চা অধ্যুষিত এলাকা মৌলভীবাজার জেলায় ৯৩টি চা-বাগান রয়েছে। এসব চা-বাগানের মধ্যে অধিকাংশ চা-বাগানের কিশোরীরাই স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সচেতন নয়।
আবার কোনো পরিবারে কাজের লোক থাকে না। তবে খাওয়ার লোক অনেকজন থাকে। যেখানে খাবারেরই সমস্যা দেখা যায়, সেখানে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করা তো দূরের কথা। স্যানিটারি ন্যাপকিনের বদলে অনেকেই কাপড় ব্যবহার করেন। তাতে নানা ধরনের সংক্রমণ ছড়ায় এবং জরায়ু ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
এবার বসুন্ধরা শুভসংঘ শ্রীমঙ্গল শাখার পক্ষ থেকে চা-বাগানে সুবিধাবঞ্চিত কিশোরী ও নারীদের মাঝে পিরিয়ডকালীন পরিচ্ছন্নতা ও সুরক্ষার ব্যাপারে জনসচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিনা মূল্যে বিতরণ কর্মসূচি পালন করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় আজ সোমবার (২৬ মে) সকালে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা লাখাইছড়া চা-বাগান এলাকায় বসুন্ধরা শুভসংঘ শ্রীমঙ্গল শাখার পক্ষ থেকে বিনা মূল্যে ৩০ জন চা শ্রমিকের সন্তান স্কুলপড়ুয়া কিশোরী এবং চা শ্রমিক নারীদের মাঝে বসুন্ধরার মোনালিসা স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণ করা হয়।
অনুষ্ঠানে দৈনিক কালের কণ্ঠের জেলা প্রতিনিধি মো. সাইফুল ইসলামের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সিনথিয়া তাসমিন।
বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সহসভাপতি পঙ্কজ কন্দ। লাখাইছড়া চা-বাগানের পঞ্চায়েত সভাপতি গণপত বৈদ্য। এ সময় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন লাখাইছড়া চা-বাগানের সমাজসেবক উজ্জ্বল হাজরা, স্কুলশিক্ষার্থী শ্রাবণী তাঁতি প্রমুখ। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বসুন্ধরা শুভসংঘের শ্রীমঙ্গল শাখার সভাপতি মোহাম্মদ আল আমিন, সহসভাপতি মো. শামসুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক সুজন মিয়া, তপন বৈদ্য প্রমুখ।
স্কুল শিক্ষার্থী শ্রাবণী তাঁতি বলেন, ‘বসুন্ধরা শুভসংঘকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমাদেরকে স্যানিটারি ন্যাপকিন দেওয়ার জন্য।
স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করি এবং জানিও যে এটা ব্যবহার করা খুবই দরকার। এটি ব্যবহারে আমাদের অসুখ-বিসুখ ও জরায়ু রোগমুক্ত থাকে। ’
লাখাইছড়া চা-বাগানের সমাজসেবক উজ্জ্বল হাজরা বলেন, ‘আমাদের চা বাগানে এ ধরনের সুযোগ-সুবিধা করে দিয়েছে বসুন্ধরা শুভসংঘ। আমাদের মা-বোনেরা স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করতে জানে না। কিন্তু বসুন্ধরা শুভসংঘ যে উদ্যোগ নিয়ে দেখিয়েছে, এটার কারণে তারা এটা ব্যবহার করতে শিখবে, ফলে অনেক অসুখ-বিসুখ থেকে মুক্ত থাকবে। বসুন্ধরা শুভসংঘের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। ’
