ঢাকা, শুক্রবার, ৬ ভাদ্র ১৪৩২, ২২ আগস্ট ২০২৫, ২৭ সফর ১৪৪৭

জাতীয়

সরকারি প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে একগুচ্ছ সুপারিশ

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:১৯, আগস্ট ১৯, ২০২৫
সরকারি প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে একগুচ্ছ সুপারিশ মোংলা-(ফাইল ফটো)

ঢাকা: প্রকল্প পরিকল্পনা, অনুমোদন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় সমস্যা চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধানের পথে হাঁটছে অন্তর্বর্তী সরকার। সুনির্দিষ্ট প্রকল্প নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই তা শেষ করায় জোর দিচ্ছে তারা।

যোগ্য ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের নিয়ে পিডি পুল গঠনসহ সরকারি প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে একগুচ্ছ সুপারিশ এসেছে সরকারের উচ্চপর্যায়ের এক কর্মশালায়।

মঙ্গলবার (১৯ আগস্ট) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উদ্যোগে এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের ব্যবস্থাপনায় সাড়ে চার ঘণ্টার কর্মশালায় বেশির ভাগ উপদেষ্টা, বিশেষ সহকারী, সিনিয়র সচিব, সচিব এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তারা অংশ নেন। পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এবং অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ কর্মশালায় চালকের ভূমিকায় ছিলেন।

সূত্র জানায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রকল্পের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৪৫৪টি। এসব প্রকল্পের মধ্যে ৬৬৮টি প্রকল্প পরিদর্শন করা হয়েছে। নিবিড় পরিবীক্ষণ করা হয়েছে ৫৫টি। আর প্রভাব মূল্যায়ন করা হয়েছে ২১টির।

সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্প প্রণয়ন পর্যায়ের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে৷ এসব সমস্যার মধ্যে প্রকল্পে যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই না করা, অংশীজনদের পরামর্শ না থাকা, ভৌত কাজের যথাযথ আর্কিটেকচারাল এবং ডিজাইন না থাকায় বাস্তবায়ন পর্যায়ে ভেরিয়েশনের উদ্ভব হওয়া, প্রকল্পের সঠিক লজিক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক প্রণয়ন না করা, প্রকল্প প্রাক্কলনে যৌক্তিক ব্যয় নির্ধারণ করা, পরিবেশগত বিষয় বিবেচনা না করা, প্রকল্পের মাস্টার প্ল্যান অনুসরণ না করা, পরামর্শ প্রতিষ্ঠানের ওপর অধিক মাত্রায় নির্ভরশীলতা, প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারণের ক্ষেত্রে যথাযথ মডেল ব্যবহার না করা, পিইসি বা ডিপিইসি সভায় আইএমইডি এর প্রতিনিধির মতামত যথাযথভাবে প্রতিফলিত না হওয়ার বিষয়গুলো উঠে এসেছে৷

এসব সমস্যা সমাধানের জন্য পরিপত্র অনুযায়ী দক্ষ ও নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ দ্বারা প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে৷ অংশীজন চিহ্নিত করে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করা আবশ্যক করার সুপারিশ করা হয়েছে৷ যথাযথভাবে প্রকল্পের লজিক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক প্রণয়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে৷ এছাড়া প্রকল্পের যৌক্তিক ব্যয় প্রাক্কলন নির্ধারণ করার কথা বলা হয়েছে৷

প্রতিটি প্রকল্পে ইকোলজি বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে, মাস্টার প্ল্যান অনুসরণ করে নির্মাণ বিষয়ক ড্রয়িং ডিজাইন করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে৷ প্রতিটি প্রকল্পে সংস্থার সক্ষমতা বিবেচনা করে যুক্তিসংগত প্রকল্প গ্রহণ এবং প্রকল্পে সুনির্দিষ্ট কম্পোনেন্ট রাখা যার মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, একই সঙ্গে পরামর্শ প্রতিষ্ঠানের ওপর অধিক মাত্রায় নির্ভরশীলতা কমানোর কথা বলা হয়েছে৷ এছাড়া পিইসি সভায় আইএমইডির প্রতিনিধিদের উপস্থাপিত মতামতকে আমলে নেওয়ার জোর সুপারিশ করা হয়েছে৷

