ঢাকা, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস

মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৩

আলম শাইন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১, ২০২৩
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৩

খুব ভোরে জ্ঞান ফিরে এলো অর্পিতার। চোখ খুলতেই সে লক্ষ্য করল অপরিচিত একটা সৈকতের বালুকাবেলায় কাত হয়ে পড়ে আছে।

ফর্সা আঁধারে আশপাশে তাকাতেই দেখতে পেলো ভূখণ্ডটি সবুজ জলে বেষ্টিত। তার মানে সে ছেঁড়া দ্বীপ থেকে অচেনা আরেকটা দ্বীপে এসেছে। সমুদ্রের তীব্র স্রোত ছেঁড়া দ্বীপ থেকে এই দ্বীপে ফেলে গেছে। সৃষ্টিকর্তা ওকে করুণা করেছেন, তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই তাই।

অর্পিতা খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। চোখ মেলতেও কষ্ট হচ্ছে এখন। মাথায় আনতে পারছে না এখানে কতক্ষণ যাবৎ পড়ে আছে। দুর্যোগের পর কত ঘণ্টাই বা পেরিয়ে গেছে, তার কোনো সঠিক হিসাব মেলাতে পারছে না। এখন যেহেতু ভোরবেলা, সেমতে চব্বিশ ঘণ্টার বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। মনে আছে, ছেঁড়া দ্বীপে সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ দু’জন পায়চারি করেছিল। সাড়ে আটটার পর, নয়টা-দশটা অথবা দুপুর হবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে কিন্তু ভোর হওয়ার কথা নয়। তার মানে রাত পেরিয়েছে, চব্বিশ ঘণ্টা অতিবাহিত হয়েছে। আসলে যে চব্বিশ ঘণ্টা নয়, তারও অধিক সময় সমুদ্রে ভেসেছিল অর্পিতা সেটা ওর জানা নেই। সংজ্ঞাহীন থাকায় মূলত সময় নিয়ে দ্বিধায় আছে অর্পিতা।

স্রোতের টানে যখন অর্পিতা ঘুরপাক খেতে খেতে ভেসে যেতে লাগল, তখনো ভাবেনি সে আর বেঁচে থাকতে পারবে। উত্তাল সমুদ্রের ভয়ংকর তাণ্ডবে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। তারপর চব্বিশ ঘণ্টার অধিক সময় সংজ্ঞাহীন অবস্থায় সমুদ্রে ভেসেছিল। এমন দুর্বিপাকের মধ্যে কীভাবে কী ঘটেছে, তার কিছুই আঁচ করতে পারছে না অর্পিতা। গায়ে লাইফ জ্যাকেট থাকায় মোটামুটি ভেসে থাকতে পেরেছিল, এটাই শুধু ওর স্মরণে আছে। স্মরণে নেই, কখন সে ডাঙায় আছড়ে পড়েছিল সেই সময়ের কথাও। সমুদ্রে ভেসে থাকার কথাও স্মরণে নেই। বেঁচে আছে, এটাই শুধু এখন জানে সে।

মূলত মধ্যরাতে অর্পিতা ডাঙায় আছড়ে পড়েছিল। তখন রাত দুইটার কম নয়। আচমকা ছোট একটা ঢেউয়ের ধাক্কায় দ্বীপের সৈকতে আছড়ে পড়েছিল সংজ্ঞাহীন অবস্থায়। জ্ঞান ফিরে এসেছে ভোরের ফর্সা আঁধারে। আর তখনই স্মরণে এসেছে তিয়াসের কথা। তিয়াস ওর সঙ্গেই ছিল, এখন ও কোথায়? আশপাশে দেখছে না তো! দৃষ্টি প্রসারিত করে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগল আশপাশে। কিন্তু তিয়াস তো দূরের কথা, অন্য কোনো জনমানবেরও সাড়াশব্দ পায়নি। অর্পিতার বুক চেপে এলো। তিয়াসের খারাপ কিছু হয়নি তো! তিয়াস না থাকলে ওর বেঁচে থাকাই বৃথা।

