নেপালজুড়ে কয়েক দিন ধরেই তীব্র আন্দোলনে বিক্ষুব্ধ তরুণ প্রজন্ম। দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে এই আন্দোলন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে পরিণত হয়।
এরই প্রেক্ষাপটে মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) তড়িঘড়ি পদত্যাগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি। তবে তার পদত্যাগ আন্দোলন থামাতে পারেনি। বরং আন্দোলনকারীরা এখন আরও কঠোর অবস্থানে গেছেন। তাদের লক্ষ্য শুধু সরকারের পতন বা পরিবর্তন নয়, কাঠামোগত সংস্কার এবং পুরোনো প্রজন্মের নেতৃত্বের অবসান।
সংসদে আগুন, উত্তাল রাজপথ
প্রধানমন্ত্রী ওলির পদত্যাগের পর পরিস্থিতি আরও অশান্ত হয়ে উঠেছে। শত শত বিক্ষোভকারী সংসদ ভবনে অনুপ্রবেশ করে আগুন ধরিয়ে দেয়। পার্লামেন্ট সচিবালয়ের মুখপাত্র একরাম গিরি জানান, শত শত বিক্ষোভকারী সংসদ এলাকায় ঢুকে মূল ভবনে অগ্নিসংযোগ করেছে।
সরকারবিরোধী স্লোগানে মুখরিত রাজপথ এখনো উত্তপ্ত। আন্দোলনকারীদের দাবি— পুরোনো নেতৃত্বে তাদের আর আস্থা নেই, নতুন নেতৃত্ব ছাড়া সংকটের সমাধান সম্ভব নয়। এমন পরিস্থিতিতে তারা কাঠমান্ডু মহানগরীর মেয়র বালেন্দ্র শাহকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
মেয়র বালেন্দ্র শাহ, তরুণ প্রজন্মের কাছে ‘বালেন’ নামে পরিচিত। আন্দোলনকারীরা তাকেই এখন আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসতে চাইছেন। বিক্ষোভকারীরা ওলি ও তার পুরনো মিত্র শের বাহাদুর দেউবা কিংবা পুষ্পকমল দাহালের মতো নেতাদের নেপালের অংশীদার হিসেবে দেখতে চাইছেন না। ‘নতুন নেপাল’ গড়তে তারা বালেনকেই অংশীদার হিসেবে দেখতে চাইছেন। আন্দোলনের মিছিলে তারা স্লোগানে স্লোগানে আহ্বান জানাচ্ছেন, ‘এসো বালেন, এগিয়ে এসে আমাদের রক্ষা করো। ’
বালেন্দ্র শাহ ইতোমধ্যেই ফেসবুক পোস্টে বিক্ষোভকারীদের শান্ত থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, যেহেতু প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যেই পদত্যাগ করেছেন, তাই এখন আর প্রাণহানি ও সম্পদ ক্ষতির দিকে যাওয়া উচিত নয়। সরকারি ও বেসরকারি সম্পদ আসলে জনগণেরই যৌথ সম্পদ। দয়া করে শান্ত থাকুন। জাতীয় সম্পদের ক্ষতি মানে আমাদের সবার ক্ষতি। এখন আমাদের সবার সংযম প্রদর্শনের সময়। এখান থেকে দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব আপনাদের প্রজন্মের।
নতুন পথের সন্ধানে নেপাল
বিশ্লেষকরা বলছেন, নেপাল এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। প্রতিটি আন্দোলনের যেমন লক্ষ্য ও গন্তব্য থাকে; তেমনি এবারও জনগণের প্রত্যাশা পূরণে নতুন পরিকল্পনা, সুস্পষ্ট ভিশন ও শক্তিশালী নেতৃত্ব প্রয়োজন। তরুণদের আত্মত্যাগ ও নেপালি সমাজের দৃঢ় প্রত্যয়কে সম্মান জানাতে হলে পরিবর্তন আনতে হবে নতুন নেতৃত্বের অধীনে। ১৯৯০ ও ২০০৬ সালের মতো এবারও আন্দোলনের ভেতর থেকেই নেতৃত্ব বেছে নিতে হবে।
তাদের প্রত্যাশা, তাৎক্ষণিকভাবে দায়িত্ব নেওয়া নেতৃত্ব দেশকে শান্তি, সংলাপ ও সহযোগিতার পথে নিয়ে যাবে। এমন একটি রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে যা নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে এবং রাষ্ট্র যেন আর নাগরিকদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ না করে।
অন্তর্বর্তী সরকার ও নতুন নির্বাচন
ওলি ও তার মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য পদত্যাগ করায় নেপালের জোট সরকারও ভাঙনের মুখে। কারণ নেপালি কংগ্রেস, মাওবাদী সেন্টারসহ কয়েকটি দল জোট থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বিরোধী দলগুলো আগাম নির্বাচন ও অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের দাবি তুলেছে।
পরিস্থিতি সামলাতে বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে দ্রুত নতুন নির্বাচনের পথে যাওয়া জরুরি। এজন্য তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে বালেন্দ্র শাহকে এখনই দৃঢ় ও তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে হবে। এর পাশাপাশি সাংবিধানিক কাঠামো, নিরাপত্তা সংস্থা, বিরোধী দল ও সাধারণ জনগণকেও তরুণদের দাবি এবং নতুন নেতৃত্বকে সমর্থন জানাতে হবে। নেপালকে এখন শান্তি ও জবাবদিহির পথে নিয়ে যাওয়ার এটাই একমাত্র উপায়।
যা ঘটে গেছে
গত সপ্তাহে নেপালে ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম বন্ধের সিদ্ধান্ত ঘিরে তরুণদের বিক্ষোভ শুরু হয়। আন্দোলনেদের হাতে ছিল ‘দুর্নীতি বন্ধ করো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নয়’ লেখা প্ল্যাকার্ড। সোমবার কাঠমান্ডুতে শান্তিপূর্ণভাবে শুরু হওয়া আন্দোলন দ্রুত দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। বিক্ষোভকারীরা সংসদ ভবন ঘেরাও করে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ দাবি করেন। আন্দোলনকারীরা অভিযোগ করেন, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক অভিজাতদের বিলাসবহুল জীবনযাপনের সমালোচনা ঠেকাতে সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করেছে।
পরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে তারা সংসদ ভবনে অনুপ্রবেশ করে অগ্নিসংযোগ করেন এবং শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের বাড়িতে হামলা চালান। রাজধানী ছাড়াও পোখারা, বুটওয়াল, ভরতপুর, ভৈরাহাওয়াসহ একাধিক শহরে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কারফিউ জারি ও পুলিশের কাঁদানে গ্যাস, জলকামান ও গুলিতে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে। বিশৃঙ্খলা চরমে পৌঁছালে নিরাপত্তার কারণে মন্ত্রীদের সামরিক উড়োজাহাজে সরিয়ে নেওয়া হয় এবং ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্লাইট বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এমজে