কর্মশালায় যেসব সমস্যা চিহ্নিত হয়েছে
কর্মশালায় যথাযথ সম্ভাব্যতার সমীক্ষা না করেই প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে বলে উঠে এসেছে। অংশীদারদের পরামর্শ না থাকা, ভৌত কাজের যথাযথ এবং স্ট্রাকচারাল ডিজাইন না থাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে ভেরিয়েশনের উদ্ভব হয় বলে জানানো হয়েছে। প্রকল্পের সঠিক লজিক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক প্রণয়ন না করা, প্রকল্প প্রাক্কলনে অযৌক্তিক ব্যয় নির্ধারণ, পরিবেশগত বিষয় বিবেচনা না করা, মাস্টারপ্ল্যান অনুসরণ না করা, পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ওপর অধিক মাত্রায় নির্ভরশীলতাকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পূর্ণকালীন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ না করা, একই ব্যক্তির একাধিক প্রকল্পে দায়িত্ব পালন, অভিজ্ঞ প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ না করা, ঘনঘন প্রকল্প পরিচালক বদলি, ভূমি অধিগ্রহণ এবং ইউটিলিটি সার্ভিস শিফটিং সংক্রান্ত সমন্বয়হীনতা, প্রকল্পের এক্সটার্নাল অডিট নিয়মিত না হওয়া, বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সম্মতি পেতে বিলম্ব হওয়াকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্বীকৃত মডেল ব্যবহার না করা, পিইসি বা ডিপিইসি সভায় আইএমইডির প্রতিনিধির মতামত যথাযথভাবে প্রতিফলিত না হওয়া; প্রকল্পের ওয়ার্কপ্ল্যান এবং প্রোকিউরমেন্ট যথাযথভাবে প্রণয়ন, সঠিকভাবে অনুসরণ ও মনিটরিং না করাকেও সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর বাইরে ব্যয় না বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব যথাসময়ে না পাওয়া, আইএমইডির ই-পিএমআইএস সফটওয়্যারে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সব তথ্য যথাসময়ে আপলোড না করা, যথাসময়ে প্রকল্প সমাপ্তির প্রতিবেদন আইএমইডিতে দাখিল না করা, সমাপ্ত প্রকল্পের আওতায় সৃষ্ট অবকাঠামো ও সংগৃহীত যন্ত্রপাতি যথাযথভাবে সংরক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ না করা, প্রকল্পবিশেষ জনবলের সংস্থান না থাকা এবং যথাসময়ে জনবল নিয়োগ না করাকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

সমস্যা সমাধানের পথ 
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য ইকোলজি বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা; মাস্টার প্ল্যান অনুসরণ করে নির্মাণ বিষয়ক ড্রয়িং ডিজাইন করা; সংস্থার সক্ষমতা বিবেচনা করে যুক্তিসংগতভাবে প্রকল্প গ্রহণ এবং প্রকল্পে সুনির্দিষ্ট কম্পোনেন্ট রাখা, প্রস্তাবিত প্রকল্প দলিলের সংযোজনীতে কী প্রক্রিয়ায় মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে তা তুলে ধরার সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রকল্প সমাপ্তির তিন মাসের মধ্যেই পিসিআর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগ কর্তৃক আইএমইডিতে পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করা, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের রাজস্ব বাজেটের অধীন প্রকল্পের আওতায় সৃষ্ট অবকাঠামো এবং সংগৃহীত যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং প্রকল্পের সুফল টেকসই করার লক্ষ্যে জনবল কাঠামো অনুমোদন ও প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগে সংস্থা কর্তৃক যথাসময়ে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ এসেছে কর্মশালায়। এছাড়া কর্মশালায় ভূমি অধিগ্রহণ এবং ইউটিলিটি সার্ভিস শিফটিং সংক্রান্ত পৃথক প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে।

