ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ বৈশাখ ১৪৩২, ০৮ মে ২০২৫, ১০ জিলকদ ১৪৪৬

মুক্তমত

খালেদা জিয়ার সুস্থতা এবং আগামী রাজনীতি

মন্জুরুল ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০:০৩, মে ৮, ২০২৫
খালেদা জিয়ার সুস্থতা এবং আগামী রাজনীতি মন্জুরুল ইসলাম

ঢাকা: ‘এই যে শুনি, এই মরে মরে, এই যায় যায়। বয়স তো আশির ওপরে।

এমনিতেই তো মরার সময় হয়ে গেছে। তার মধ্যে অসুস্থতা। এখানে এত কান্নাকাটি করে তো লাভ নাই। এখন উনি সেজেগুজে মেকআপ নিয়ে, ভ্রু ট্রু এঁকে হাসপাতালে যান। আর এদিকে তাঁর ডাক্তার আবার রিপোর্ট দেয়, খুব নাকি খারাপ অবস্থা। এই নাকি যায় যায়। ’ বাংলাদেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, সাবেক রাষ্ট্রপতি, সেক্টর কমান্ডার এবং স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে এভাবেই কথা বলেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০২২ সালের ৩০ আগস্ট ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ আয়োজিত শোক দিবসের অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা এভাবেই অশালীন, অমানবিক, কুরুচিপূর্ণ ও দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা বলেছিলেন।

তিনি বেগম জিয়াকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ দেননি। শুধু শেখ হাসিনা নন, দেশের অন্যতম অভিজাত ইউনাইটেড হাসপাতালও খালেদা জিয়ার চিকিৎসা করেনি। এমনকি খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য একটি অ্যাম্বুলেন্সও দেয়নি। জুলাই বিপ্লবের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে ৮ জানুয়ারি তিনি চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান এবং শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে সুস্থ হয়ে মঙ্গলবার ৬ মে দেশে ফেরেন। কথায় বলে, রাখে আল্লাহ মারে কে। সুস্থ হয়ে খালেদা জিয়ার দেশে ফেরা বাংলাদেশের জনগণ এবং বর্তমান সময়ে দেশের রাজনীতির জন্য অনেক বড় সুখবর। রাষ্ট্র সংস্কার, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন এবং জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার বর্তমান প্রক্রিয়ায় তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে দেশবাসী প্রত্যাশা করছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুজন নারী দুটি বড় দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দুই নেত্রীর রাজনৈতিক চিন্তার মধ্যে আকাশপাতাল ফারাক। শেখ হাসিনা মনে করেন, এ দেশ তার পিতা স্বাধীন করেছেন; সুতরাং এটা তার পৈতৃক সম্পত্তি। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত তিনি সেভাবেই দেশটা শাসন করেছেন। তিনি ছিলেন প্রচণ্ড প্রতিহিংসাপরায়ণ। পিতা-মাতাসহ পরিবারের সদস্যদের হত্যার প্রতিশোধ নেওয়াই ছিল তার রাজনীতির একমাত্র লক্ষ্য। অন্যজন বেগম খালেদা জিয়া একজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন সেক্টর কমান্ডার এবং একজন সাবেক রাষ্ট্রপতির স্ত্রী। তিনি ছিলেন নিরেট গৃহবধূ। রাজনীতিতে তাঁর আগ্রহ ছিল না। স্বামীর মৃত্যুর পর দলীয় নেতা-কর্মীর চাপ ও ভালোবাসায় তিনি রাজনীতিতে আসেন। তিনি তাঁর দীর্ঘ ৪৩ বছরের রাজনৈতিক জীবনে জাতীয়তাবাদী নীতি-আদর্শে আপসহীন থেকেছেন। কিন্তু কখনো প্রতিহিংসাপরায়ণ ছিলেন না। এমনকি কোনো মানুষের প্রতি কোনোরকম অসৌজন্যমূলক কথা বা রূঢ় আচরণও করেননি।