মা-বাবার কথাও মনে পড়ছে খুব করে। তাদের সেন্টমার্টিন রেখে এসেছিল। সেন্টমার্টিনে কী ঘটেছে কে জানে। তবে বড় ধরনের তাণ্ডবই ঘটার কথা; এলাকাটা যেহেতু ছেঁড়া দ্বীপের পাশাপাশি, সেখানে দুযোর্গ হয়নি এটা সে বিশ্বাস করতে পারছে না। তাই তাদের পরিণতি নিয়েও ভীষণ শঙ্কিত অর্পিতা। বেঁচে থাকলে তারা নিশ্চয়ই পাগলের মতো হয়ে গেছেন। একমাত্র সন্তানের সন্ধান না পেলে মা তো পাগলই হয়ে যাবেন। এমনিই ওর মা রুফাইদা বেগম সহজ-সরল মানুষ। অর্পিতার বিয়ে ধুমধাম করে দিতে ওর বাবাকে দেশের বাইরের থেকে বলেকয়ে নিয়ে এসেছিলেন। বাবা মোবাশ্বের আলী জাপান প্রবাসী। দ্রুত মেয়ের বিয়ে সম্পন্ন করে তিনি আবার জাপান চলে যাবেন। সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। অর্পিতা আর ভাবতে পারছে না, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার মতো অবস্থা হলো ওর। তিয়াসের সঙ্গে কাটানোর মুহূর্তটা বারবার স্মরণে আনার চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণ ভাবতেই মনে পড়েছে সমস্ত ঘটনাটা। সমুদ্র স্রোত দু’জনকেই ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। ঘণ্টাখানেক অর্পিতা স্রোতের টানে তীরবেগে ছুটেছিল। তারপরের ঘটনা আর মনে করতে পারছে না সে। এখন ওর ভাবনায় শুধু তিয়াস। তিয়াস বেঁচে আছে কি না, বেঁচে থাকলে কোথায় আছে, সমুদ্রে না কি ডাঙায়, নানান প্রশ্ন অর্পিতার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। তার ওপর দ্বীপটার অবস্থান নিয়েও সংশয়ে আছে। দ্বীপের অবস্থান বাংলাদেশে হলে দ্রুত উদ্ধারের সম্ভাবনা আছে। তবে মনে হচ্ছে না এটা বাংলাদেশের কোনো দ্বীপ। কারণ বাংলাদেশের এমন কোনো নির্জন দ্বীপাঞ্চল নেই, যেখানে জনমানবের সাড়া পাওয়া যায় না। নিশ্চয়ই দ্বীপটার অবস্থান দেশের সীমানার বাইরে। আর সেটা হলে অথবা নির্জন দ্বীপ হলে ভীষণ সমস্যায় পড়তে হবে। বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে। বেঁচে থাকলেও পরিণতি হবে ভয়াবহ। যার মোকাবিলা করা আরও কঠিন হবে।

