ঢাকা, শনিবার, ১৯ আশ্বিন ১৪৩২, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ১১ রবিউস সানি ১৪৪৭

শিল্প-সাহিত্য

ছাপচিত্রের পরিচয় ও সাম্প্রতিক একটি প্রদর্শনী | রিঙকু অনিমিখ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২:০৭, জুন ১৬, ২০১৬
ছাপচিত্রের পরিচয় ও সাম্প্রতিক একটি প্রদর্শনী | রিঙকু অনিমিখ

ছাপচিত্র দুই ধরনের। প্রথম শ্রেণিতে রয়েছে প্লেট বা উপকরণের উপরিভাগে লাগানো রঙের ব্যবহারে তৈরি ছবি, যেমন উডকাট ও লিথোগ্রাফ।

এখানে শিল্পী রঙ ব্লকের উপরিভাগে দিয়ে খোদাই করা অংশের শূন্যতা সাদায় পরিস্ফুট করে ছবি বা নকশা ফুটিয়ে তোলেন। ছাপচিত্রের দ্বিতীয় শ্রেণিতে রয়েছে ইনটাগলিও পদ্ধতি, যেখানে অন্তর্গত রেখার সমাহারে ফুটিয়ে তোলা হয় ছবি। সাধারণত এসিড দিয়ে কপার বা জিঙ্ক প্লেটে এসব লেখা পরিস্ফুট করা হয়। প্রক্রিয়াটি টেকনিক্যাল শুধু নয়, বেশ জটিল। উডকাটে বা লিথোতে শিল্পীর যেমন নিয়ন্ত্রণ থাকে এচিং, ড্রাই পয়েন্ট বা একুয়াটিন্টে ততোটা নয়। দক্ষতার সঙ্গে ভাগ্য কিংবা দুর্ঘটনাও এখানে ভূমিকা পালন করে।  

চীন — প্রাচীন এই দেশটির প্রাচীনত্বকে আরও গৌরবময় করেছে তার ছাপচিত্রের ইতিহাস। কেবল প্রাচীনই নয় এই ইতিহাস, বলা ভালো চীনারাই ছাপচিত্র মাধ্যমের আবিষ্কারক। অষ্টম শতাব্দীতে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বুদ্ধের বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে তা কাঠের পাটায় খোদাই করে কাগজে ছেপে প্রথম ছাপছবির আবিষ্কার ও প্রচলন ঘটিয়েছিলেন। সেটিই ছিলো ইতিহাসের প্রথম ‘ব্লক বুক’। ছবি এবং লেখা ছাপা হতো একটি ব্লকের উপর খোদাই করে। এ বইতে স্থান পেয়েছিলো বুদ্ধের নানা ভঙ্গিমার চিত্র এবং সেই সঙ্গে বৌদ্ধ শাস্ত্রের নানা সূত্রাবলী। এই বইটিই ‘হীরকসূত্র’ নামে খ্যাত এবং বলা হয়ে থাকে এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে আদি পুস্তক। অবশ্য ছাপাই প্রযুক্তির উদ্ভাবক হিসাবে চীনের নাম ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হলেও আধুনিক ছাপচিত্রের প্রচলন চীন দেশে একটু দেরিতেই ঘটেছে।  

চিত্রকলায় ছাপচিত্র একটি আধুনিক মাধ্যম। বিশেষত আধুনিক কালে ছবিকে সাধারণের হাতের নাগালে এনে দিতে এই মাধ্যম বেশ অগ্রণী ভূমিকা রাখে। অবিভক্ত বাংলায় ছাপাই ছবি নানাভাবে সমগ্র বাংলাকে সমৃদ্ধ করেছে। যুগের প্রয়োজনে মুদ্রণশিল্পকে সমৃদ্ধ করতে যে মাধ্যমের উদ্ভব, তা আজ হয়ে উঠেছে চিত্রশিল্পের এক অনন্য মাধ্যম। দেশভাগ-পরবর্তীকালে বাংলাদেশে আধুনিক শিল্পচর্চার উদ্ভব ও চারুশিল্প প্রতিষ্ঠানের সূচনালগ্ন থেকেই ছাপাই ছবির প্রচলন ছিলো, যদিও পূর্ণাঙ্গ ছাপচিত্র বিভাগ বা ছাপচিত্র স্টুডিও হয়েছে আরও পরে। চর্চার ক্ষেত্রে তুলনামূলক কম হলেও বাংলাদেশে এই শিল্পের রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা। অনিয়মিত বিরতিতে প্রদর্শনীও হচ্ছে এই মাধ্যমটির।

