ঢাকা, সোমবার, ১০ আষাঢ় ১৪৩২, ২৩ জুন ২০২৫, ২৬ জিলহজ ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

জাতীয় সংসদ ভোট: 

আইনি কাঠামো থেকেও বাদ ইভিএম

ইকরাম-উদ দৌলা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:৫৬, জুন ২২, ২০২৫
আইনি কাঠামো থেকেও বাদ ইভিএম

ঢাকা: জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার না করার আইনি প্রক্রিয়াও সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এজন্য নির্বাচন বিধিমালা থেকেও ইভিএম সংক্রান্ত বিষয়গুলো বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থাটি।


 
ইসি সূত্রগুলো জানিয়েছে, ইভিএম প্রকল্পটি গত বছর শেষ হয়েছে। এরপর আর সে প্রকল্পের মেয়াদ না বাড়ায় তা সম্প্রতি বুঝে নেয় কমিশন। গত ২১ মে প্রকল্প পরিচালককে অবমুক্তও করা হয়।
 
ইসির সহকারী প্রধান খ. ম. আরিফুল ইসলামের সই করা এ সংক্রান্ত অফিস আদেশে বলা হয়, গত ২৯ এপ্রিল ইভিএম ‘প্রকল্পের প্রকল্প সমাপ্তি প্রতিবেদন (পিসিআর)’ পাওয়া যায়, যা যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে। এই অবস্থায় ইভিএম প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক কর্নেল সৈয়দ রাকিবুল হাসানকে ইভিএম প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকের পদ থেকে ২১ মে বিকেলে অবমুক্ত করা হয়েছে।
 
এরই মধ্যে আসন্ন এয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিধিমালা সংস্কার কার্যক্রমও হাতে নেয় ইসি। গত ২১ মের পঞ্চম কমিশন সভায় ইভিএম বিধিমালা থেকে বাদ দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় সংস্থাটি।
 
নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ এ বিষয়ে বলেন, ইভিএম রিলেটেড যতগুলো বিষয় ছিল আমরা পুরোপুরি বাতিল করে দিয়েছি।
 
তিনি আরো বলেন, ইভিএম নিয়ে ডিজপোজাল করার ব্যাপরে কমিটি হয়েছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হবে না। স্থানীয় সরকার নির্বোচনেও এটি ব্যবহার হবে কি-হবে না, এটা আমরা অপেক্ষা করবো ঐক্যমত কমিশনের রিপোর্টর ওপর, কোনে ফিডব্যাক আছে কি না।
 
ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, ভবিষ্যতে অন্যান্য আইন ও বিধি-বিধান থেকেও ইভিএম সংক্রান্ত বিধানগুলো পর্যায়ক্রমে তুলে দেওয়া হবে।
 
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ইভিএম ত্রুটিপূর্ণ, দুর্বল যন্ত্র ছিল। এগুলো এখন অকেজো হয়ে গেছে বোধ হয়। সবচেয়ে বড় কথা এটার জন্য রাজনৈতিক ঐক্য এবং আস্থাশীলতা দরকার। রাজনীতিবিদদেরকেই এ বিষয়ে ভবিষ্যতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
 
এর আগে ইভিএম প্রকল্প পরিচালক কর্নেল সৈয়দ রাকিবুল হাসান বলেছিলেন, বর্তমানে এক লাখ ১০ হাজার মেশিন ব্যবহার অনুপযোগী। আর ৪০ হাজারের মতো মেশিন নির্বাচনে ব্যবহার করা যাবে। তিনি বলেন, আসল কথা হলো দক্ষ লোকবলের অভাব। আমাদের প্রকল্প থাকলেও সেখানে দক্ষ কারিগরি লোকবল ছিল না, যারা ছোটখাটো সমস্যা সমাধান করবেন। আগেও ভাবা হয়নি, এখনও নেই। এছাড়া সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি প্রকল্পে। প্রকল্পের মেয়াদ না বাড়ায় এক্সিট প্ল্যানের সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
 
এ বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন ইতোমধ্যে বলেছেন, ইভিএম অনেক ঝামেলার। আমরা এ ঝামেলার মধ্যে যাব না। জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যালটে করারই পরিকল্পনা আমাদের।
 
এক-এগারো সরকারের সময়কার ড. এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন দেশের ভোট ব্যবস্থায় ইভিএমের ব্যবহার শুরু করে। সে সময় তারা বুয়েট থেকে ১২ হাজার টাকা ব্যয়ে মেশিন তৈরি করে নেয়। ওই কমিশনের ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন কমিশনও ভোটযন্ত্রটি ব্যবহার করে। তবে ২০১৫ সালে রাজশাহী সিটি নির্বাচনে একটি মেশিন অচল হয়ে পড়ায় তা আর ব্যবহার উপযোগী করতে পারেনি রকিব কমিশন। পরে তারা বুয়েটের তৈরি স্বল্প মূলের ওই মেশিনগুলো পুড়িয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে উন্নতমানের ইভিএম তৈরির পরিকল্পনা রেখে যায়।
 
২০১৭ সালে কেএম নূরুল হুদার কমিশন এসে বুয়েটের তৈরি ইভিএমের চেয়ে প্রায় ২০ গুণ বেশি দামে মেশিন কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক পূর্বে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টেরির (বিএমটিএফ) কাছ থেকে উন্নতমানের ইভিএম তৈরি করে নেন তারা। এতে মেশিন প্রতি ব্যয় হয় দুই লাখ ৩৫ হাজার টাকার মতো। হাতে নেওয়া হয় তিন হাজার ৮২৫ কোটি টাকার প্রকল্প।
 
সেই প্রকল্প থেকে দেড় লাখ ইভিএম কেনে রকিব কমিশন। প্রকল্পের সংরক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের ব্যবস্থা না থাকায় সেই উন্নতমানের ইভিএমের মেয়াদ ১০ বছর হলেও পাঁচ বছর যেতে না যেতেই অকেজো হওয়া শুরু করে।  
 
কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২৩ সালে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পূর্বে এসে প্রায় প্রতিটি সেটেই কোনো না কোনো সমস্যা দেখা দেয়। প্রায় ৪০ হাজারের মতো মেশিন ব্যবহার অনুপযোগী পড়ে। অবশিষ্ট এক লাখ ১০ হাজার মেশিনের মধ্যে অধিকাংশগুলোতে ধরা পড়ে নানা ধরণের ত্রুটি। কিন্তু মেরামতের জন্য ছিল না নতুন কোনো অর্থের যোগান। ফলশ্রুতিতে হাজার হাজার কোটি টাকার ইভিএম অচল হয়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়। অকেজো মেশিন মেরামত, সংরক্ষণ প্রভৃতির জন্য সাড়ে ১২শ কোটি টাকার প্রস্তাব দিলে বৈশ্বিক অর্থ সংকটের কারণ দেখিয়ে সরকার সেটি নাকচ করে দেয়। বর্তমানে অকেজো ইভিএমের সংখ্যা আরো বেড়েছে। সচল মেশিনগুলো তাই রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রকল্পের অর্থ ছাড়া মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব দিলে সরকার ইসির সেই প্রস্তাবও সম্প্রতি নাকচ করে দেয়। ফলে প্রকল্পটি সমাপ্ত করে সবকিছু বুঝে নিয়েছে ইসি।

ইইউডি/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।