ঢাকা, শনিবার, ১৯ আশ্বিন ১৪৩২, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ১১ রবিউস সানি ১৪৪৭

ফিচার

কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তি কার্যকর

নতুন যুগে ইরান-রাশিয়ার সামরিক-পারমাণবিক সম্পর্ক

আশরাফুর রহমান, তেহরান থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮:০১, অক্টোবর ৪, ২০২৫
নতুন যুগে ইরান-রাশিয়ার সামরিক-পারমাণবিক সম্পর্ক ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান (বামে) রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে করমর্দন করছেন

ইরান ও রাশিয়ার মধ্যে ২০ বছরের বিস্তৃত কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তি আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয়েছে। একই সময়ে উভয় দেশ ২৫ বিলিয়ন ডলারের একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ চুক্তিও করেছে।

এই অংশীদারিত্ব কেবল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা নয়, বরং প্রতিরক্ষা, জ্বালানি ও প্রযুক্তিতে কৌশলগত মিত্রতার নতুন অধ্যায়ও সূচনা করছে।

ঐতিহাসিক সূচনা

২০২৫ সালের ১৭ জানুয়ারি মস্কোতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান ৪৭ ধারাবিশিষ্ট এই গুরুত্বপূর্ণ দলিলে স্বাক্ষর করেছিলেন। পরে রাশিয়ার সংসদ ও ইরানের মজলিস সর্বসম্মতভাবে এটি অনুমোদন করে। বৃহস্পতিবার (২ অক্টোবর) থেকে এই চুক্তির বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে বলে উভয় দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করেছে। এর মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্ককে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘সমগ্র কৌশলগত অংশীদারিত্ব’-এর নতুন পর্যায়ে উন্নীত করা হলো।

রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাষ্যমতে, এই চুক্তি রাশিয়া ও ইরানের রাজনৈতিক নেতৃত্বের একটি ‘কৌশলগত সিদ্ধান্তের’ প্রতিফলন, যা পারস্পরিক স্বার্থে সহযোগিতা জোরদার করার নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এক বিবৃতিতে জানিয়েছে যে, এই দলিল দুই দেশের নেতাদের ইচ্ছা ও অঙ্গীকারের প্রতীক, যা পারস্পরিক শ্রদ্ধা, আস্থাপূর্ণ প্রতিবেশী সম্পর্ক ও অভিন্ন স্বার্থের ভিত্তিতে গড়ে উঠছে।

ঐতিহাসিক ভিত্তি

চুক্তির ভূমিকা অংশে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এটি পূর্ববর্তী বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক চুক্তির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে রয়েছে ১৯২১ সালের ইরান-সোভিয়েত চুক্তি, ১৯৪০ সালের বাণিজ্য ও নৌচলাচল চুক্তি, ২০০১ সালের পারস্পরিক সম্পর্ক ও সহযোগিতার মৌলিক চুক্তি এবং ২০২০ সালে আন্তর্জাতিক আইন শক্তিশালীকরণ বিষয়ে দুই দেশের যৌথ ঘোষণা।


২০২৫ সালের ১৭ জানুয়ারি মস্কোতে ভ্লাদিমির পুতিন ও মাসুদ পেজেশকিয়ান চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন

সহযোগিতার ক্ষেত্র

চুক্তিতে প্রতিরক্ষা, জ্বালানি, অর্থনীতি, কৃষি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, বিনিয়োগ এবং সংস্কৃতি—সব খাতেই সহযোগিতা বাড়ানোর স্পষ্ট রূপরেখা নির্ধারণ করা হয়েছে। উভয় দেশ অভিন্ন নিরাপত্তা হুমকি মোকাবিলা, গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় এবং আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের নীতিমালা রক্ষায় যৌথ পদক্ষেপ নেওয়ার অঙ্গীকার করেছে।

