উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় এবার গত ২১ বছরের মধ্যে নিম্ন পাসের হার। পাসের হার এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা তলানিতে নেমেছে।
শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইংরেজি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, উচ্চতর গণিতে শিক্ষার্থীরা খারাপ করেছে। ফলে পাসের হার এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা কমে গেছে।
আর ফলাফল খারাপ করার কারণ অনুসন্ধানে তারা বলছেন, প্রশ্নপত্র কিছুটা কঠিন হলেও শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ঘাটতি পড়েছে। তারা হয়তো মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করেনি।
বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) সকাল ১০টায় রাজধানীর বকশি বাজারে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে এক সংবাদ সম্মেলনে ফলাফল প্রকাশ করেন আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. খন্দোকার এহসানুল কবির।
প্রকাশিত ফলাফলে দেখা যায়, এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হার ৫৮.৮৩ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৬৯ হাজার ৯৭ জন। এইচএসসিতে পাসের হার ৫৭.১২ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৬৩ হাজার ২১৯ জন। আলিম পরীক্ষায় পাসের হার ৭৫.৬১ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৪ হাজার ২৬৮ জন। কারিগরি বোর্ডে পাসের হার ৬২.৬৭ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১ হাজার ৬১০ জন।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৬৪.৬২ শতাংশ, রাজশাহীতে ৫৯.৪০ শতাংশ, কুমিল্লায় ৪৮.৮৬ শতাংশ, যশোরে ৫০.২০ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৫২.৫৭ শতাংশ, বরিশালে ৬২.৫৭ শতাংশ, সিলেটে ৫১.৮৬ শতাংশ, দিনাজপুরে ৫৭.৪৯ শতাংশ, ময়মনসিংহে ৫১.৫৪ শতাংশ। মাদরাসা বোর্ডে পাসের হার ৭৫.৬১ শতাংশ এবং কারিগরিতে পাসের হার ৬২.৯৭ শতাংশ।
ঢাকা বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ২৬ হাজার ৬৩ জন, রাজশাহীতে ১০ হাজার ১৩৭ জন, কুমিল্লায় ২ হাজার ৭০৭ জন, যশোরে ৫ হাজার ৯৯৫ জন, চট্টগ্রামে ৬ হাজার ৯৭ জন, বরিশালে ১ হাজার ৬৭৪ জন, সিলেটে ১ হাজার ৬০২ জন, দিনাজপুরে ৬ হাজার ২৬০ জন, ময়মনসিংহে ২ হাজার ৬৮৪ জন, মাদরাসা বোর্ডে ৪ হাজার ২৬৮ জন এবং কারিগরিতে ১ হাজার ৬১০ জনসহ মোট জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৬৯ হাজার ৯৭ জন।
ওভার মার্কিং করা হয়নি
শিক্ষা উপদেষ্টা এবং বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, এবার উত্তরপত্র মূল্যায়নে বাড়তি নম্বর দেওয়া হয়নি। তেমনি কেউ যাতে বঞ্চিত না হয়, সে বিষয়েও পরীক্ষকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।
সংবাদ সম্মেলনে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন, বেশি নম্বর দিয়ে পাসের হার বাড়ানোর কোনো নির্দেশনা সরকার, মন্ত্রণালয় বা বোর্ড থেকে উত্তরপত্র মূল্যায়নকারীদের দেওয়া হয়নি। উত্তরপত্র মূল্যায়নের যে নিয়ম আছে, আমরা পরীক্ষকদের সেগুলো স্মরণ করিয়ে দিয়েছি যে, আপনারা জানেন কীভাবে খাতা দেখতে হয়। দীর্ঘ বছরের অভিজ্ঞতা আছে, সেই অভিজ্ঞতায় যদি কোনো বদঅভ্যাস থাকে যে, সামান্য লিখলে ভুল হলেও ১-২ নম্বর দেওয়া, সেগুলো দেওয়ার দরকার নেই।
