ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

একগুচ্ছ কবিতা | ফারুক ওয়াসিফ

কবিতা ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০১৬
একগুচ্ছ কবিতা | ফারুক ওয়াসিফ

মরিয়ম পাথর

দূর এক সন্ধ্যাদেশ থেকে আমি আসি,
সেখানে কুয়াশা ঘনিয়ে আসছে আজ
কান্নাবমি করছে আকাশ;
বাসন্তীর দুর্ভিক্ষের শাড়ির মতো
ফেঁসে যাচ্ছে সময়ের বয়ন।

আর
মরিয়ম পাথরের আংটিতে তোমার!

মরিয়ম পাথরের ওই আংটিতে এখন;
রহস্য রেখায় ফুটছে কোন ছবি?
সে পাথর কত আর দেবে অভিশাপ,
ক্রশ পিঠে কত আর ঝুলে থাকে লাশ?

সড়কের ধর্মে আমরাও চলেছি কত
পাশাপাশি লেনে—প্রতিজ্ঞার বিপরীতে।


বিপরীতে নিয়ে যাওয়াই লক্ষ্য সড়কের
ট্রেনেরাও রুদ্ধশ্বাস কাছাকাছি আসে—
যেমন চাহনি ফিরিয়ে আনতে পারি
তেমন কি ফেরে গিরিবাজ কবুতর!

ঘৃণার মতো প্রেমও অক্ষম জেনো
বোবাধরা স্বপ্নও এক ধরনের জাগরণ।
এ জীবন ঘটমান, মৃত্যু সচলা রাত্রিতে
তার থেকে কখনোই দূরত্ব নেই—
এমন কিছুই তুমি জানতে চিরদিন
তোমার আড়াল ভেঙেছে কোন ভয়,
কেন তুমি জেগেছো শোকের লোবানে?

তোমার বুকে হয়েছি অন্ধ মূক কত রাত
পাঁজরার থেকে খুলে শুদ্ধতম হাড়
আমি বলছি ইতিহাস—দেয়ালে দেয়ালে
আমি লিখছি; লিখতে হয় যে মতন নির্বাসনে
চিত্রে দিতে প্রাণ ক্ষয় হয় চক ও পেন্সিল,
সেমতো আমার ক্ষয় থেকে সৃজন তোমার।
সাগরে ডুব দেবার আগে, বুকভরা জল নিয়ে
কত কী যে আকুলতা করে নদী—
তেমনি অস্থির আমি ডাকছি কিছুকে।

শেষের আগেই শেষ হলো গান,
অন্য কোনো জীব, অন্য কোনো স্মৃতিধর
না জেনেই শুধে যাবে আমাদের ঋণ—
নিকষ পাথর ঘেঁষে বসবে তারাও,
মরিয়ম শুষে নেবে ধুতরা-বিষ গায়;
অমরতা, প্রেমের চেয়েও বড় কিছু চায়।


আয়না ও ডুমুর

চিরনদী তীরে ফের ওঠে কালা ঢেউ
আঁজলা ভরা জল,
চোখের পারদ গলে, আয়না ভাসে স্রোতে।
আবছায়া মুখের মতো কাঁপা কাঁপা চাঁদ,
ডানার বিস্তারে কেউ লেপে দিচ্ছে ছাই,
ভিড়ে আছি ভবতীরে উবু দেহ ভাসমান—
সূর্য গেছে যাক,
আলো কিছু থাক নদীর শিয়রে।

ব্যর্থ সব তীর হতে চায় বায়ুর চিক্কুর
কতদূর নিয়তির টান কতদূর ইকারুস?

২.
ছলছল কোলাহল, রক্ত কাদা জল
ছিল তো সরল যেন একলব্য শর
আয়ুর আঁটন-ছেঁড়া পাথর উড়াল
নিরলের ফুল ঘিরে বিধি পাতে জাল
বুনে যাব তার রাহে নাভিমূলে নূর
ঐশী নফ্স থেকে বানাচ্ছি ময়ূর।
জন্মান্ধ নারীর গান আসে ভেসে
চিতল পেটের মতো হ্রদের কিনারে,
নীলাভ দুর্গের একা জানালার ধারে
দাঁড়িয়ে ছিল সে, যোনীতে ডুমুর।
আড়ে ভাষে কত ডাকি চোখে:
অঞ্জন মাখিয়ে তারে আয়নার ছায়ায়
                —ঢাকি কোন রীতে?

আমি যদি আমি হই, কী রূপে সে আমার?
আমি নই, সে-ই কি কেঁদেছে আমার আত্মায়
অস্তিত্ব অনল দেব ঠোঁটে তার ঢেলে,
আমার মরণ হোক তার শীকরে কুহরে।
আমারই প্রেত আজ আমাকেই খাক
ডুমুরের খোলে ফোটে ব্রহ্মাণ্ডের ফুল
ফুরায় উড়নপাক, সাতটা আকাশ আকুল
আয়নার ধ্বংসফেনায় আয়না ভেসে যাক!