চুক্তিতে আরও বলা হয়েছে, যদি কোনো এক দেশ বহিঃশত্রুর আক্রমণের শিকার হয় তবে অপর দেশ আক্রমণকারীর পক্ষে অবস্থান নেবে না। এই ধারা ইঙ্গিত করে যে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার চাপ সত্ত্বেও ইরান ও রাশিয়া নিজেদের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় পারস্পরিক আস্থাভিত্তিক সহযোগিতা জোরদার করতে বদ্ধপরিকর।

বহুপাক্ষিক সহযোগিতায় অঙ্গীকার

ইরান ও রাশিয়া উভয়ই বহুপাক্ষিক বিশ্বব্যবস্থার প্রতি আনুগত্য পুনর্ব্যক্ত করেছে। তারা ব্রিকস, সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (এসসিও) এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ের মাধ্যমে বৈশ্বিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় কাজ করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।

পারমাণবিক শক্তি খাতে ২৫ বিলিয়ন ডলারের নতুন উদ্যোগ

কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তি আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তি কার্যকর হওয়ার কয়েক দিন আগেই প্রকাশ্যে আসে একটি যুগান্তকারী খবর। সেটি হচ্ছে ইরান ও রাশিয়া ২৫ বিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে চারটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য। মস্কোতে ইরানের হরমুজ কোম্পানি ও রাশিয়ার রোসাটম প্রজেক্ট কোম্পানির মধ্যে স্বাক্ষরিত এই চুক্তির আওতায় হরমুজগান প্রদেশের সেরিক উপকূলীয় শহরে ৫০০ হেক্টর জমির ওপর উন্নতমানের তৃতীয় প্রজন্মের চারটি রিঅ্যাক্টর নির্মিত হবে। এর মাধ্যমে প্রায় ৫,০২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।


মস্কোতে ‘ইরান হরমুজ কোম্পানি’র প্রতিনিধি নাসের মনসুর শরিফলু এবং রোসাটমের আরইপি কোম্পানির প্রতিনিধি দিমিত্রি শিগানভ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে


রাশিয়ায় নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত কাজেম জালালির উপস্থিতিতে ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থার প্রতিনিধি নাসের মানসুর শারিফলু এবং রোসাটমের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আরইপি কোম্পানির প্রতিনিধি দিমিত্রি শিগানভ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ইরান তার দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য পূরণের পথে এগোচ্ছে—২০,০০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন। বর্তমানে রাশিয়ার সহায়তায় বুশেহরে আরও দুটি ইউনিট নির্মাণাধীন রয়েছে।

কৌশলগত গুরুত্ব ও ভূরাজনৈতিক বার্তা

এই পারমাণবিক প্রকল্প নিছক বিদ্যুৎ উৎপাদনের চুক্তি নয়। বরং এটি ইরান-রাশিয়ার কৌশলগত অংশীদারিত্বের বাস্তব রূপ। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, কয়েকটি দিক বিশেষভাবে গুরুত্ব বহন করে:

১. পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়া: যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ ইরান ও রাশিয়ার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এই প্রকল্প দেখাচ্ছে যে, উভয় দেশ বিকল্প সহযোগিতা খুঁজে নিতে সক্ষম এবং নিষেধাজ্ঞা তাদের কৌশলগত পরিকল্পনা থামাতে পারেনি।

২. জ্বালানি নিরাপত্তা: পারমাণবিক শক্তি ইরানের জন্য তেল ও গ্যাসের বিকল্প। রাশিয়ার জন্য এটি একদিকে বাণিজ্যিক সুযোগ, অন্যদিকে ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যম।

৩. আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য: মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ইরানের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা প্রদর্শন করে, যা প্রতিরক্ষা ও ভূরাজনীতিতেও বার্তা পাঠায়।

৪. বহুপাক্ষিক সহযোগিতা: ইরান ও রাশিয়া ব্রিকস ও সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার মতো মঞ্চে সহযোগিতা বাড়াচ্ছে। পারমাণবিক শক্তি খাতে তাদের ঘনিষ্ঠতা এই বহুপাক্ষিক প্ল্যাটফর্মগুলোকেও প্রভাবিত করবে।

