ঢাকা, মঙ্গলবার, ২২ আশ্বিন ১৪৩২, ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ১৪ রবিউস সানি ১৪৪৭

অর্থনীতি-ব্যবসা

ব্যাংক একীভূত হলে ২ লাখ টাকার কম আমানত ফেরত সবার আগে

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:৪৩, অক্টোবর ৭, ২০২৫
ব্যাংক একীভূত হলে ২ লাখ টাকার কম আমানত ফেরত সবার আগে বাংলাদেশ ব্যাংক

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত গত কয়েক বছরে ক্রমশ উৎসাহহীনতা, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির চাপ, ও কিছু ব্যাংকে পুঁজির ঘাটির কারণে সংকটাক্রান্ত অবস্থায় পৌঁছেছে। বিশেষ করে শরীয়াহভিত্তিক কয়েকটি ব্যাংক আর্থিক ও প্রশাসনিক দুর্বলতার শিকার হয়ে দীর্ঘকালীনভাবে বাজারে সমস্যার মুখে পড়েছে; সেই প্রেক্ষিতে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এবং আমানতকারীদের আস্থা রক্ষায় পাঁচটি ইসলামী ব্যাংক—ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক—একটি ‘ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক’ গঠনের সিদ্ধান্ত প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে আনছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বোর্ড মিলে এ প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে এবং প্রশিক্ষিত প্রশাসক নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা দেশীয় অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সেবার ধারাবাহিকতা রক্ষায় একটি বড় পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হচ্ছে।

এই মার্জার টার্গেটেড পাঁচটি ইসলামী ব্যাংক একীভূত হলে ২ লাখ টাকার কম আমানতকারীরা সবার আগে তাদের আমানত ফেরত পাবেন।

ব্যাংকগুলোতে প্রশাসক নিয়োগের পর সরকারি তহবিল জোগান দেওয়া হলেই এসব আমানতকারীর টাকা ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে। ২ লাখ টাকা বা তার কম আমানত যাদের, তারা একবারে পুরো টাকা তোলার সুযোগ পাবেন। বাকি আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়া হবে ধাপে ধাপে।

বিতাড়িত লুটেরা সরকারের মেয়াদকালে এই ব্যাংকগুলো অস্বাভাবিকভাবে ঋণ বিতরণ করেছে যার বড় একটি অংশই পাচার হয়ে গেছে, ফলে পুনরুদ্ধার অনিশ্চিত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউনিয়ন ব্যাংকের ঋণের প্রায় ৯৮ শতাংশ; ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৯৬ শতাংশে; গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের প্রায় ৮৬ শতাংশ সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৬২ শতাংশ ঋণ খেলাপি হয়েছে যা আদায়ের সম্ভাবনা খুবই কম। তুলনামূলকভাবে কিছুটা ভালো অবস্থানে রয়েছে এক্সিম ব্যাংক, কিন্তু তারও ৪৮ শতাংশ ঋণ খেলাপি। সামগ্রিকভাবে দেখা যায়, পাঁচ ব্যাংকের সম্মিলিত ঋণের পরিমাণ প্রায় ১ দশমিক ৯৫ লক্ষ কোটি টাকা, যার মধ্যে ১ দশমিক ৪৭ লক্ষ কোটিরও বেশি খেলাপি; যা শতকরা হারে ৭৭ শতাংশ।
একই সময়ে, গভীর সমস্যা হচ্ছে ক্যাপিটাল-এর প্রবল ঘাটতি; একত্রিতভাবে এই ব্যাংকগুলোর পেইড আপ ক্যাপিটাল মাত্র কয়েক হাজার কোটি টাকায় সীমাবদ্ধ, যা বর্তমান ঘাটতি ও সম্ভাব্য ক্ষতিপূরণ সামলাতে যথেষ্ট নয়।

পাঁচ ব্যাংকের মিলিত পেইড আপ ক্যাপিটাল প্রায় ৫ হাজার ৮১৯ কোটি টাকার তুলনায় দায় এবং ক্ষতিগ্রস্ত সম্পদের পরিমাণ বহুগুণ বেশি। এই অনুপাত মার্জার ব্যর্থ হলে সিস্টেমিক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এগুলো শুধুমাত্র একেকটি ব্যাংকের প্রাথমিক দোষ নয় বরং এগুলো সমষ্টিগত স্তরে ব্যাংকিং সিস্টেমের স্থিতিশীলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে।

এই আস্থাহীনতা কাটিয়ে উঠার জন্যই পাঁচটি ইসলামী ব্যাংককে একীভূত করে “ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক” নামে নতুন ব্যাংক সৃষ্টি করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকারের মতে, এভাবে অন্তত আমানতকারীদের সঞ্চয় সুরক্ষিত থাকবে এবং একটি কাঠামোগত পুনর্গঠনের সুযোগ তৈরি হবে।

