ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

আবদুল মান্নান সৈয়দের নির্বাচিত

৫ কবিতা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৭, ২০১০
৫ কবিতা

[কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ (১৯৪৩-২০১০) ষাটের দশক থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ছিলেন কবিতা-নিবেদিত। সাহিত্যজীবনে তিনি অনেক কাজ করেছেন।

একজন কবি-কথাসাহিত্যিক-গবেষক-সমালোচক-সম্পাদক হিসেবে তাঁর রয়েছে সুবিশাল কাজ। কিন্তু যে দুটো পরিচয় তাকে মৃত্যুহীন করে রাখবে বলে আমরা বিশ্বাস করি, তার একটি কবিতা, অন্যটি জীবনানন্দ চর্চা। ১৯৬৭ সালে ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে মান্নান সৈয়দের যাত্রা শুরু। তারপর প্রায় ২০টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। তাঁর চার দশকের কাব্যচর্চায় বহু বাঁক রয়েছে। নিজেকে প্রতিনিয়ত ভেঙেছেন বিষয়ে-প্রকরণে। প্রতীক-পরাবাস্তব থেকে সহজ-সাধারণ ধর্মীয় কবিতা; অক্ষরবৃত্ত-মাত্রাবৃত্ত থেকে সনেট ও টানাগদ্য-- সব ক্ষেত্রেই ছিলেন তিনি সমান স্বচ্ছন্দ। তবে তাঁর দীর্ঘ কাব্যজীবনে যদি কোনো পাঠক হ্রস্বভ্রমণও করেন, একটু সচেতন হলে লক্ষ করবেন যে আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতার স্বর্ণকাল আশির দশক। ওই দশকটিতে প্রকাশিত হয়েছে তার ছ-ছটি কাব্যগ্রন্থ (এর মধ্য ১৯৯০-তে প্রকাশিত ‘আমার সনেট’ও ধরছি)। আর এসবের বৈচিত্র্যও অতুলনীয়। এই একটি দশকেই দেখা যায় কবিতায় তিনি চূড়াস্পর্শী, বহুবর্ণিল। আমরা এই দশকে প্রকাশিত কবির চারটি কাব্যগ্রন্থ থেকে পাঁচটি কবিতা সংকলিত করেছি, যার মধ্য দিয়ে আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিসত্তার খানিকটা পরিচয় লাভ করা সম্ভব। কবিতাগুলো সংকলিত হয়েছে কবির ‘নির্বাচিত কবিতা’ (২০০১) থেকে। -সম্পাদক]           

সৃষ্টিশীলতার প্রতি

শুধু তোমাকে সালাম-- আর কাউক্কে তোয়াক্কা করি না,
আর-সব-পায়ে-দলা মুথাঘাস-- শুধু তুমি ঘাসে রত্নফুল,
আর-সব নোংরা টাকা-পয়সার মতো : হাতে-হাতে ঘোরে-ফেরে--
                      শুধু তুমি অমল-ধবল তুমি,
তোমার আহারে শুধু ঘড়ি লাগে-- আর-কিছুই রোচে না তোমার,
নামো ঝরনা ফাটিয়ে পাথর-- সৃষ্টি তার মুখোশ ছিঁড়েছে,
বস্তুর বিরুদ্ধে শুধু অফুরান প্রজাপতি ওড়ে ॥

[পরাবাস্তব কবিতা, ১৯৮২]

আলোক সরকার আর অন্ধকার রায়

‘একি, আপনি বাজারে? কবিশাহেব, আপনিও কি বাজার করেন?’
--হ্যাঁ, আমাকেও বাজার করতে হয়,
আমাকেও তেল-নুন-মাংসের হিশেব কষতে হয়--
আমি নই বায়ুভুক রবীন্দ্রনাথ।
কবিতাকেও হতে হয় পৌরুষেয়--
শুধু নারীলাবণিগ্রস্ত নয়।
বসন্তের সংঘর্ষে জ্বলে উঠতে হয় আগুনের মতো।
জীবনানন্দকেও একদিন খালি গায়ে দুই হাতে দুই ভরা পানির বালতি
বয়ে নিয়ে যেতে দেখেছিলেন
অনুজ কবি আলোক সরকার আর অন্ধকার রায় ॥

[কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড, ১৯৮২]

কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড

এখানে কবিতা বানানো হয়।
সব ধরনের কবিতা।
রাজনীতিক কবিতা, সামাজিক কবিতা।
নাগরিক কবিতা, গ্রামীণ কবিতা।
প্রেমের কবিতা, শরীরের কবিতা।
স্বপ্নের কবিতা, বাস্তবের কবিতা।
চল্লিশের কবিতা, পঞ্চাশের কবিতা।
ষাটের কবিতা, সত্তরের কবিতা।
আশির কবিতাও আমরা বাজারে ছাড়ছি শিগগিরই।
কবিতার হাত, পা, মাথা, ধড়,
শিশ্ন, যোনি, চুল, নখ,
চোখ, মুখ, নাক, কান,
হাতের আঙুল, পায়ের আঙুল--
সব-কিছু মওজুদ আছে আমাদের এখানে।
স্বদেশি ও বিদেশি উপমা ও চিত্রকল্প,
শব্দ ও ছন্দ,
অন্ত্যমিল ও মধ্যমিল
লক্ষ লক্ষ জমা আছে আমাদের স্টকে।
ব্যাঙের ছাতার মতো আরো অনেক কবিতার কোম্পানি
গজিয়েছে বটে আজকাল। কিন্তু,
আপনি তো জানেনই,
আমাদের কোম্পানি ইতোমধ্যেই বেশ নাম করেছে।
আর ফাঁকি দিয়ে কি খ্যাতি অর্জন করা সম্ভব,
বলুন?
হ্যাঁ, আপনার অর্ডার-দেওয়া কবিতাটি এই-তো তৈরি হয়ে এলো।
চমৎকার হয়েছে।
ফিনিশিং টাচ শুধু বাকি।
একটু বসুন স্যার, চা খান,
কবিতার কয়েকটা ইস্ক্রুপ কম পড়ে গেছে আমাদের,
পাশের কারখানা থেকে একছুটে নিয়ে আসবার জন্যে
এখখুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি লতিফকে ॥

[ কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড, ১৯৮২]

গ্রীন রোড

একদিন কুলি রোড ছিলে।
হাঁটু অব্দি ডোবানো ধুলোয় ছিলে এক নির্জন তাপস।
অড়হরখেতে একদিন দেখেছিলাম তরুণ খরগোশ
যেন কোন প্রাকৃতিক নিবিড় নিখিলে
বিদ্যুচ্চমক তুলে মিশে গিয়েছিলো মটরশুঁটির খেতে।
লাল-কালো কুঁচফল পেড়েছি একদিন সান্দ্র ঝোপ থেকে
দেখেছি ধানখেত, কামময়, গভীর খোড়ল, কৈশোরক নিরুদ্বেগে,
কৌতূহলে। তারপর সপ্তর্ষির নৈশ সংকেতে

আমগাছ জামগাছ কাঁঠালগাছের শ্যাম
ক্রমাগত মুছে মুছে উঠে আসছে তরুণ বিল্ডিং,
নিভে যাচ্ছে ঘাস, উবে যাচ্ছে নিবিড় বৃষ্টির দিন;
তবু তোমাকে কেন্দ্র রেখে একদিন ঝরেছে যে-পাতার শিকল
ধরিত্রীরই কোনোখানে যে-সব রয়েছে অবিকল--
অনশ্বর, অবিচ্যুত, স্বপ্নবিদ্ধ, নির্লিপ্ত, সকাম ॥

[শ্রেষ্ঠ কবিতা, ১৯৮৭]

পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ

পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ ঝর্না থেকে নেমে এসেছিলো।
এখন, রহস্যময় জলে, খেলা করে অবিরল।
পদ্মায় গিয়েছে একটি-- মেঘনায়-যমুনায়-সুরমায়--
আর-একটি গোপন ইচ্ছায়। পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ
ঝর্না থেকে নেমে এসে সাঁতরে চলে বিভিন্ন নদীতে।
পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ জলের রহস্য ভেদ করে
এখন একাকী এক শব্দহীন সমুদ্রে চলেছে॥

[মাছ সিরিজ, ১৯৮৪]

বিশেষ দ্রষ্টব্য : যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ড্যাশ বোঝাতে -- চিহ্ন ব্যবহার করা হলো

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ২০১০, সেপ্টেম্বর ৭, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।