অর্পিতার হাত-পা ক্ষত হয়ে গেছে। হাত-পাগুলো যে ওর নিজের তা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে। এমনই বাজে অবস্থা হয়েছে। সেসব নিয়ে অবশ্য ভাবছে না এখন অর্পিতা। ভাবছে বেঁচে থাকতে হবে এটাই শেষ কথা। এদিকে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় ও কাহিল হয়ে পড়েছে। এই মুহূর্তে খাবার পানির খুবই প্রয়োজন। সমুদ্রের জল ছাড়া আশপাশে খাবার পানি নজরে পড়ছে না এখনো। দ্বীপে খাবার পানি আছে কি না, তাও অর্পিতার জানা নেই। হেঁটে হেঁটে পানি খোঁজার মতো শক্তিও ওর শরীরে নেই। জামা-কাপড়ে লেগে থাকা নোনাজল শুকিয়ে যাওয়ায় শরীরটা চড়চড় করছে। চুল করছে মচমচ। শরীর থেকে লাইফ জ্যাকেটটা খুলে কপালে ঠেকাল অর্পিতা। সৃষ্টিকর্তা বাঁচিয়ে রাখলেও এই জ্যাকেটের অবদান ভোলার নয়। ঘটনার আগ মুহূর্তে জ্যাকেটটা গায়ে না দিলে দ্বীপে আছড়ে পড়ার সুযোগ হতো না। মনে মনে ধন্যবাদ জানাল বোট চালককেও। বেচারি তার বোটের যাত্রীদের মাঝে জ্যাকেট বিতরণ করলেও নিজে পরেছে কি না তা অর্পিতার জানা নেই। অবশ্য চালককে নিয়ে ওর অতটা ভাবনাও নেই। সে জানে বোট চালক বা জেলেরা হচ্ছে সমুদ্র পাড়ের সন্তান; জন্ম থেকেই সমুদ্রের সঙ্গে আলিঙ্গন করে টিকে আছে। সমুদ্রের জলে টিকে থাকার কৌশলও কমবেশি ওদের রপ্ত আছে। পরনের জামা-কাপড়ের অবস্থাও একদম বাজে হয়ে গেছে, কিন্তু পরিবর্তন করার সুযোগ নেই। এখানে নোনাজলে মাখানো শুষ্ক বস্ত্র পরিধান করেই কাটাতে হবে। কতদিন থাকতে হবে, সেটাও অজানা। এখন বড় সমস্যা হচ্ছে, সে একাকী। নির্জন দ্বীপে একাকী কাটানোর মতো সাহসও ওর নেই। যেখানে একজন পুরুষের পক্ষে নির্জন দ্বীপে কাটানোই কঠিন, সেখানে নারী হয়ে বিষয়টা সে ভাবতেও পারছে না। তার ওপর খাদ্য-পানি, বাসস্থান, পোশাকাদি নিয়েও চিন্তিত অর্পিতা। তবে ওর বিশ্বাস আছে, বুনো ফলমূল খেয়ে হলেও সংগ্রাম করে টিকে থাকতে পারবে। সে বিজ্ঞানের ছাত্রী। উদ্ভিদবিজ্ঞান সম্পর্কে কমবেশি ধারণা আছে। বিষাক্ত ফল নির্ণয়ের প্রাথমিক পদ্ধতিও জানে সে। সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, অর্পিতা স্কাউটিং করেছিল হাই স্কুলের শিক্ষার্থীকালীন সময়। এখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এরই মধ্যে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলেও প্রশিক্ষণ ভোলেনি। কিছুটা এখনো রপ্ত আছে। জানা আছে, প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকার সামান্য কলা-কৌশলও।

মনোবল আঁকড়ে ধরে অর্পিতা শোয়া থেকে উঠে বসল। ও পরিকল্পনা করেছে দ্বীপের আশপাশ ঘুরে দেখবে। বিশাল দ্বীপ, নিশ্চয়ই খাদ্য-পানির সন্ধান পাবেই। ভাগ্য ভালো হলে মানুষজনেরও সাক্ষাৎ পেয়ে যেতে পারে। যেখানে পড়ে আছে, এই জায়গাটা নির্জনের অর্থ এই নয় যে, সমস্ত দ্বীপ জনমানবশূন্য হবে। ওর ভাবনাটা একেবারেই অযৌক্তিক নয়। সমস্যা হচ্ছে, শরীরে শক্তি নেই, উঠে দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে। তারপরেও অর্পিতা কিছুক্ষণ বসে হাত-পা টেনেটুনে দাঁড়াতে চেষ্টা করল। বার কয়েক চেষ্টা করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু হাঁটতে পারছে না। ধপাস করে বসে পড়ল বালির ওপর। পিপাসায় কাতর, একটু পানি পান করতে পারলে শরীরটা চাঙ্গা হতো।