সোনামাছি

সোনা মাছি
আমার দু’চোখ হোক
দেখার কবর।
রোদ থেকে সোনা
দেখা থেকে রূপ
এবার করেছি জুদা
চক্ষুদানী শূন্য করে
অরূপের সুর তবে সাধি!
অক্ষর, ডালিম, নীল
রূপমতি রঙের বাগান
ওগো নিরঞ্জন
আলোর ডানায় উড়া
দৃশ্যপাখি না কি তুমি?
অথচ, পলে পলে পলক ফেলে চোখ
দেখার আড়াল দিতে নামে আঁধার ঝলক;
চোখ বুঁজে যেভাবে তাকাও স্মরণের দিকে
অন্ধও সেভাবে দেখে—
দেখার মরণ পার হয়ে।

২.
সন্ধ্যাবাড়ি ঘাটে
দাঁড়িয়ে রয়েছে নিশাকর,
বন্ধ করে সর্বদেহ—শ্বাস
অন্ধদের স্বরলিপি অন্ধই করবে পাঠ।
অদৃশ্যের গানে ফানা-ফিল্লা হবে কবি
কালো বকুল ঝরাতে ঝরাতে মেরাজে যাচ্ছে নবী।

ছয় শুষিরের এ বাঁশি—
তার ছয়টি অন্ধ চোখ
ঢেকেছে তিন জোড়া কালো পাখি।
তাদের প্রেমান্ধ ফুঁয়ে ফুঁয়ে
বাঁশির খোলের অন্ধকার ছায়া পথে
উড়ে উড়ে দেখো সোনামাছি,
আমি কানামাছি হয়ে গেছি।


স্মৃতি ও ডুমুর

স্মৃতিই অক্ষর যে শিলাপৃষ্ঠার তার নাম জীবন। স্মৃতিদীপ ছাড়া প্রাণসাঁই, কিভাবে অপরশ চলে যাই? চিমনিটা মুছতে গিয়ে ভেঙ্গে গেল; কী করে সামলাই বায়ুজ্বর?
অভিলাষের অন্তরাল নিয়ে চলে যায় যে গুঞ্জরিত মাছি, আমারও স্মরণ থেকে উবে যাচ্ছে কথা। একে একে তারকাদের কুঁড়ি খুলে দেখি—রেশম বিদীর্ণ করে উড়ে যাচ্ছে আমারই আত্মার আঁশ। আমিই মুছে যাচ্ছি আমার স্বপ্নের ভেতর। বিনা সংকেতে কিভাবে পার হব বিধি—চরাচর?
আয়না থেকে তুলে মায়ার পারদ—তোমাকে যেতেই হবে। তোমাকে শুধতেই হবে দানে-প্রতিদানে নিঃশেষ-নজরের ঋণ। লুপ্ত কাহিনীর রূপা চিকচিক করে যদি চোখে সেদিন, সে কেবল বহু প্রাচীন কোনো জলপ্রবাহের অবলেশ। নিখিলের হাতে তুলে দিয়ে তোমাকে, উল্কা-পাথর কুড়াচ্ছি আমি এই হিমে।
তাদের গায়ে রোদ দিচ্ছি, ধূপ দিচ্ছি। সোনারূপায় গলানো আগুনের হার জ্বালছি তাদের প্রাণে। ধরে ধরে তাদের জিজ্ঞাসা করছি, ‘তাকে দেবার ডুমুরটি কই? করতল কেন ফাঁকা আমার?’
নিজেকেও তুমি জিজ্ঞাসিও, তমোহর ডুমুরটি কোথায় হারিয়েছিলে?


ফেরা

পূর্ণিমা এসেছে আজ,
জ্যোছনায় অচিন তরাস
ঘুম খেয়ে জেগে ওঠে স্বপ্ন
অন্ধকারে খুলে যায় চোখ।

উজিয়েছি আশার সমান পথ
ফিরছি আমি চিরনদী পারে।
জল থেকে চলে গেছে জলের সিনান,
হাতে মৃদু লণ্ঠনকুসুম;
আঁধারে দাঁড়িয়ে দিচ্ছে কারা
—নিজেদের নিজেই পাহারা?

পেছনে ফেলছে শ্বাস
আধেক জাগর বাদাবন,
হয়ত তা মনেরই অচেতন
সেই হিম থেকে ওঠে কুয়াশার রোঁয়া
কাঁপে মাস্তুল কাঁপে তার ছায়া।

বিশ্বাসে নিকটে আসি
হাসি সেই চেনা হাসি,
যেমন হাসতে হয় অচেনার কাছে;
কান্না নয়, হাসিই দেয় পরিচয়।
যে স্মৃতিরা হয়ে গেছে কবরের মাঠ
হাসি যেন তার সমাধি ফলক!

তাই কাছে এসে হাত ধরে হাসি
তারাও হাসে চাঁদের আলো পেয়ে।
বলে, ‘আমাকে চিনেছো, আমি মরিয়ম?’
তার কপালের কাছে এখনো সেই ক্ষত!

একে একে তারা আমাকে জড়ায়:
‘চিনেছো আমায়, চিনেছো আমায়?’
বাতাসে বাতাসে দুলে ওঠে ঘাট
আমি তার কাঁধ ধরে কাঁদি
একে একে সবাইকে শুধাই
তোমাদের মতো আমিও কি মৃত?

সে তখনও পাশে ছিল,
হাতে ধরা হাত: আমাকে চেননি?
তোমার স্বপ্নে যে মেলে চোখ,
আমি সেই, তুমি যার প্রেত!



বাংলাদেশ সময়: ১৭০২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০১৬
টিকে/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।