চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে বহুল আলোচিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) বিকেল চারটায় স্বাক্ষর হতে যাচ্ছে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায়। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
ঐকমত্য কমিশন এই সনদকে ‘নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। অধ্যাপক ইউনূস একে অভিহিত করেছেন, ‘জাতির জন্য এক বৃহৎ সনদ’ হিসেবে।
এতদিন ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপে অংশ নেওয়া ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটকে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছে কমিশন।
তবে সনদ বাস্তবায়ন ও প্রক্রিয়া নিয়ে মতভিন্নতার কারণে আজকের অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট সব দল অংশ নেবে কি না—তা নিয়ে অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি। ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, “স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। আমরা আশা করছি, সব দল অংশ নেবে এবং সনদে সই করবে। কেউ আজ না করলেও পরবর্তীতে স্বাক্ষরের সুযোগ থাকবে। ”
সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া ও গণভোটের সময় নির্ধারণ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো বিভক্ত। বিএনপি ও এর মিত্ররা ফেব্রুয়ারির সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট চায়, অন্যদিকে জামায়াত চায় নভেম্বর মাসে সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট হোক। দলটি সংসদের উভয় কক্ষেই সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন দাবি করছে।
অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সনদে স্বাক্ষরের আগে সরকারের কাছ থেকে নির্বাহী আদেশে বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা চায়। এসব ইস্যুতেই আজকের অনুষ্ঠানে সব দলের উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। বিএনপিসহ তাদের জোটভুক্ত দলগুলো সনদে সই করবে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে, তবে জামায়াত এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। এনসিপি ও বাম দলগুলো ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, তারা সনদে সই করবে না। গত রাতে এনসিপি জানিয়েছে, তারা এই অনুষ্ঠানে যোগ দেবে না।
এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ আগেই জানিয়েছিলেন যে, দলটি সনদে স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বৃহস্পতিবার বলেছেন, “আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। আমাদের দেওয়া নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি) সনদে লিপিবদ্ধ করা হলে বিএনপি সনদে সই করবে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানতে শুক্রবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ”
অনুষ্ঠানে গেলেও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে না বলে জানা গেছে। দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেছেন, “জামায়াত মনে করে, সনদের আইনি ভিত্তি থাকা দরকার। এজন্য আমরা নভেম্বরে গণভোট চাই। জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট হলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। ”
তিনি জানান, “জামায়াত অনুষ্ঠানে অংশ নেবে, তবে স্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। ”
পরওয়ার আরও বলেন, “যদি আলোচনার মাধ্যমে অসম্পূর্ণ বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করা যায়, তাহলে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আপত্তি থাকবে না। ”
সনদে স্বাক্ষর না করাদের দলে আরও আছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাসদ (মার্ক্সবাদী) এবং বাংলাদেশ জাসদ। এই চারটি বাম দল সনদে সই না করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। গতকাল পুরানা পল্টনে সিপিবির কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তারা এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে।
বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ লিখিত বক্তব্যে বলেন, “১৪ অক্টোবর প্রেরিত চূড়ান্ত কপিতে আমাদের নোট অব ডিসেন্ট যুক্ত করা হলেও সেসবের যথাযথ ব্যাখ্যা নেই। সনদের পটভূমিতে স্বাধীনতার ইতিহাস সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ বাদ দেওয়া হয়েছে, যা ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের ভিত্তি। এসব বিষয় নিষ্পত্তি না হওয়ায় আমাদের পক্ষে সনদে সই করা সম্ভব নয়। ”
তবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, “কমিশন আশা করে এনসিপিসহ সব রাজনৈতিক দল সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যোগ দেবে, স্বাক্ষর করবে এবং বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবে। আমরা মনে করি, সনদের আইনি ভিত্তি থাকা জরুরি, এবং সে বিষয়ে কমিশন একটি পূর্ণাঙ্গ সুপারিশ পেশ করবে। ”
তিনি আরও বলেন, “এনসিপি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অগ্রগামী শক্তি, তাদের অবদান আমরা গভীরভাবে স্বীকার করি। তবে এই সনদ জাতির নতুন যাত্রার প্রতীক—এটি সবাই মিলে উত্সবমুখর পরিবেশে স্বাক্ষর করলে তবেই অর্থবহ হবে। ”
এসবিডব্লিউ/এমজেএফ