ঢাকা, সোমবার, ২৮ আশ্বিন ১৪৩২, ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ২০ রবিউস সানি ১৪৪৭

ফিচার

রঙিন পর্বতমালা আলাদাগলার: ইরানের এক অনন্য বিস্ময়

আশরাফুর রহমান, তেহরান থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:২৯, অক্টোবর ১৩, ২০২৫
রঙিন পর্বতমালা আলাদাগলার: ইরানের এক অনন্য বিস্ময়

‘পাহাড়’ শব্দটি শুনলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে ধূসর পাথর, খাড়া ঢাল আর কঠিন প্রান্তর। কিন্তু ভাবুন তো—যদি সেই পাথরগুলো লাল, কমলা, সবুজ, হলুদ, এমনকি নীল হয়? ইরানের উত্তর-পশ্চিমে এমনই এক জাদুকরী জায়গা আছে, যেখানে মাটির বদলে রঙের ঢেউ ছড়িয়ে আছে পাহাড়জুড়ে।

আকাশে যখন রংধনু ভেসে ওঠে, তখন আমরা তাকাই উপরের দিকে। কিন্তু ইরানের তাবরিজের কাছে এক প্রান্তে রংধনু নেমে এসেছে মাটির বুকে, রূপ নিয়েছে পাহাড়ের। এই বিস্ময়কর সৌন্দর্যের নাম আলাদাগলার—রঙিন পর্বতমালা।

এই বহুরঙা পর্বতমালা পৃথিবীর অতি বিরল প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলোর একটি। বিশ্বের মাত্র কয়েকটি স্থানে এরকম পাহাড় দেখা যায়—যেমন চীনের ‘ঝাংইয়ে দানশিয়া জিওপার্ক’ এবং পেরুর ‘আউসাঙ্গাতে পর্বত’। ধারণা করা হয়, চীনের এ পর্বতমালা লাখ লাখ বছর ধরে খনিজ ও বেলেপাথরের চাপ এবং অক্সিডেশনের ফলে সৃষ্টি হয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য জায়গাতেও একই প্রক্রিয়ায় এমন পর্বতের জন্ম হয়েছে, যা দেখতে অনেকটা রঙিন স্তরযুক্ত বিশাল কেকের মতো মনে হয়।



যদিও অনেক ইরানি ও বিদেশি পর্যটক এখনো এই বিস্ময়কর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সম্পর্কে অবগত নন, তবে আলোকচিত্রী ও তাবরিজ ভ্রমণকারীদের জন্য এটি একটি জনপ্রিয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে।

আলাদাগলার কোথায়?

আলাদাগলার রঙিন পাহাড়শ্রেণি ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় জানজান প্রদেশের তাবরিজ শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে আহার ও খাজেহ শহরের মাঝামাঝি মাহনেশান জেলায় অবস্থিত। আহার-তাবরিজ সড়কে চলতে চলতে দৃশ্যপট ধীরে ধীরে রূপ বদলাতে থাকে। তাবরিজ শহর পেরোতেই চোখে পড়ে মনোমুগ্ধকর এই পর্বতমালা।

রাজধানী তেহরান থেকে আলাদাগলার পর্যন্ত দূরত্ব প্রায় ৬৩০ কিলোমিটার, যা গাড়িতে যেতে প্রায় ৭ ঘণ্টা সময় লাগে; কাজভিন–জানজান, জানজান–তাবরিজ এবং তাবরিজ–আহার সড়ক ধরে।

কল্পনা করুন, জানজান থেকে তাবরিজ যাওয়ার পথে হঠাৎ আপনি মাটির বুকে শুয়ে থাকা এক রঙিন রংধনু দেখতে পেলেন—এটাই আলাদাগলার। এই পাহাড়গুলোতে লাল, বাদামি, সবুজ, কমলা, হলুদ ও সাদা রঙের অসাধারণ সমন্বয় দেখা যায়।



আলাদাগলারের বয়স ও ভূতত্ত্ব

স্থানীয় পর্যটন ও ভ্রমণবিবরণী সূত্রে আলাদাগলার-এর গঠনের সময়কাল প্রায় ১৫ মিলিয়ন বছর হিসেবে বলা হয়েছে, তবে এই সংখ্যাটি নির্দিষ্ট পিয়ার-রিভিউড জিওক্রোনোলজিক্যাল রেফারেন্সে যাচাই করা হয়নি। এই পাহাড়ে লাল, তামাটে, বাদামি, হলুদ, সাদা, সবুজ ও নীলসহ নানা রঙের স্তর দেখা যায়—বিশেষত গ্রীষ্মের গরম দিনে লাল, তামাটে ও হলুদ রংগুলো আরও বেশি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সূর্যাস্তের সময় যখন সোনালি আলো ও ছায়ার জাল পাহাড়ে নেমে আসে, তখন দৃশ্যপট হয়ে ওঠে আরও জাদুকরী। সূর্যের আলো যখন সঠিক কোণে পড়ে, তখন এই পাহাড়গুলোর সোনালি ও তামাটে রঙ সর্বোচ্চ উজ্জ্বলতা পায়। প্রকৃতিপ্রেমী ও ফটোগ্রাফারদের জন্য এটি এক অসাধারণ গন্তব্য, যেখানে রঙের খেলা বন্দি করা যায় লেন্সে। প্রকৃতির এই শিল্পকর্মের নাম ‘আলাদাগলার পর্বতমালা’, যা তুরস্কের একটি পর্বতমালার নামের সঙ্গে মিলে গেলেও সম্পূর্ণ আলাদা।