মন্জুরুল ইসলাম১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে যখন হত্যা করা হয়, তখন খালেদা জিয়া ছিলেন নিতান্তই একজন গৃহবধূ। দুই শিশু সন্তান তারেক রহমান (পিনো) এবং আরাফাত রহমানকে (কোকো) নিয়ে তখন ঢাকা সেনানিবাসে মইনুল রোডের বাসায় অবস্থান করছিলেন। রাজনৈতিক দল বিএনপি তখন বিপর্যস্ত। দলের নেতা-কর্মীরা ছিলেন দিশাহারা। স্বামীর লাশ দাফন করে একদিকে দুই শিশু সন্তান, অন্যদিকে বিএনপির লাখ লাখ নেতা-কর্মী নিয়ে কী করতে হবে তা নিয়ে বেগম জিয়া ছিলেন রীতিমতো কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তবে রাজনীতির প্রতি খালেদা জিয়ার তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। এক পর্যায়ে মানসিক ধকল কাটিয়ে ১৯৮২ সালের ৭ নভেম্বর স্বামী জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা জানিয়ে রাজনীতির ভুবনে প্রবেশ করেন। ওই দিনই তিনি প্রথম নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন। তারপর তো সবই ইতিহাস। একজন গৃহবধূ থেকে তিনবারের প্রধানমন্ত্রী।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বেগম জিয়াকে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার করা হয়। কারাগারে তিনি অনেকবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য ২০২১ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে ১৮ বার আবেদন করা হয়। কিন্তু বেগম জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে দেওয়া হয়নি। বরং অমানবিক, অশোভন ও বিকৃত শব্দচয়ন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার অমার্জনীয় বক্তব্য দিয়েছেন। অথচ বেগম জিয়া বলেছিলেন, তিনি শেখ হাসিনাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। ২০১৭ সালের ৯ মে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থনে চতুর্থ দিনের বক্তব্য দিতে গিয়ে আদালতকে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনার প্রতি প্রতিহিংসামূলক আচরণ করবেন না তিনি। প্রতিহিংসার রাজনীতিও করবেন না। শেখ হাসিনাকে তিনি ক্ষমা করে দিয়েছেন। ফখরুদ্দীন-মইন উদ্দিনের সঙ্গে কোনো সমঝোতা করিনি। তারা আমার সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করেছিল। নানা রকম প্রস্তাব আমার কাছে এসেছিল। আমি তাতে রাজি হইনি। জানিয়েছিল জরুরি অবস্থা তুলে দিয়ে তারা নির্বাচনে যেতে চায়। আওয়ামী লীগ তাদের সঙ্গে সমঝোতা করে, গোপন আঁতাত করে ক্ষমতায় গিয়েছিল। সংবিধান ও গণতন্ত্রের স্বার্থে ফলাফল মেনে নিয়েছিলাম। সরকারকে সহযোগিতার কথা বলেছিলাম। কিন্তু আমাদের সহযোগিতার আচরণের বিনিময়ে তারা কী আচরণ করেছে, তা সবারই জানা। প্রতিহিংসার বিপরীতে সংযম ও সহিষ্ণুতার পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা আমরা বারবার করে এসেছি। কিছুদিন আগেও আমি সংবাদ সম্মেলনে অতীতের তিক্ততার কথা তুলে ধরেছি। আমার ও শহীদ জিয়ার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার ক্রমাগত অশোভন উক্তি, প্রতিহিংসামূলক বৈরী আচরণ সত্ত্বেও আমি ক্ষমা করে দিয়েছি। আমি তার প্রতি কোনো প্রতিহিংসামূলক আচরণ করব না। ’

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার মতো একমাত্র নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি। দেশের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের প্রতি বেগম জিয়ার অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও সৌজন্যবোধ বরাবরই লক্ষ করা গেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিও তিনি ছিলেন আন্তরিক ও শ্রদ্ধাশীল। ওয়ান-ইলেভেনের পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকে ড. ইউনূসের প্রতি শেখ হাসিনা ছিলেন চরম বিদ্বেষী। রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে শেখ হাসিনা রাজনৈতিক শত্রু মনে করতেন। আর ড. ইউনূসকে মনে করতেন ব্যক্তিগত শত্রু। মনস্তাত্ত্বিকভাবেই ড. ইউনূসের নোবেল প্রাপ্তির বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি শেখ হাসিনা। সে কারণেই ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত শান্তিপ্রিয় নোবেলজয়ী প্রফেসর ইউনূসকে এক দিনও শান্তিতে থাকতে দেননি। শেখ হাসিনা আর কিছুদিন ক্ষমতায় থাকলে হয়তো ড. ইউনূসকে জেলেই থাকতে হতো। যা হোক, মানীর মান আল্লাহই রাখেন।