কর্মশালায় প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে সমস্যা এবং সম্ভাব্য সমাধান
যথাসময়ে প্রকল্প সমাপ্তি প্রতিবেদন বা পিসিআর আইএমইডিতে দাখিল না করা একটি বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে৷ এ সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে প্রকল্প সমাপ্তির তিন মাসের মধ্যে আইএমইডিতে পিসিআর প্রেরণের বিষয়টি নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে৷ প্রকল্পে বিশেষ জনবলের সংস্থান না থাকা এবং জনবল নিয়োগ না করাও সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তবে এ সমস্যার সমাধান হিসেবে প্রকল্পের সুফল টেকসই করার লক্ষ্যে জনবল কাঠামো অনুমোদন ও প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ সংস্থা কর্তৃক যথাসময়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে৷

প্রকল্প বাস্তবায়ন-পরবর্তী পর্যায়ে আরও বেশ কিছু সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে
এর মধ্যে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে অকুপেন্সি সার্টিফিকেট সংক্রান্ত বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডের শর্ত না মানাকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে৷ এ সমস্যা সমাধানে নির্মাণকারী সংস্থা কর্তৃক ব্যবহারকারী সংস্থাকে নির্মাণধর্মী স্থাপনা হস্তান্তরের সময় অবশ্যই অকুপেন্সি সনদ প্রদান করার কথা বলা হয়েছে।  

সর্বশেষ প্রকল্প সমাপ্তির পর যানবাহন সরকারি নির্দেশনা অনুসরণ করে পরিবহনপুলে জমা না দেওয়া একটি বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ সমস্যার সমাধান হিসেবে বিদ্যমান সরকারি নিয়ম অনুযায়ী প্রকল্পের আওতায় যে সমস্ত যানবাহন নেওয়া হয়েছে সেগুলোকে সরকারি পরিবহন পুলে জমা দেওয়া আবশ্যক করা হয়েছে।

এছাড়া প্রকল্প নেওয়ার আগে টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করে পরিকল্পনা বিভাগের গাইডলাইন মোতাবেক সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রস্তুতির ব্যবস্থা করার সুপারিশ করা হয়েছে। প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ সংক্রান্ত পরিপত্র অনুযায়ী প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে পিডি পুল গঠন করা এবং পুলভুক্ত কর্মকর্তাদের ফাইন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট, প্রোকিওরমেন্ট ম্যানেজমেন্ট ও প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট বিষয়ক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ; প্রকল্প বাস্তবায়নে নিবিড় মনিটর নিশ্চিত করা; আইএমইডির ই-পিএমআইএস সফটওয়্যারে সকল প্রকল্পের তথ্য হালনাগাদ নিশ্চিত করা; প্রকল্পের পিএলসি ও পিআইসি সভা করা ও সভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন মনিটরিং করা এবং প্রকল্প শেষ হওয়ার আগেই প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে টেকসইকরণের জন্য সাংগঠনিক কাঠামো এবং জনবল নিয়োগের বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশিদ বলেন, কর্মশালায় প্রকল্প বিষয়ক নিয়মকানুনগুলো সম্পর্কে সবাইকে জানানো হয়েছে। যার যতটুকু কনফিউশন বা সমস্যা ছিল সেগুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। উপদেষ্টাসহ কর্মশালায় অংশ নেওয়া সকলেই তাদের মতামত দিয়েছেন। প্রকল্প ব্যবস্থাপনা আরও স্মুথ এবং স্মার্ট হোক আমরা সকলেই এটা চেয়েছি। এ জন্য এ বিষয়ে যেসব পয়েন্ট উঠেছে সেসব পয়েন্টের ওপর সবাই কথা বলেছেন।

জিসিজি /এসআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।