ইতিহাস ও কিংবদন্তি

মাহনেশান অঞ্চলে প্রাচীন মিদীয় সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গেছে। ধারণা করা হয়, ‘মাদ’ শব্দটি সময়ের সাথে ‘মাহ’ হয়ে পরে ‘মাহনেশান’-এ রূপান্তরিত হয়। মিদীয়রা একসময় আজকের মাহনেশান থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে ‘মাদাবাদ’ গ্রামে বসবাস করত। সেই সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হলো ‘বেহিস্তান দুর্গ’, যা এখনও দাঁড়িয়ে আছে।

আলাদাগলারের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হলো ‘বিলকিস পাহাড়’, যার উচ্চতা প্রায় ৩৩০০ মিটার। তুর্কি ভাষায় ‘আলা’ মানে রঙিন এবং ‘দাগ’ মানে পাহাড়—অর্থাৎ নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এর বিস্ময়কর রূপ।

কেন এই পাহাড় রঙিন?

মাহনেশান খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ। প্রায় ১৫ মিলিয়ন বছর আগে এ অঞ্চলে পাহাড় ও মহাদেশীয় হ্রদ গঠনের সময় লৌহজাতীয় অবক্ষেপ তৈরি হয়। খনিজ পদার্থের ধরন ও পরিবর্তনের কারণে সেই অবক্ষেপ স্থায়ীভাবে নানা রং ধারণ করে, যা আজকের রঙিন পাহাড়ের জন্ম দেয়।

প্রতিটি রং একটি খনিজ পদার্থকে নির্দেশ করে—সবুজ রং এসেছে তামা থেকে আর লাল রং হলো অক্সিজেনের প্রভাবে লোহা অক্সিডাইজড হওয়ার ফল।



বেহিস্তান দুর্গ: এক রহস্যময় প্রাচীন স্মারক

আলাদাগলারের কাছাকাছি এবং মাহনেশান গ্রামের কাছে অবস্থিত বেহিস্তান দুর্গ স্থানীয়ভাবে ‘দেও দুর্গ’ নামেও পরিচিত। লোককাহিনি অনুযায়ী, একসময় দানবরা দুর্গের স্তম্ভগুলোর ওপরে সমতল শিলায় বিশ্রাম নিত। দুর্গে পৌঁছাতে মাহনেশান থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে হয়। ইগলি বলাগ শহরে পৌঁছে সেখান থেকে বেহিস্তানের দিকে গেলে এই প্রাচীন স্থাপত্যের দেখা মেলে।

ভ্রমণের সেরা সময়

আলাদাগলার ভ্রমণের জন্য নির্দিষ্ট কোনো ঋতুর প্রয়োজন নেই— সারা বছরই সেখানে যাওয়া যায়। প্রতিটি ঋতু পাহাড়গুলোকে নতুন রূপে সাজায়। তবে, গ্রীষ্মকাল হলো আলাদাগলার ভ্রমণের সেরা সময়। এই সময় সূর্যের আলো সরাসরি পাহাড়ে পড়লে রংগুলো সর্বাধিক উজ্জ্বল হয়ে ওঠে—প্রকৃতি যেন তখন রঙের উৎসবে মাতোয়ারা। বর্ষা ও শীতকালে বৃষ্টি ও তুষারের ছোঁয়ায় পাহাড়গুলো একেবারেই নতুন সৌন্দর্যে ভরে ওঠে।



এই অঞ্চলের মানুষদের একটি পুরোনো ঐতিহ্য হলো—নওরোজ উৎসবের সময় কাছের পাহাড়ের রঙিন মাটি দিয়ে নিজেদের ঘর সাজানো। তখন অনেকের কাছে এটি অন্য জগতের মতো মনে হয়।

ইরানের এই রঙিন পর্বতমালা শুধু একটি প্রাকৃতিক বিস্ময় নয়, বরং ইতিহাস, ভূতত্ত্ব ও লোককথার এক অনন্য মেলবন্ধন। তাবরিজ ভ্রমণে গেলে অবশ্যই আলাদাগলার ঘুরে আসা উচিত—যেখানে প্রকৃতি যেন নিজের ক্যানভাসে রঙের জাদু ছড়িয়ে দিয়েছে।

এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।