ঢাকা, শনিবার, ২৬ আশ্বিন ১৪৩২, ১১ অক্টোবর ২০২৫, ১৮ রবিউস সানি ১৪৪৭

ফিচার

ইরানবিরোধী ‘নোংরা যুদ্ধে’ জার্মান সেনাদের গোপন ভূমিকা ফাঁস!

আশরাফুর রহমান, তেহরান থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:১৩, অক্টোবর ১১, ২০২৫
ইরানবিরোধী ‘নোংরা যুদ্ধে’ জার্মান সেনাদের গোপন ভূমিকা ফাঁস!

চলতি বছরের জুন মাসে ইরানের বেসামরিক, পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় নাৎসি জার্মানির ব্লিৎজক্রিগ বা ‘বিস্ময়কর আক্রমণ’ কৌশল অনুকরণ করে একটি সমন্বিত ও আকস্মিক হামলা চালায় ইহুদিবাদী ইসরায়েল। এই হামলায় সমর্থন জানানো কয়েকটি পশ্চিমা দেশের মধ্যে জার্মানি ছিল একটি এবং তারা ছিল এ বিষয়ে সবচেয়ে সোচ্চার।

ইসরায়েলের এই আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতে জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্ৎসের মন্তব্যে নতুন বিতর্কের জন্ম দেয়। কানাডায় অনুষ্ঠিত জি-৭ সম্মেলনের ফাঁকে জার্মান সম্প্রচারমাধ্যম জেডডিএফকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্ৎস ইরানে ইসরায়েলি আগ্রাসনকে সমর্থন করে বলেন, “ইসরায়েল পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর হয়ে ‘ডার্টি ওয়ার্ক’ (নোংরা কাজ) করছে। এটাই সেই ‘ডার্টি ওয়ার্ক’ যা ইসরায়েল আমাদের সবার জন্য করছে। ”

ইরানের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “আমরাও এই শাসনের শিকার। এই মোল্লাতন্ত্র বিশ্বজুড়ে মৃত্যু ও ধ্বংস ডেকে এনেছে। আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ও নেতৃত্ব যে সাহস দেখিয়েছে, তার প্রতি আমার সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা। ”

মের্ৎসের ভাষায়, “গত কয়েক দিনের হামলায় মোল্লাতন্ত্রের শক্তি ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের আগের অবস্থানে ফেরার খুব একটা সম্ভাবনা নেই। তাদের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। ”

জার্মান চ্যান্সেলর জানান, তিনি আগেই এই ‘অবৈধ হামলা’র বিষয়ে অবহিত ছিলেন এবং দাবি করেন যে, ইসরায়েলের জন্য ইরানিদের আক্রমণ না করার ‘বিকল্প ছিল না’, কারণ তাদের ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ রয়েছে।

উল্লেখ্য, জার্মানি দীর্ঘদিন ধরে ইহুদিবাদী ইসরায়েলের কট্টর সমর্থক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকার আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (আইসিজে) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ উত্থাপনের সময়ও জার্মান সরকার প্রকাশ্যে ইসরায়েলের পক্ষ নিয়েছে।

তবে, “ইসরায়েল পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর হয়ে ‘ডার্টি ওয়ার্ক’ করছে”—এই বিতর্কিত মন্তব্যের পর মের্ৎস ইরান ও জার্মান উভয় দেশের জনগণের ক্ষোভের মুখে পড়েন। জার্মানির বামদলীয় নেতা ইয়ান ফান আকেন এই মন্তব্যের নিন্দা জানিয়ে বলেন, “মের্ৎস যুদ্ধ ও সহিংসতার শিকার মানুষদের বিদ্রূপ করছেন। ” (নিউ ইয়র্ক পোস্ট, ১৯ জুন ২০২৫)

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানির সহায়তায় পরিচালিত ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নামের হামলায় এক হাজারেরও বেশি ইরানি নিহত হন। তেল আবিব দাবি করে, ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত রাখার জন্য এই হামলা পরিচালিত হয়েছিল।

তবে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) কখনোই এমন কোনো প্রমাণ খুঁজে পায়নি যে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে অগ্রসর হচ্ছিল। জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষক সংস্থার মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি গত সপ্তাহেও এই সত্য পুনর্ব্যক্ত করেছেন।

ইসরায়েলের ইরানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ চালানোর সিদ্ধান্ত পুরো অঞ্চলকে এমন এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে নিয়ে গিয়েছিল, যা সামলানো না গেলে পশ্চিম এশিয়া ও পাশ্চাত্য—উভয় বিশ্বের জন্যই দীর্ঘমেয়াদি পরিণতি ডেকে আনতে পারত। এটি এমন এক বাস্তবতা যা জার্মানি পুরোপুরি জানত, তবুও তারা ইসরায়েলের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল।