সম্প্রতি গুলশানের ‘এজ’ গ্যালালিতে চলছে চাপচিত্রের প্রদর্শনী। ‘এজ’র অবস্থান গুলশান-২ এর উত্তর সড়কের লেকের লাগোয়া বে এজ ওয়াটার ভবনের নিচতলায়। গত ০৪ জুন এই চিত্রশালায় শুরু হয়েছে ‘ইমপ্রিন্ট’ শিরোনামে বাংলাদেশের সাতজন বিশিষ্ট শিল্পীর ছাপচিত্র প্রদর্শনী। এই সাতজন বাংলাদেশের আধুনিক চারুশিল্পের চার প্রজন্মের শিল্পী। প্রথম প্রজন্মের মুর্তজা বশীর, দ্বিতীয় প্রজন্মের রফিকুন নবী, মনিরুল ইসলাম, শহিদ কবির, তৃতীয় প্রজন্মের শাহাবুদ্দিন আহমেদ, রোকেয়া সুলতানা এবং চতুর্থ প্রজন্মের আনিসুজ্জামান।

মাসব্যাপী অনুষ্ঠিতব্য এ ছাপচিত্র প্রদর্শনীতে রয়েছে সাত শিল্পীর ৩১টি চিত্রকর্ম ।

প্রদর্শনীর বর্ষীয়াণ শিল্পী মুর্তজা বশীরের পাঁচটি কাজের মধ্যে রয়েছে ‘ইমেজ-৭’, ‘এপিটাফ’, ‘বাসসহ বালিকা’, ‘প্রিন্ট-১’ ও ‘প্রিন্ট-২’। ১৯৭২ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্য এ ছাপচিত্রগুলো করেছেন বশীর। সবগুলোই এচিং অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমের ছাপাই। তার কাজগুলো ফর্মকেন্দ্রিক। ‘ইমেজ-৭’-এ জাগতিক বিষয় থেকে সৃষ্টিলোকের রহস্যময়তার ভেতরে নিজেকে সমর্পণের ইশারা দিয়েছেন শিল্পী। তার বিখ্যাত সিরিজ ‘এপিটাফ’। এখানে জীবনকে যেমন বড় করে দেখছেন, তেমনি মৃত্যুও সত্য— অনুভব করেছেন এই অনুভূতিও। রফিকুন নবী, মনিরুল ইসলাম, শহিদ কবির আশির দশকের শিল্পী। তাদের শিল্পপ্রতিভা বিকশিত হয়েছে সত্তর ও আশির দশকে। এ সময়ে ছবি আঁকার পাশাপাশি ছাপচিত্র মাধ্যমে আঁকতে শুরু করেন তারা। রফিকুন নবী কাঠকাটা ছাপচিত্রের জন্য পুরস্কৃত হন জার্মানিতে। এ প্রদর্শনীতে রয়েছে তার একটি চিত্রকর্ম। মনিরুল ইসলাম শিল্পশিক্ষা নিয়েছেন ঢাকা ও মাদ্রিদে। ছাপচিত্রে পুরস্কৃত হয়েছেন স্পেনে। তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেই। ছাপচিত্রের ক্ষেত্রে বিশেষত এচিং অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমের শিল্পিত প্রয়োগে তার দক্ষতা সুবিদিত। এমনকি ছাপচিত্রে জলরঙের মৃদু প্রলেপ দেওয়ায় একধরনের বাস্তববাদী সৌন্দর্যের সৃস্টি হয় এই শিল্পীর কাজে। এ প্রদর্শনীতে তার ‘গৌরবের পথে’ ছবিতেও আমরা দেখতে পাই সাদা তুলট ধরনের কাগজে ছাপ দেওয়া উঁচু-নিচু ফর্ম তৈরি করে জলরঙের ওয়াশ দিয়ে আনন্দদায়ক এক অনুভূতি সৃষ্টি করেছেন তিনি। এ শিল্পীর অন্যান্য কাজের শিরোনাম: ‘আশা আসে এবং ছেড়ে যায়’, ‘প্যাপিরাস’ ও ‘দুই সময়ের খন্দক’।  