ড. ইউনূসকে নিয়ে যখন হীন ষড়যন্ত্র শুরু করেন শেখ হাসিনা, তখন ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে বেগম খালেদা জিয়া তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। ড. ইউনূসকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে খালেদা জিয়া সেদিন বলেছিলেন, ‘শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ইউএস কংগ্রেশনাল অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হয়েছেন। এজন্য জাতি হিসেবে আমরা গর্বিত। তবে স্বদেশে তিনি যেভাবে নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন, তা সত্যিই দুঃখজনক। তাঁর মেধা, শ্রম ও ঘামে প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকও হুমকির মুখে। সরকার নিয়োজিত কমিশন নোবেলজয়ী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংককে ভেঙে ১৯ টুকরো করার সুপারিশ করেছে। আমরা এতে স্তম্ভিত। এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রামীণ ব্যাংককে ধ্বংস করে ফেলবে। ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নে এ ব্যাংক  গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। সেই প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের উদ্দেশ্যে প্রতিশোধমূলক চক্রান্ত বন্ধের জন্য আমি সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা এর তীব্র বিরোধিতা করছি। দেশের মানুষ এ ধরনের হীন কার্যকলাপ মেনে নেবে না। ’

নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর প্রতি বেগম খালেদা জিয়ার সমর্থন ও শ্রদ্ধার বিষয়টি নিশ্চয় মনে রেখেছেন। সে কারণে গত ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবসে সেনাকুঞ্জে বেগম জিয়ার উপস্থিতি নিশ্চিত করেছিলেন। সেদিন  প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ‘খালেদা জিয়াকে আনতে পেরে আমরা গর্বিত। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এখানে এসেছেন। এক যুগ তিনি আসার সুযোগ পাননি। আমরা গর্বিত এ সুযোগ দিতে পেরে। ’ খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে তিনি আরও বলেন, ‘দীর্ঘদিনের অসুস্থতা সত্ত্বেও বিশেষ দিনে সবার সঙ্গে শরিক হওয়ার জন্য আপনাকে আবারও ধন্যবাদ। আপনার আশু রোগমুক্তি কামনা করছি। ’

একই দেশের একজন সরকারপ্রধান সাবেক সরকারপ্রধানকে নিয়ে গর্ববোধ এবং তাঁর রোগমুক্তি কামনা করেন। আরেক সরকারপ্রধান সাবেক সরকারপ্রধানকে চিকিৎসার সুযোগ না দিয়ে বরং মৃত্যু কামনা করেন। কী অদ্ভুত দুনিয়া!

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার এখন রাষ্ট্র সংস্কার, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, আইনের শাসনসহ দেশের জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে। ড. ইউনূস বিদ্যায় একজন অতুলনীয় পণ্ডিত ব্যক্তি। সম্মানের বিচারে তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন, সর্বজনশ্রদ্ধেয় ‘গ্লোবাল আইকন’। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় তিনি নবীন। অন্যদিকে বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতির শিক্ষায় পোড় খাওয়া অভিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ মানুষ। দুজনই দেশবাসীর কাছে শ্রদ্ধেয়। দেশের বর্তমান সংকট উত্তরণে এ দুজনের সমন্বিত উদ্যোগ ও প্রয়াসের কোনো বিকল্প নেই। রাজনীতিতে অভিজ্ঞ বেগম খালেদা জিয়ার উপদেশ, পরামর্শ ও সহযোগিতা নিয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের সর্বোত্তম কাজটি যদি ড. মুহাম্মদ ইউনূস শেষ করতে পারেন, তাহলে এ দুজনকেই জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। বাংলাদেশের মানুষ ভালো কাজের জন্য কারও প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনে কার্পণ্য করে না। আবার কারও অপকর্মের জন্য তাকে ছুড়ে ফেলতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।