ঢাকা: জুলাই আন্দোলনের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারদলীয় সশস্ত্র নেতাকর্মীরা দেশের কমপক্ষে ৪১ জেলায় ৪৩৪ স্পটে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে। ৫০টিরও অধিক জেলায় আন্দোলনকারীদের উপর লেথাল উইপেন (মারণাস্ত্র) ব্যবহার করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর) জুলাই আন্দোলনে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অভিযুক্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ৫৪তম সাক্ষী তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ এই তথ্য উপস্থাপন করেন।
এ সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম, তানভীর হাসান জোহা ও আবদুস সাত্তার পালোয়ান। আসামিপক্ষে ছিলেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন।
শেখ হাসিনার মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর তার তৃতীয় দিনের জবানবন্দির শুরুতে বলেন, আমার তদন্তকালে আমি পেয়েছি জুলাই ২০২৪ আন্দোলনের তৎকালীন সরকার যত ধরনের খুন, জখম, অপহরণ ও নির্যাতন করেছে, তার মূল উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতায় টিকে থাকা। এছাড়া গত ১৫ বছর ধরে সরকার ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য জঙ্গি নাটক, জোরপূর্বক অপহরণ ও পাতানো নির্বাচনসহ সবকিছুর মূলে ছিল ক্ষমতায় টিকে থাকা।
জবানবন্দিতে তদন্ত কর্মকর্তা আরও বলেন, জুলাই অভ্যুত্থান চলাকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারদলীয় সশস্ত্র নেতাকর্মীরা দেশের কমপক্ষে ৪১ জেলায় ৪৩৪টি স্পটে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে। ৫০টিরও অধিক জেলায় আন্দোলনকারীদের উপর লেথাল উইপেন (মারণাস্ত্র) ব্যবহার করা হয়েছে। এই আন্দোলনকারীদের সকলেই সাধারণ নিরীহ, নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা। আন্দোলনকারীদের শনাক্ত করতে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা ও এনটিএসসি মতো প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করা হয়েছে। মোবাইল ট্র্যাকিং করে আন্দোলনকারীদের অবস্থান শনাক্ত করে, হত্যা, জখম, গ্রেপ্তার ও অন্যায় আটকের মতো ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এই আন্দোলনে আক্রমণকারী ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারদলীয় সশস্ত্র ক্যাডার। অপরদিকে আন্দোলনকারীরা ছিল সাধারণ নিরীহ, নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা। এর মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে, জুলাই গণআন্দোলন চলাকালে যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তা ছিল ব্যাপক মাত্রার, পদ্ধতিগত এবং সাধারণ মানুষের উপর লক্ষ্যভিত্তিক নিপীড়ন।
জুলাই আন্দোলন দমনে পরিকল্পিতভাবে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করা হয়েছিল বলেও জবানবন্দিতে তুলে ধরেন তদন্ত কর্মকর্তা।
জবানবন্দি দেওয়ার সময় তদন্ত কর্মকর্তা বিবিসি বাংলা ও আল জাজিরায় প্রচারিত দুটি ভিডিও অনুসন্ধানী প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন।
বিবিসি বাংলার প্রচারিত ৩৫ মিনিট ৩৫ সেকেন্ডের ওই প্রতিবেদনে আশুলিয়ায় পুলিশের পিকআপ ভ্যানে লাশ পুড়িয়ে ফেলার দৃশ্য, রংপুরে পুলিশ কর্তৃক আবু সাঈদকে কাছ থেকে গুলির দৃশ্য, সাভারে আসহাবুল ইয়ামিনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পুলিশের এপিসি থেকে ফেলে দেওয়ার দৃশ্য এবং শেখ হাসিনার কর্তৃক লেথাল উইপেন (মারণাস্ত্র) ব্যবহার করে সোজা গুলি করার নির্দেশ সংক্রান্ত অডিও দৃশ্য দেখানো হয়।