অর্পিতা হাল ছাড়ার পাত্র নয়। যতক্ষণ পর্যন্ত না সে নিশ্চিত হচ্ছে, তিয়াস চিরতরে হারিয়ে গেছে, ততক্ষণ পর্যন্ত টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাবে। তিয়াস ওর জীবন-মরণ, বেঁচে থাকার মন্ত্র। দীর্ঘদিনের সম্পর্ক থেকে এখন বাগদত্তা। ওকে ছাড়া অর্পিতা নিজকে ভাবতেই পারছে না। তবে ওর বিশ্বাস আছে, তিয়াস চিরতরে হারিয়ে যায়নি। গায়ে লাইফ জ্যাকেট যতক্ষণ থাকবে, ততক্ষণ ভেসে থাকতে পারবে। তিয়াস সাহসী ছেলে। সে সহসাই হেরে যাওয়ার পাত্র নয়, তা জানে অর্পিতা। একবার সন্ধ্যালগ্নে পল্লবীতে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছিল তিয়াস-অর্পিতা। ছিনতাইকারীরা সংখ্যায় তিনজন ছিল। ধারালো ছুরি-চাকু পেটে ঠেঁসে ধরেছিল তিয়াসের। ওই অবস্থায় ঝুঁকি নিয়ে ছুরিটা কেড়ে ওদেরকে উল্টো জখম করেছিল তিয়াস। এটা বেশি দিন আগের ঘটনা নয়, বছর দুয়েক আগের ঘটনা। তখনো তিয়াস শিক্ষার্থী। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। সেসব স্মৃতি স্মরণে আসতেই অর্পিতার ভেতরে আশার প্রদীপ জ্বলে উঠল। তিয়াস টিকে থাকার চ্যালেঞ্জে হেরে যাবে না, সে নিজেও হারবে না। এই প্রতিজ্ঞা করেই অর্পিতা বসা থেকে আবারো উঠে দাঁড়াল। মাথাটা সামান্য চক্কর দিলেও মনোবল হারায়নি সে।

পুব আকাশে সূর্য উঁকি দিতেই ধীরে ধীরে দ্বীপ আলোকিত হতে লাগল। ভোরের রেশ কাটতেই কিছুটা ভয় দূর হলো অর্পিতার। দ্বীপে মানুষজন থাকলে সাড়াশব্দ পাওয়া যাবে। ভোরের দিকে সৈকতে কেউ না এলেও এখন নিশ্চয়ই চলে আসবে। আর দ্বীপটাতে যদি পর্যটকদের আনাগোনা থাকে, তাহলে তো কথাই নেই; সহজে মুক্তি মিলবে।

ইতোমধ্যে অর্পিতার কানে এলো পাখ-পাখালির কিচিরমিচির ডাক। পাখির ডাক শোনায় সে খানিকটা শঙ্কামুক্ত হলো। কিছুটা নিশ্চিত হয়েছে, দ্বীপে খাবার পানির সন্ধান পাবে। এরা সামুদ্রিক পাখি নয়; ছোট প্রজাতির পাখি। মুনিয়া, চড়ুই, বুলবুল ইত্যাদি। এই পাখিরা সাধারণত মিঠা পানি সংলগ্ন এলাকায় আবাসস্থল গড়ে। এরা মৎস্যভূক নয়, সমুদ্রে বিচরণ করে না; দ্বীপের বাসিন্দা। সুতরাং বুনো ফলমূল-পানি নিয়ে সমস্যা হবে না।

সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই অর্পিতা কয়েক কদম অগ্রসর হলো। খালি পায়ে হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে ওর। বালি-কাঁকর মিশ্রিত পাথুরে এলাকা, তাই পায়ে বিঁধছে কণাগুলো। উপকূলের দিকে যতই এগুচ্ছে, বন-জঙ্গল ততই ঘন হয়ে আসছে। গাছ-গাছালিও উঁচু উঁচু। তেলাকুচা আর আষাঢ়ী লতা প্রচুর। পটল আকৃতির সবুজ তেলাকুচাগুলো পেকে লাল টসটসে হয়ে লতায় ঝুলছে। দেখতে ভারী সুন্দর লাগছে। তেলাকুচার লতাগুলো পাশের কলা গাছে বিস্তৃতি ঘটিয়েছে ব্যাপকভাবে। কলা গাছগুলোর শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে এমতাবস্থায়। তারপরেও প্রতিকূলতার মধ্যে বেশ বেড়ে উঠেছে। কলাও ধরেছে প্রচুর। তবে এখনো কলাগুলো পরিপক্ক হয়নি। গাছগুলো দেখে অর্পিতা খুব খুশি হয়েছে। নিশ্চয় জঙ্গলে পাকা কলারও সন্ধান পাবে। এখন মিঠা পানির সন্ধান পেলেই দ্বীপে টিকে থাকতে পারবে। আরেকটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, দ্বীপে প্রচুর নারকেল গাছ আছে। গাছগুলো অনেক উঁচু উঁচু বিধায় অর্পিতার পক্ষে ডাব পেড়ে খাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে সে আশাবাদী খাটো বা বাঁকানো গাছের সন্ধান পাবে, তাহলে ডাবের পানি খেয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারবে।