তিনি আরও বলেন, এতে তারাও আমাদের সাথে একমত হয়েছেন। তারাও বেশ খুশি। তারা বলেছেন, তারা একটা ভালো খাতা মূল্যায়নের সুযোগ পেয়েছেন।
কয়েকটি বোর্ডে প্রশ্ন কঠিন হয়েছিল কি না এমন প্রশ্নের জবাবে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সভাপতি বলেন, প্রশ্ন আগেই প্রণয়ন করা হয়েছিল। প্রত্যেক বোর্ড প্রশ্ন করে। পরে তা আন্তঃবোর্ডে আসে এবং দৈবচয়নের ভিত্তিতে কোন বোর্ডের প্রশ্নে কোন বোর্ডে পরীক্ষা হবে, তা নির্ধারিত হয়। অর্থাৎ, দেখা গেল, ঢাকা বোর্ডের প্রশ্ন প্রণয়ন করেছে রাজশাহী বোর্ড। প্রশ্ন কঠিন করার কোনো নির্দেশনা ছিল না।
তিনি বলেন, পাসের হার কম, এটি হলো বাস্তবতা। এটি আমাদের সামনে এসে হাজির হয়েছে, আমরা এটি ফ্যাব্রিকেটেড করিনি, এটার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে।
দুপুরে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার বলেন, আমি সকল শিক্ষা বোর্ডকে নির্দেশ দিয়েছি— যেন ভবিষ্যৎ পরীক্ষায়, বিশেষ করে এইচএসসি মূল্যায়নে, সীমান্তরেখায় থাকা শিক্ষার্থীদের প্রতি সর্বোচ্চ ন্যায্যতা বজায় রাখা হয়, কিন্তু একই সঙ্গে যেন ফলাফলের বাস্তবতা বিকৃত না হয়। আমরা ‘অতিরিক্ত নম্বর দিয়ে সন্তুষ্টি’ নয়, বরং ‘ন্যায্য নম্বর দিয়ে সততা’কে বেছে নিয়েছি। এই সিদ্ধান্ত সহজ নয়, কিন্তু প্রয়োজনীয়। কারণ আজ যদি আমরা সাহস করে বাস্তবতা স্বীকার না করি তাহলে মেধাবীদের প্রতি এবং আগামী প্রজন্মের প্রতি আমরা অন্যায় করব।
ভেন্যু কেন্দ্র বাতিলে ফল বিপর্যয় কুমিল্লায়
ফলাফলে এগিয়ে রয়েছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড এবং পিছিয়ে কুমিল্লা বোর্ড। কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শামসুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের ১৯২টি কেন্দ্রের মধ্যে ১৬২টি ভেন্যু কেন্দ্র। সেই ভেন্যু কেন্দ্রগুলো তুলে দিয়েছি। কোনো পরীক্ষার্থী নিজ প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা দিতে পারেনি। ফলাফলে এর একটা প্রভাব পড়েছে। ভেন্যু কেন্দ্র হলো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মিলে একটি কেন্দ্র, যেখানে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দেয়।
তিনি বলেন, সুষ্ঠু ও নকলমুক্ত পরিবেশে পরীক্ষা হয়েছে। উত্তরপত্র মূল্যায়নে জন্য শিক্ষকদের বলেছি, যে নম্বর প্রাপ্য সেই নম্বর দেবেন। কম বা বেশি যেন না পায়। এসব প্রভাব পড়েছে।
এই বোর্ডেও ইংরেজি পাসের হার কম বলে জানান বোর্ড চেয়ারম্যান।
ভেন্যু কেন্দ্র বাতিল ফলাফলে প্রভাব পড়েছে বলে মনে করেন কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক রুনা নাসরীন। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ১৬২টি ভেন্যু কেন্দ্র বাতিল করার শিক্ষার্থীরা বাড়তি সুযোগ পায়নি। ক্যাডেট কলেজের শিক্ষার্থীরাও নিজ কেন্দ্রে পরীক্ষা পারেনি।
তিনি বলেন, ভিজিলেন্স টিম কেন্দ্রে গিয়ে পরীক্ষার পুরো সময়টা ছিল। বোর্ড থেকে কেউ গেলে পরীক্ষার্থীদের মধ্যে একটা বিষয় কাজ করে যে, অসুদপায় অবলম্বন করা যাবে না। উত্তরপত্র মূল্যায়নে বলেছি, বাড়তি নম্বর সংযোজনের কিছু নেই। কেউ বঞ্চিত হবে না, ওভার নাম্বারিংও হবে না, এভাবে বলেছি।
