ঢাকা: সর্বশেষ সংশোধিত গঠনতন্ত্র নির্বাচন কমিশনে (ইসি) জমা দিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
বুধবার (৮ অক্টোবর) দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার ইসির নির্বাচন সহায়তা শাখার উপ-সচিবকে এ সংক্রান্ত চিঠি দেন।
এর আগে ২০১২ সালের ৪ ডিসেম্বর সংশোধিত গঠনতন্ত্র জমা দেয় তারা। সে সময় ১৯তম সংশোধনী আনা হয়েছিল। এবার ২০১৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বরের ২২তম সংশোধনী জমা দেওয়া হয়েছে।
২০০৮ সালে নিবন্ধন প্রথা চালু পর এ নিয়ে অষ্টমবারের মতো সংশোধনী ইসিতে জমা দেয় দলটি। এর আগে দেশের সংবিধান ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের সঙ্গে গঠতন্ত্রের সামঞ্জস্য না থাকায় ড. এটিএম শামসুল হুদার কমিশন দলটিকে বারবার গঠতন্ত্র সংশোধনের তাগাদা দেয়। সর্বশেষ ২০১২ সালের ৪ নভেম্বর জামায়াতকে চিঠি দেয় ইসি।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, গঠনতন্ত্রের ভূমিকা থেকে ‘মৌলিক বিশ্বাস ও চেতনার ভিত্তিতে ইসলামী সমাজ গঠনের মহান উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর এই গঠনতন্ত্র প্রণীত ও প্রবর্তিত হলো’ শব্দগুচ্ছ বাদ দিতে হবে। ২(৫) ধারাকেও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের সার্বভৌমের পরিপন্থি বলে উল্লেখ করে ইসি। একই সঙ্গে ২০২০ সালের মধ্যে (এটি পরবর্তিতে ২০৩০ সাল করেছে ইসি) দলের সব কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য রাখার বিষয়টি গঠতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করার শর্তও দেয় ইসি। সেই চিঠির প্রেক্ষিতে ওই বছর ৩০ নভেম্বর সংশোধনী এনে তা ৪ ডিসেম্বর নিবন্ধন প্রদানকারী সংস্থাটিতে জমা দেয় জামায়াত। সে সময় অতীতের অসংশোধিত গঠনতন্ত্রকে মুদ্রণজনিত ভুল বলে উল্লেখ করা হয়। পরবর্তীতে জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা নিয়ে আদালতে মামলা হলে দলটির গঠনতন্ত্র পর্যালোচনার কাজ ২০১৩ সালে স্থগিত করে রাখে কমিশন।
এদিকে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী, জাকের পার্টির তৎকালীন মহাসচিব মুন্সি আবদুল লতিফ, সম্মিলিত ইসলামী জোটের প্রেসিডেন্ট মাওলানা জিয়াউল হাসানসহ ২৫ জন জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন। তাদের গঠনতন্ত্র সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে রিটে উল্লেখ করা হয়।
এরপর ২০১৩ সালের ১ আগস্ট জামায়াতকে দেওয়া নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধন সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে অবৈধ বলে রায় দেন বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন (বর্তমানে অবসর), বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম (পরে আপিল বিভাগের বিচারপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন) ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল-হকের (১৯ নভেম্বর পদত্যাগ করেন) সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বৃহত্তর (লার্জার) বেঞ্চ।
সে সময় সংক্ষিপ্ত রায়ে আদালত বলেন, এ নিবন্ধন দেওয়া আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত। তবে আদালত জামায়াতে ইসলামীকে আপিল করারও অনুমোদন দিয়ে দেন। এ রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ চেয়ে জামায়াতের করা আবেদন একই বছরের ৫ আগস্ট খারিজ করে দেন আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী। ওই বছরের ২ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে জামায়াতে ইসলামী আপিল করে। তবে জামায়াতের আইনজীবীর অনুপস্থিত থাকায় ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর জামায়াতের আপিল খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ।
এর মাঝে ২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্টে এক প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে নির্বাচন কমিশনকে প্রতীক হিসেবে দাঁড়িপাল্লা বরাদ্দ না দিতে এবং কাউকে প্রতীক দিয়ে থাকলে তা বাতিল করতে চিঠি দেয়। নির্বাচন কমিশন সেই চিঠির প্রেক্ষিতে প্রথমে স্থানীয় নির্বাচন ও পরে ২০১৭ সালে জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা সংশোধন করে প্রতীকের তালিকা থেকে দাঁড়িপাল্লা প্রতীকটি বাদ দিয়ে দেয়। এরপর ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দলটির নিবন্ধন সনদও বাতিল করে ইসি।
অন্যদিকে ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের সময় আওয়ামী লীগ সরকার অঙ্গসংগঠনসহ দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তবে সরকার পতনের পর ২৮ আগস্ট জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণার আগের নির্বাহী আদেশ বাতিল করে অন্তর্বর্তী সরকার।
এরপর ২০২৩ সালে খারিজ হওয়া আপিলটি পুনরুজ্জীবনের (রিস্টোর) জন্য আবেদন করে জামায়াত। গত ২২ অক্টোবর বিলম্ব মার্জনা করে আপিলটি শুনানির জন্য পুনরুজ্জীবনের আদেশ দেন আপিল বিভাগ। এরপর কয়েক দফা শুনানি শেষে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের দেওয়া আদেশ বাতিল করেন। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ আদেশে বলেন, দলটির ক্ষেত্রে পেন্ডিং (অনিষ্পন্ন) গঠনতন্ত্র ও রেজিস্ট্রেশন ইস্যু এবং অন্য কোনো ইস্যু যদি থেকে থাকে, তা সাংবিধানিক ম্যান্ডেট পুরোপুরি প্রয়োগ করে নিষ্পত্তি করতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) নির্দেশ দেওয়া হলো।
সেই আদেশের বলেই জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এএইচএম হামিদুর রহমান আযাদ দাবি করেন, ২০১৩ সালের হাইকোর্টের রায়ে পূর্বের যে অবস্থা ছিল সেই অবস্থাই থাকবে। এক্ষেত্রে প্রতীকসহ নিবন্ধন পাবে তার দল।
যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, ২০০৮ সালে যেমন আমি দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হয়েছিলাম, তেমনি এখনো আমরা প্রতীক হিসেবে দাঁড়িপাল্লা পাবো।
পরবর্তীতে নির্বাচন কমিশন আদালতের ওই আদেশের ভিত্তিতে গত ২৪ জুলাই জামায়াতকে প্রতীকসহ নিবন্ধন ফিরিয়ে দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে।
নিবন্ধন ফিরে পাওয়ার পর গত ৩০ জুলাই গত পঞ্জিকা বছরের আয় ব্যয়ের হিসাব দাখিল করে দলটি। একই সঙ্গে সর্বশেষ সংশোধিত গঠনতন্ত্রও জমা দেয়। ১৯৮০ সালের মে মাসে জামায়াতের প্রথম গঠতন্ত্র প্রকাশের পর এ পর্যন্ত ২২টি সংশোধনী আনা হয়েছে। এর মধ্যে সাতটি সংশোধনী হয়েছে নিবন্ধন পাওয়াকে কেন্দ্র করে।
ইইউডি/জেএইচ