জার্মান সেনা মোতায়েনের গোপন তথ্য

তেহরান টাইমসের হাতে আসা নতুন তথ্য অনুযায়ী, ১২ দিনের যুদ্ধ চলাকালে ইসরায়েলকে দেওয়া জার্মানির সমর্থন শুধু রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ ছিল না; বাস্তবে বার্লিন ইসরায়েলকে তার যুদ্ধের লক্ষ্য অর্জনে সরাসরি সহায়তা দেয়—দখলকৃত ভূখণ্ডে সেনা মোতায়েনের মাধ্যমে।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এক সদস্য, যিনি বিষয়টি অবগত, তিনি ইরানি গোয়েন্দা সংস্থাকে জানিয়েছেন, জার্মান সামরিক বাহিনীর একটি দল ইসরায়েলি শাসকগোষ্ঠীর অনুরোধে যুদ্ধ চলাকালে সেখানে অবস্থান নেয়। তারা সামরিক অভিযানে অংশ নেয়, একটি চুক্তির অধীনে। যার শর্ত ছিল—‘ইসরায়েল জার্মানির সম্পৃক্ততা গোপন রাখবে’। জার্মান ও ইসরাইলি কমান্ডারদের মধ্যে গোপনে এই চুক্তি করা হয়েছিল, কিন্তু ইরানিরা সেই চুক্তির তথ্য হস্তগত করেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।  

ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের আগ্রাসনে জার্মানির এই সহায়তা দ্বিতীয়বারের মতো বার্লিনকে একজন আগ্রাসীর পক্ষে দাঁড় করাল। এর আগে ১৯৮০-এর দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধে জার্মানি ইরাকের একনায়ক সাদ্দাম হোসেনকে রাসায়নিক অস্ত্র সরবরাহ করেছিল, যা তিনি ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিলেন।

তেহরান টাইমসের তথ্য অনুযায়ী, জার্মান সেনারা ইসরায়েলের পক্ষে কাজ করার জন্য আর্থিক পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন, তবে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই তারা দখলকৃত এলাকা ত্যাগ করেন। যদিও তারা আরও থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সংঘাতের উত্তেজনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এবং ইরান ইসরায়েলের বেশ কিছু সামরিক ও সংবেদনশীল স্থাপনায় আঘাত হানার পর, জার্মান সেনারা তাদের অংশগ্রহণ চালিয়ে যেতে অনিচ্ছুক হয়ে ওঠেন।

একটি ফাঁস হওয়া ইসরায়েলি মূল্যায়ন অনুযায়ী, জার্মান বাহিনীর প্রস্থান ইসরায়েলি বাহিনীকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। তবে ফ্রান্সের অংশগ্রহণে তারা সন্তুষ্ট ছিল বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

আইনি জটিলতা ও রাজনৈতিক প্রশ্ন

জার্মান সংসদ এই সেনা মোতায়েন অনুমোদন করেছিল কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। জার্মান সংবিধান অনুযায়ী, সরকার নিজ উদ্যোগে কোনো বিদেশি যুদ্ধে সেনা পাঠাতে পারে না; এজন্য সংসদের নিম্নকক্ষ বুন্ডেসট্যাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে অনুমোদন নিতে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই সাংবিধানিক বিধানটি যুক্ত করা হয়, যাতে নির্বাহী বিভাগ এককভাবে যুদ্ধ শুরু করতে না পারে। এটি না মানলে জার্মান সরকারের বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠতে পারে।

তেহরান টাইমস নিশ্চিত করেছে যে, জার্মান সেনাদের নাম, সহযোগিতার প্রকৃতি এবং সহায়ক নথিপত্র ইরানের কাছে রয়েছে।

ইসরায়েলের ‘গোয়েন্দা সংকট’ ও ইরানের ভূমিকা

এই তথ্য এমন এক সময় প্রকাশিত হলো, যখন ইসরায়েল তাদের অভ্যন্তরে এক ‘গোয়েন্দা সংকট’-এর মুখোমুখি। ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা শিন বেত (SHINBET)-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে দেশটিতে গুপ্তচরবৃত্তির ঘটনা প্রায় ৪০০ শতাংশ বেড়েছে। ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে সেই সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত কয়েক মাসে একাধিক ইসরায়েলি নাগরিক গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং শাসকগোষ্ঠী তাদের প্রায় সবাইকে ইরানের সঙ্গে যুক্ত বলে দাবি করেছে।

ইরানের গোয়েন্দামন্ত্রী ইসমাঈল খাতিব জানিয়েছেন, বহু ইসরায়েলি হয় অর্থের লোভে, নয়তো প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর প্রতি ঘৃণার কারণে ইরানের সঙ্গে সহযোগিতা করছেন।

সব মিলিয়ে, ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি আগ্রাসনে জার্মানির গোপন ভূমিকা প্রকাশ পাওয়ায় শুধু বার্লিন নয়, সমগ্র পশ্চিমা জোটের নৈতিক অবস্থান নিয়েও নতুন প্রশ্ন উঠেছে। এটি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, পশ্চিমা দেশগুলোর ‘ডার্টি ওয়ার্ক’ কেবল কূটনীতিতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং যুদ্ধক্ষেত্রেও সক্রিয়ভাবে বিস্তৃত হচ্ছে।

এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।