অর্পিতা লক্ষ্য করল, কয়েকটা ‘লটকন টিয়া’ উল্টোমুখী হয়ে বাদুড় ঝোলা ঝুলে তেলাকুচা ঠোকরে খাচ্ছে। দেখে ওর লোভ হলো। হাত বাড়িয়ে তেলাকুচার লতা টেনে কয়েকটা পাকা তেলাকুচা ছিঁড়ল। আপাতত এ ফলই ওর খাবার। ফলটা নিরাপদ। পাখির খাবার, মানুষজনও খায় সবজি হিসাবে। প্রচুর ভিটামিন সমৃদ্ধ। মিনারেলও আছে প্রচুর। খেলে কিছুটা খিদা নিবারণের পাশাপাশি পানীয় জলের সামান্য ঘাটতি পূরণ হবে।

কয়েকটা তেলকুচা ছিঁড়ে সমুদ্র জলে ধুয়ে অর্পিতা চিবিয়ে খেতে লাগল। মুখে দিতেই ভিন্ন স্বাদ, ভিন্ন গন্ধ নাকে এলেও খেতে অতটা মন্দ লাগেনি। রসালো ফল, হালকা মিষ্টি মিষ্টি লাগছে। পেটের খিদায় যা খাচ্ছে তা-ই ভালো লাগছে এখন। তাছাড়া এ মুহূর্তে তেলাকুচার বিকল্পও নেই। তাই বেশ কয়েকটা ফল খেয়ে পেট ভরাল। এবার একটু বিশ্রাম নিবে, তারপর শরীরে শক্তির সঞ্চয় হলে ধীরে ধীরে দ্বীপ ঘুরে দেখবে। মিঠা পানির উৎসস্থল খুঁজে বের করবে; খুঁজে বের করবে জনমানবের উপস্থিতিও। সিদ্ধান্ত মোতাবেক বন থেকে বেরিয়ে সৈকতের বালিয়াড়ির ওপর বসে দূর সমুদ্রের পানে তাকিয়ে রইল অর্পিতা। যদি সামুদ্রিক কোন নৌযান অথবা কোস্ট গার্ডের নজরে পড়ে, তাহলে দ্বীপ থেকে লোকালয়ে ফেরার সুযোগ হবে। নচেৎ নির্জন এই দ্বীপে অনির্দিষ্টকালের জন্য কাটাতে হবে। এমনিই তো এখন শীত মৌসুম। শীতের পর্যাপ্ত কাপড়-চোপড়ও সঙ্গে নেই। গায়ে লাইফ জ্যাকেট থাকায় শরীরে সামান্য ওম অনুভব করছে। এদিকে পায়ে নেই জুতা; হাঁটতে যেমন কষ্ট হচ্ছে, তেমনি ঠাণ্ডায় হাত-পা কাঁপছে ঠক ঠক করে। পরায় জিন্স প্যান্ট না থাকলে আরও কাবু হয়ে যেত। বালির উপরে বসেছে সে, তাতেই যেন শরীরটা ঠাণ্ডায় বরফ হয়ে আসছে। এমনিই তো ওর এই মুহূর্তে দরকার চিকিৎসার, তার ওপর পড়ে আছে খোলা আকাশের নিচে। এমতাবস্থায় বড় ধরনের অসুখ-বিসুখ হলে ঘোর বিপদে পড়বে। আর সেই ধরনের কিছু হলে জীবন-মরণ সংকটে পড়বে আবারো। চলবে...

মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-২


আলম শাইন: কথাসাহিত্যিক, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক কলামিস্ট

বাংলাদেশ সময়: ১০৪৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০১, ২০২৩
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।