শহিদ কবির চিত্রকর হলেও ছাপচিত্রে হাত পাকিয়েছেন স্পেনে গুরুশিল্পীর প্রিন্ট নিতে নিতে। এচিং মাধ্যমের সঙ্গে আরও উপাদান প্রয়োগ করে ছাপচিত্র করেন তিনি। প্রদর্শনীর জন্য তিনি যে কাজগুলো দিয়েছেন তার মধ্যে ‘দু’টি ফুলসহ ফুলদানি’, ‘মহাসড়ক’, ‘মেক্সিকান লিলি’ ও ‘পথ সার্কাস’ উল্লেখযোগ্য। শেষোক্তটি বেশ চমকপ্রদ। এখানে দেখা যায়, উঁচুতে একটি কুকুর শারীরিক কসরত করছে, ক্যামেরাম্যান সেটি ভিডিও করছেন। চিত্রকর ও মুক্তিযোদ্ধা শাহাবুদ্দিন আহমেদ। ফিগারের ক্ষিপ্র গতিময়তা নিয়ে কাজ করে খ্যাতিমান হয়েছেন। দেশে-বিদেশে। প্রদর্শনীর জন্য লিথোগ্রাফ মাধ্যমে তিনি এঁকেছেন ‘ঘোড়দৌড়’, ‘দৌড়’, ‘ঘোড়া’, ‘মুক্তি ও গতি’। শিরোনামই বলে দিচ্ছে শাহাবুদ্দিনের কাজগুলো সেই গতিরই প্রতিনিধি। রোকেয়া সুলতানা ও আনিসুজ্জামান মূলত ছাপছিত্রশিল্পী। রোকেয়া কাজ করেন নারীর ব্যক্তিক, সামাজিক অবস্থান ও নারীজীবনের ফ্যান্টাসি নিয়ে। ‘বনদেবী’, ‘ফাটা মরগানা’, ‘সময় ও তারকা’ শীর্ষক তার ছাপচিত্রগুলো এচিং অ্যাকুয়াটিন্ট ও ইউনিক প্রেসারে বর্ণবহুল প্রয়োগে আঁকা। ‘বনদেবী’তে রূপকথার চরিত্রকে মমতাময় দৃষ্টিতে তুলে ধরেছেন শিল্পী। দেবীর মাথায় বাৎসল্যে নিয়ে বসে আছে পাখি, আর দেবীর কোলজুড়ে আছে সূর্যমুখী ফুল। অন্যদিকে মহানগরের নির্মাণযজ্ঞ নিয়ে অনেক দিন ধরেই ছাপচিত্র করছেন আনিসুজ্জামান। কাঠখোদাই ছাপচিত্র মাধ্যমে বেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। বড় বড় নগর নির্মাণ প্রত্যক্ষ করে তার অনুবাদ করছেন নিজের কাজে। সাধারণ বিষয়ের মধ্যেও যে সৌন্দর্য ফোটানো যায়, এটি দেখিয়েছেন তিনি।
 
বলাবহুল্য, ‘এজ’ গ্যালারির বর্তমান প্রদর্শনীটি ধারণ করছে বাংলাদেশের সমকালীন ছাপচিত্রের চিত্র ।

বাংলাদেশ সময়: ১১৫৮ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০১৬
এসএনএস
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।