ইতোমধ্যে সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক একীভূতকরণের জন্য যে প্রাথমিক নীতিমালা তৈরি করেছে। তাতে বলা হয়েছে, নতুন ব্যাংকটি রাষ্ট্র-মালিকানাধীন তত্ত্বাবধানে চালানো হবে এবং এর পরিচালনা পর্ষদে থাকবেন অভিজ্ঞ ব্যাংকার, শরীয়াহ বিশেষজ্ঞ এবং সরকারি প্রতিনিধি। পুরনো মালিকদের শেয়ার বাতিল হয়ে যাবে, তবে তাদের ঋণ বা দায়বদ্ধতা নতুন ব্যাংকে স্থানান্তরিত হবে। কারণ, ব্যাংকগুলোর নিট সম্পদ এখন ঋণাত্মক, ফলে শেয়ারগুলোর আর কোনো প্রকৃত মূল্য নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক একীভূত ব্যাংকের নামে শতভাগ সরকারি মালিকানায় নতুন শেয়ার ইস্যু করবে।

নতুন ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন হবে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে, ২০ হাজার কোটি টাকা সরবরাহ করবে সরকার, ১২ হাজার কোটি টাকা আসবে আমানত বিমা তহবিল থেকে এবং ৩ হাজার কোটি টাকা আসবে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে। এই অর্থের একটি অংশ আসবে বাজেট থেকে, একটি অংশ বৈদেশিক ঋণ থেকে এবং প্রয়োজনে ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স ফান্ড থেকেও যোগান দেওয়া হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক নিজস্ব তহবিল থেকে মূলধন দেবে না।  

আমানতকারীদের টাকা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নতুন ব্যাংকে স্থানান্তরিত হবে এবং তাদের অর্থ ফেরত দেওয়া হবে পর্যায়ক্রমে। আমানতকারী প্রতি সপ্তাহে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ তুলতে পারবেন। প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের অর্থ ফেরতের পরিবর্তে নতুন ব্যাংকের শেয়ার দেওয়ার প্রস্তাব থাকবে। যেহেতু ব্যাংকটি সরকারি মালিকানাধীন হবে, তাই শেয়ার নিতে তারা আগ্রহী হবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এর ফলে সাধারণ গ্রাহকের সঞ্চয় নিরাপদ থাকবে—এমন আশ্বাস বারবার দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

জানা যায়, ব্যাংক আমানত বিমা আইন সংশোধনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমান আইনে শুধু ব্যাংক অবসায়ন হলে আমানতকারীরা ১লাখ টাকা পর্যন্ত ফেরত পান। দেশে কোনো ব্যাংক অবসায়ন বা বন্ধ হচ্ছে না। তাই আইনটি সংশোধন করে ব্যাংক একীভূত হলেও টাকা ফেরত দেওয়ার বিধান যুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ১ লাখ টাকার বদলে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত ফেরত দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে সংশোধিত আইনের খসড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে জমা রয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, সবার আগে ক্ষুদ্র আমানতকারীদের দিকে নজর দিতে হবে। তাদের আতঙ্ক না কাটলে নতুন ব্যাংককে সফল করা কঠিন হবে।

তবে ব্যাংক একীভূত করার ঘটনা শুধু বাংলাদেশেই না, সারা বিশ্বেই এমন ঘটনা ঘটে। ভারত ২০১৭ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ১০টিরও বেশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে একীভূত করেছে। প্রাথমিকভাবে প্রশাসনিক জটিলতা ও কর্মী অসন্তোষ দেখা দিলেও পরবর্তীতে ব্যাংকগুলো শক্তিশালী হয়েছে। এখন স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ব্যাংক হিসেবে দাঁড়িয়েছে। ইন্দোনেশিয়া ২০২১ সালে তিনটি ইসলামী ব্যাংক একত্রিত করে ইন্দোনেশিয়া ইসলামী ব্যাংক গঠন করেছে। আজ সেটি শুধু দেশীয় বাজারেই নয়, আন্তর্জাতিক ইসলামী ফাইন্যান্স খাতে প্রতিযোগিতা করছে। পাকিস্তানেও ন্যাশনালাইজেশনের সময় একীভূতকরণ হয়েছিল, কিন্তু দুর্বল তদারকি ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে সেখানকার ব্যাংকগুলো প্রত্যাশিত সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। বাংলাদেশ যদি ভারতের মতো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং ইন্দোনেশিয়ার মতো বিশেষায়িত ইসলামী ব্যাংকিং নীতি অনুসরণ করে, তবে সফলতার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু যদি পাকিস্তানের মতো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বাড়ে, তবে পুরো উদ্যোগ ভেস্তে যেতে পারে।

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।