৫. প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও প্রতীকী বার্তা: ইরান-রাশিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প কেবল জ্বালানি নিরাপত্তার অংশ নয়, বরং উভয় দেশের প্রযুক্তিগত সক্ষমতার প্রতীকও। ইরান দেখাতে চাইছে যে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা, প্রযুক্তিগত অবরোধ ও রাজনৈতিক চাপ উপেক্ষা করেও সে উন্নত পরমাণু প্রযুক্তি আয়ত্ত করতে এবং তা শান্তিপূর্ণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করতে সক্ষম। এর মধ্য দিয়ে ইরান নিজস্ব গবেষণা ও উন্নয়নের সক্ষমতা বিশ্বকে জানাচ্ছে এবং একই সঙ্গে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর উদ্দেশে প্রতীকী বার্তা দিচ্ছে যে, আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতার মধ্যেও বিকল্প জোট গড়ে তোলা সম্ভব। রাশিয়ার জন্যও এটি একটি সাফল্য—কারণ এর মাধ্যমে মস্কো দেখাতে পারছে, পশ্চিমের প্রযুক্তিগত মোনোপলি ভাঙা সম্ভব এবং মিত্র রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সমান্তরাল বৈজ্ঞানিক ও শিল্প সহযোগিতা গড়ে তোলা যায়।

সামরিক সহযোগিতা: প্রতিরক্ষা জোটের নতুন রূপ

পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের পাশাপাশি ইরান-রাশিয়ার সামরিক সহযোগিতাও কৌশলগত অংশীদারিত্বকে শক্তিশালী করছে। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ইরানের ড্রোন প্রযুক্তি রাশিয়ার সামরিক অভিযানে ব্যবহৃত হয়েছে বলে পশ্চিমা সূত্রগুলো অভিযোগ করেছে। আবার ইরান রাশিয়ার কাছ থেকে উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (যেমন এ-৪০০) ও যুদ্ধবিমান ( এসইউ-৩৫) পাওয়ার চেষ্টা করছে। যদিও উভয় দেশ এসব সহযোগিতাকে প্রতিরক্ষামূলক ও বৈধ বলে দাবি করে, বাস্তবে এটি মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরেশিয়ার শক্তির ভারসাম্যে গভীর প্রভাব ফেলছে।

২০ বছরের অংশীদারিত্ব চুক্তিতেও সামরিক সহযোগিতার স্পষ্ট ধারা রয়েছে—যদি কোনো এক দেশ বহিঃশত্রুর হামলার শিকার হয়, অপর দেশ আক্রমণকারীর পাশে দাঁড়াবে না। অর্থাৎ, নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে ইরান ও রাশিয়া একে অপরকে অন্তত কৌশলগত নিরপেক্ষতা দিচ্ছে। একই সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়, সাইবার নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা এগোচ্ছে। ফলে, এই অংশীদারিত্ব শুধু অর্থনীতি বা জ্বালানি নয়, সামরিক ও নিরাপত্তা খাতেও এক নতুন বাস্তবতার জন্ম দিচ্ছে।

নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা

ইরান-রাশিয়া সম্পর্ক এক নতুন বাস্তবতায় প্রবেশ করেছে। ২০ বছরের কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তি কার্যকর হওয়া এবং ২৫ বিলিয়ন ডলারের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ চুক্তি দেখিয়ে দিচ্ছে যে, দুই দেশ শুধুমাত্র রাজনৈতিক সহযোগিতায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং প্রতিরক্ষা, জ্বালানি ও প্রযুক্তিতে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত মিত্রতায় আবদ্ধ হয়েছে।

এই অংশীদারিত্ব মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরেশিয়া পর্যন্ত নতুন শক্তির সমীকরণ তৈরি করছে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে তেহরান ও মস্কোর ঘনিষ্ঠতা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় বহুপাক্ষিকতার প্রতি তাদের দৃঢ় অঙ্গীকারের প্রতিফলন। ভবিষ্যতে এই জোট শুধু ইরান-রাশিয়ার জন্য নয়, বরং বৈশ্বিক কূটনীতি ও শক্তির ভারসাম্যের জন্যও এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে।

এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।