আল জাজিরায় প্রচারিত ৪৯ মিনিট ৫৫ সেকেন্ডের প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের রাজাকারের নাতিপুতি বলার দৃশ্য, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী ইনানের সঙ্গে শেখ হাসিনার কথোপকথন, আবু সাঈদের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকসহ বেশ কয়েকটি সাক্ষাৎকার ও আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে পুলিশের গুলি চালানোর দৃশ্য দেখা যায়।
মামলার শেষ সাক্ষী ও তদন্ত কর্মকর্তার জবানবন্দি শেষে প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামীম সাংবাদিকদের জানান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মামলায় ৫৪তম সাক্ষী হিসেবে এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তার জবানবন্দি প্রদান সমাপ্ত করেছেন। ডিফেন্স কাউন্সিলের পক্ষ থেকে একটি প্রশ্নের মাধ্যমে জেরা শুরু হয়েছে এবং আগামী সোমবার এই মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তার পরবর্তী জেরা চলবে।
তিনি বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা তদন্তকালে ৯২টি ডকুমেন্টারি এভিডেন্স সংগ্রহ করেছেন। এই গুলো তিনি তার জবানবন্দির সময় উপস্থাপন করেছেন। এছাড়া সিডি, ডিভিডি, পেনড্রাইভ ও বিভিন্ন বই সংক্রান্ত ৩৭টি বস্তু প্রদর্শনী দাখিল করেছেন। সব মিলিয়ে প্রায় ১৪ হাজার পৃষ্ঠার ডকুমেন্টারি এভিডেন্স দাখিল করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে একটা সাধারণ অপরাধ মানবতাবিরোধী অপরাধে পরিণত হতে গেলে যে দুটি উপাদান লাগে, এর একটি হলো ওয়াইড স্প্রেডলি (ব্যাপকভাবে) এটা ঘটতে হয়, মানে দেশব্যাপী ব্যাপক মাত্রায় হতে হয়। আরেকটি হলো সিস্টেমেটিকভাবে (পদ্ধতিগতভাবে) হতে হয়।
গাজী তামীম আরও বলেন, পদ্ধতিগতভাবে ব্যাপক মাত্রায় হয়েছে, তার প্রমাণ হলো ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫০টির অধিক জেলায় আন্দোলন হয়েছে এবং আন্দোলনে নির্যাতন, নিপীড়ন, গুলিবর্ষণ হয়েছে এবং তার মধ্যে ৪১টি জেলাতেই হত্যা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সিস্টেমেটিক হয়েছে কেন, তদন্ত কর্মকর্তা সে বিষয়ে তার বর্ণনায় বলেছেন—এখানে যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে তারা সকলেই একই গোষ্ঠীর, অর্থাৎ তারা সকলেই ছিল আন্দোলনকারী। আর যারা এখানে আক্রমণকারী তাদেরও পরিচয় একটি—তারা হলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য। এছাড়া তারা দলীয় আওয়ামী লীগ বা ১৪ দলীয় জোটের সন্ত্রাসী অথবা সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, এটি সিস্টেমেটিক ছিল। জুলাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালে সংঘটিত অপরাধগুলো যে মানবতাবিরোধী অপরাধ, এসব উপাদানের মাধ্যমে তা প্রমাণিত হয়।
এ মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়া অপর দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
এ মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন তদন্ত সংস্থার উপপরিচালক মো. জানে আলম খান। পরে তদন্ত করেন উপপরিচালক মো. আলমগীর। সার্বিক সহযোগিতা করেছিলেন বিশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা তানভীর হাসান জোহা। এ ঘটনায় তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর গত ১২ মে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরবর্তীতে ৩১ মে সম্পূরক অভিযোগ দেওয়া হয়। ১ জুন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়।
গত ১০ জুলাই এ মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। একইসঙ্গে সাবেক আইজিপি মামুন নিজেকে ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হিসেবে যে আবেদন করেছেন, তা মঞ্জুর করেন ট্রাইব্যুনাল।
ইএস/এসআইএস