ইংরেজি, আইসিটি এবং উচ্চতর গণিতে খারাপ ফল করেছে। ফলাফল খারাপ হলেও এই বিষয়টাকে অনেকে পজেটিভলি নিয়েছে জানিয়ে রুনা নাসরীন বলেন, এভাবে প্রকৃত মেধাবীরা বের হয়ে আসতে পারবে।
বোর্ডের খারাপ করা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে বসে তাদের সমস্যাগুলো শুনে পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানান বোর্ড চেয়ারম্যান এবং পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক।
পড়াশোনায় ঘাটতি
দিনাজপুর বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. তৌহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে বেশি খারাপ করেছে। যারা খারাপ করেছে তাদের বেশির ভাগই ইংরেজিতে খারাপ করেছে। যারা ভালো করেছে তারা অনেক বেশি ভালো করেছে।
এ ছাড়া, শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় ঢিলেমি করেছে কি না, এটাও দেখার বিষয়। যেসব প্রতিষ্ঠান খারাপ করেছে তাদের নিয়ে আমরা বসে মোটিভেশন দেব বলে জানান দিনাজপুর বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. তৌহিদুল ইসলাম।
শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ঘাটতি আছে বলে মনে করেন ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. শহীদুল্লাহ। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, আমাদের ফলাফল খুব ভালো হয়নি। তবে খারাপ থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে ভালো কিছু করতে হবে।
ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেন, আমার মনে হয়েছে শিক্ষার্থীরা মনোযোগ দিয়ে পড়েনি। এ ছাড়া, এই বোর্ডে হাওর ও চরাঞ্চলের প্রতিষ্ঠানগুলোতে কিছু ঘাটতি আছে। বিষয়ভিত্তিক ইংরেজি ও হিসাব বিজ্ঞানে খারাপ ফল করেছে। যারা খারাপ করেছে তাদের নিয়ে শিগগিরই বসব।
এইচএসসি পরীক্ষায় ভয়াবহ ফল বিপর্যয়ে গভীর উদ্বেগ ও হতাশা প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন দেশের শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষাকারী অভিভাবকদের সংগঠন অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. জিয়াউল কবির দুলু। বিবৃতিতে তিনি বলেন, ২০ বছরের ইতিহাসে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় এটা খুবই খারাপ ফল। শিক্ষার মান তলানিতে। বেসরকারি স্কুল-কলেজে শিক্ষকরা ঠিক মতো ক্লাস নেন না। সরকারি কলেজেও চলছে স্বেচ্ছাচারিতা। কোথাও সেভাবে পড়াশোনা হয় না। বেশির ভাগ শিক্ষার্থী কোচিং নির্ভর, কোচিংয়েও পড়াশোনা হয় না। শহরের চেয়ে গ্রামের স্কুল-কলেজের ফলাফল বেশি খারাপ।
তিনি আরও বলেন, ৫ লাখের বেশি শিক্ষার্থী ফেল করা কাঙ্ক্ষিত নয়। কাঙ্ক্ষিত ফলাফল কেন হচ্ছে না, তা খুঁজে বের করে ইতিবাচক চিন্তা করা প্রয়োজন।
বিবৃতিতে জিয়াউল কবির দুলু উল্লেখ করেন, ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বেশি নম্বর এ বছর দেওয়া হয়নি, গ্রেস মার্ক দেওয়া হয়নি এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় ও তদবিরে অযোগ্য ব্যক্তিদের শিক্ষা প্রশাসনে পদায়ন করায় বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ না নিতে পারায় পরীক্ষায় ফলাফল বিপর্যয় ঘটেছে।
এমআইএইচ/এমজেএফ