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সহসভাপতি পঙ্কজ কন্দ বলেন, ‘বসুন্ধরা শুভসংঘ এবং এর সঙ্গে যারা যারা জড়িত আছেন, তাদের সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। আমাদের এই লাখাইছড়া চা-বাগানের কিশোরীরা আছে, তারপর বোনেরা ও মায়েরা আছে তাদের স্বল্প মজুরি থাকার কারণে অনেকেই এ বিষয়ে খুবই অসচেতন, তার জন্য তাদের অনেক সমস্যা হয়। অনেক সময় তাদের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না থাকার ফলে অনেক সময় স্যানিটারি ন্যাপকিন ক্রয় করতে পারে না। চা-বাগানের চা শ্রমিকেরা যে দশায় বা যে অবস্থায় আছে- হয়তো মায়েরা, বাবারা সেভাবে জোগান দিতে পারেন না। তাই তারা অনেক সময় এই যে স্যানিটারি ন্যাপকিনের যে ব্যবস্থা আছে, তার ব্যবস্থা করতে পারেন না। ’
তিনি আরো বলেন, ‘আজ বসুন্ধরা শুভসংঘ যে উদ্যোগ নিয়েছে আশা করি আমাদের কিশোরীরা সচেতন হবে এবং স্বাস্থ্যগত দিক থেকে বসুন্ধরা শুভসংঘ এভাবে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় তাহলে আমাদের মা জাতির, নারী জাতির যে সমস্যাগুলো রয়েছে, এটা ব্যবহারের ফলে যে উপকারিতা এবং এটা ব্যবহার না করার ফলে যে অসুখ-বিসুখের সমস্যা সৃষ্টি হয়, এগুলো সম্পর্কে সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড যদি তারা (বসুন্ধরা শুভসংঘ) করেন, আশা করি আমাদের সমস্ত চা-বাগানের মেয়েরা এবং কিশোরীরা, মায়ের জাতিরা তারা এটা পেয়ে উপকৃত হবেন। ’
শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সিনথিয়া তাসমিন বলেন, ‘প্রথমেই বসুন্ধরা শুভসংঘকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি এই মহতী উদ্যোগ নেওয়ার জন্য। প্রথমে স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্রাইজ দেখলাম, এখানকার মানুষ স্বল্পমূল্যে এই স্যানিটারি ন্যাপকিনটা ইউজ করতে পারবে। এটা খুবই ভালো একটা উদ্যোগ। ’
তিনি বলেন, ‘জরায়ুমুখে যে ধরনের সমস্যা হয়, যেমন- ক্যান্সার হতে পারে, তারপর বিভিন্ন রকমের ইনফেকশন ডিজিজগুলো ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসের মাধ্যমে হয়, এগুলো সাধারণত হবে না। এটা হচ্ছে সচেতনতামূলকভাবে সবাই যাতে ভালোভাবে ইউজ করতে পারে, সে জন্য আমি সবাইকে বলব, যারা এই বয়সে কিশোরী আছে, তারা যাতে তাদের এই মাতৃত্বকালীন শুরুটা, সেটা যাতে সুন্দরভাবে ভালো স্যানিটেশনের মাধ্যমে শুরু করতে পারে এবং এটা যদি ইউজ করে, তাহলে বিভিন্ন রকম রোগ প্রতিরোধের ব্যাপারে সহজেই কিশোরী মেয়েদের সচেতন করতে পাররে এবং ভবিষ্যতে যাতে ভালো মা তৈরি হতে পারে, এখন থেকে এই উদ্যোগটা শুরু হোক। ’
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জেলায় কোনো বিদ্যালয়ে নেই মেয়েদের জন্য হাইজিন কর্নার। চা-বাগান এলাকায় সরকারি স্কুলে এ অবস্থা আরো ভয়াবহ। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সব কিছুর উন্নতি হলেও অন্তরালে রয়ে যাচ্ছে কিশোরীদের ঋতুকালীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি। মৌলভীবাজার বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই কিশোরীদের মাসিক ব্যবস্থাপনা। নেই পৃথক হাইজিন কর্নার ও পর্যাপ্ত শৌচাগার। বেশির ভাগ স্কুলে নেই টিস্যু পেপার ও হ্যান্ডওয়াশ বা সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা। শৌচাগারের ভেতরে নেই পর্যাপ্ত আলো-বাতাস। বেশির ভাগ স্কুলের ওয়াশরুমে নেই ঢাকনাযুক্ত ডাস্টবিন।
এনডি