো না। সারাটি সময় আশপাশে থাকতো। এখনও মনে হয় মেয়ে যেন আমার আশপাশেই আছে কিন্তু খুঁজে পাই না। মা শিরিন আখতার আরো বলেন, মেয়ে রান্না করতে পছন্দ করতো, আমি ওরে রান্না করা শিখাতাম। মেয়ে নামাজ কালাম -নিজের পড়াশুনো ছাড়া তেমন বের হতো না বাড়ি থেকে।  
 
মায়ের সঙ্গে ঘুমাতে ভালোবাসতো নুসরাত। মাদ্রাসা থেকে ফিরে মাকে জড়িয়ে ধরতো। ছোটবেলা থেকে এই অভ্যাসের জন্য মা কত বকেছেন। তবু মায়ের গন্ধ, ভালোবাসা মেয়ে ছাড়েনি। সেই মেয়ে আজ নেই বলেই কেঁদে ওঠেন মা। ‘রাফি’, রাফি বলে বলে বিলাপ করে চোখের পানি ফেলছেন আর জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন।

বাবা মাওলানা একে এম মুসা মানিকও ছিলেন, মেয়ে অন্ত প্রাণ। সারাদিন কাজের চাপে ঘরের বাইরে থাকলেও ঘরে এলে মেয়েকে একবার দেখতে চাইতেন। বাবার বড় আদরের ছিলো একমাত্র মেয়ে। বাবা ঘরে ফিরলেই এটা ওটা রান্না করে বাবাকে খেতে দিতো। সেই আদরের মেয়েটিকে হারিয়ে বাবার মুখের ভাষা যেন হারিয়ে গেছে। মেয়ের কথা মনে পড়লেই কেঁদে বুক ভাসান বাবা। আর বার বার বলছেন, ‘আমি আমার মেয়ে হত্যার দুষ্টান্তমূলক বিচার চাই। ’

নুসরাতের বাড়ির অন্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুধু নিজের পরিবার নয় বাড়ির অন্য পরিবারগুলোর মানুষরা নুসরাতকে খুব পছন্দ করতেন। মিশুক প্রকৃতির মেয়েটি ছিলো সবার আদরের।

গত ৬ এপ্রিল সকালে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় নুসরাত আলিমের আরবি প্রথমপত্র পরীক্ষা দিতে গেলে মাদ্রাসায় দুর্বৃত্তরা গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ঘটনায় দগ্ধ নুসরাত ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৫দিন পর ১০ এপ্রিল রাতে মারা যায়।  

পরদিন ১১ এপ্রিল বিকেলে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। এ ঘটনায় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে প্রধান আসামি করে ৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো ৪/৫ জনকে আসামি করে নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান ৮ এপ্রিল সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন। ১০ এপ্রিল থেকে মামলাটির দায়িত্ব পায় বিপিআই। সেই থেকেই গ্রেফতার হতে থাকে আসামিরা। এ পর্যন্ত গ্রেফতার হয় ২০ জন, এদের মধ্যে আদালতে জবাবন্দি দিয়েছে ৮ জন।  

বাংলাদেশ সময়: ০৭২৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০১৯
এসএইচডি/আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।