গত ৩ অক্টোবর একটি পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘আস্থার সংকটে পুঁজিবাজারে নিষ্ক্রিয় ৬২ হাজার বিনিয়োগকারী’। সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) সর্বশেষ তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে গত ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর ২০২৫) ঢাকার পুঁজিবাজারের ৬২ হাজারেরও বেশি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন।
মোটকথা, দেশের পুঁজিবাজার এখন চরম আস্থাহীনতার সংকটে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। এ অবস্থা দেশের পুঁজিবাজারের জন্য তো বটেই, এমনকি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্যও একটি বড় দুঃসংবাদ।
এমন দুঃসংবাদে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক ও সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের বসে থাকার সুযোগ নেই। কিন্তু পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের তৎপরতায় সেই দায়িত্বশীলতার নজির দেখা যাচ্ছে না, বরং তাদের এ বিষয়ে অনেকটাই নির্লিপ্ত মনে হচ্ছে।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারকে ঘিরে আস্থাহীনতার এই সংকট রাতারাতি তৈরি হয়নি। এটি যতটা অর্থনৈতিক কারণে ঘটেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি ঘটেছে বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীনদের অন্যায্য ও অনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে। প্রতিটি রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সরকারের আমলেই দলীয় কিংবা গোষ্ঠীয় লোকজন দ্বারা কমবেশি লুটপাট ও অপব্যবস্থাপনার শিকার হয়েছে পুঁজিবাজার। আর ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের নিঃস্ব ও সর্বস্বান্ত করে দেওয়ার মাধ্যমে রাতারাতি যে বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে, প্রতারণার মাধ্যমে সম্পদ লুণ্ঠনের ইতিহাসে সেটি এক অনন্য নজির হয়ে থাকবে।
পুঁজিবাজারে আস্থার সংকট কি বাড়তেই থাকবেপুঁজিবাজারকে ঘিরে সৃষ্ট আস্থার সংকট থেকে সমাজ ও অর্থনীতিতে যেসব গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, যার কিছু উল্লেখ ওই প্রতিবেদনেও রয়েছে : এক. ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশই বর্তমানে পুঁজিবাজারের ঝুঁকি এড়িয়ে সঞ্চয়পত্র কিংবা স্থায়ী আমানতের (এফডিআর) মতো নিরাপদ বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকছে; দুই. নতুন বা পুরনো কোনো কম্পানিই এখন আর বাজারে নতুন করে কোনো শেয়ার (আইপিও) ছাড়ছে না; তিন. ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আয়ের পরিমাণ দিন দিনই হ্রাস পাচ্ছে এবং সেটি তাঁদের জীবনযাপনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে; চার. বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের ব্যাপারে আগে থেকেই দেশে-বিদেশে ভাবমূর্তির যে ব্যাপক সংকট ছিল, অধিকতর পতনের মধ্য দিয়ে তা এখন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে; পাঁচ. বাংলাদেশের পুঁজিবাজার তার নানা হতাশা, কলঙ্ক ও অদক্ষতাকে অতিক্রম করে নিকট ভবিষ্যতে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে এমন কোনো লক্ষণ কোথাও চোখে পড়ছে না; ছয়. বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ব্যাপারে বিদেশি উদ্যোক্তাদের ক্রমহ্রাসমান আগ্রহের কারণে কিছুতেই এর আন্তর্জাতিক চরিত্র গড়ে উঠতে পারছে না; সাত. দেশের রাজনৈতিক দলগুলো, যারা ক্ষমতায় গিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতে চায়, তাদের কারোর অর্থনৈতিক পরিকল্পনায়ই পুঁজিবাজারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত নেই (বস্তুত তাদের কোনো অর্থনৈতিক পরিকল্পনাই নেই) এবং আট. বাংলাদেশের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো ব্যাপকভাবে অপেশাদারি দৃষ্টিভঙ্গি, নিম্নমানের দক্ষতা, ব্যাপক অনিয়ম ও জবাবদিহিবিহীন ব্যবস্থার আওতায় পরিচালিত হচ্ছে।
ওপরে যে সমস্যাগুলোর কথা উল্লেখ করা হলো, তার প্রতিটি নিয়েই আলাদাভাবে বিস্তারিত আলোচনা হওয়া উচিত। কিন্তু স্থানস্বল্পতার কারণে সেটি সম্ভব হচ্ছে না। তবে আলোচনার কিছু সূত্রমুখ উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথমেই ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি নিয়ে কথা বলা যেতে পারে।
প্রসঙ্গত, নিউইয়র্ক, নাসডাক, টোকিও, সাংহাই, হংকং, লন্ডন প্রভৃতি বিশ্বখ্যাত পুঁজিবাজারগুলো বস্তুত পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় ব্যাবসায়িক কম্পানিগুলোরই চারণক্ষেত্র—ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আনাগোনা সেখানে খুবই কম। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিষয়টি মোটেও তেমন নয়। এখানে সমাজের সাধারণ মানুষের জন্য কর্মসংস্থান ও জীবনধারণের ন্যূনতম চাহিদা পূরণযোগ্য বিকল্প আয়ের পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকায় তারাই বাড়তি আয়ের আশায় পেনশনের টাকা, সঞ্চয়পত্রের মুনাফা, পারিবারিক সঞ্চয়, এমনকি সামান্য সোনাদানা-ঘটিবাটি বিক্রি করেও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে থাকে। ফলে এ বাজার যখন যৌক্তিক আচরণ থেকে সরে গিয়ে কারসাজির মাধ্যমে গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠান বিশেষের স্বার্থের পক্ষে গিয়ে দাঁড়ায়, তখন ওই ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের পক্ষে সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসা ছাড়া আর কোনো উপায়ই থাকে না, যা এ দেশে বহুবারই হতাশার সঙ্গে লক্ষ করা গেছে।
সরকার যদি পুঁজিবাজারের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা প্রদান করতে না পারে বা তাঁদের স্বার্থ রক্ষায় এগিয়ে না আসে, তাহলে এর নেতিবাচক প্রভাবের কারণে একসময় বড় বিনিয়োগকারীরাও হয়তো পুঁজিবাজারে তাঁদের বিনিয়োগ অব্যাহত রাখতে নিরুৎসাহ বোধ করবেন। দেশের বড় কম্পানিগুলো যে এখন আর নতুন আইপিও বাজারে ছাড়ছে না, এটি তারই একটি ইঙ্গিত। আর নতুন আইপিও বাজারে না এলে পুঁজিবাজার গতিশীল হবে না এবং ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা আস্থা ফিরে পাবেন না।
দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে স্থানীয় উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা যেমন নিজ নিজ শিল্প ও ব্যবসায় নতুন বিনিয়োগের ব্যাপারে সাহস ও উৎসাহ পাচ্ছেন না, তেমনি তাঁরা সাহস ও উৎসাহ পাচ্ছেন না পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ব্যাপারেও। একই কথা প্রযোজ্য বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রেও। চীন, ভারত, জাপান, মালয়েশিয়া বা ইউরোপের এমন বহু কম্পানি আছে, যারা বর্তমানে ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স প্রভৃতি এশীয় দেশের পুঁজিবাজারে উল্লেখযোগ্য পরিসরে বিনিয়োগ করে চলেছে, অথচ তারা তা বাংলাদেশে করছে না। বছর দুই আগেও এসব কম্পানি তেমন কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে (এসইজেড) ও পুঁজিবাজারে অবলীলায় বিনিয়োগ করার কথা ভাবত। কিন্তু এখন তাদের নানা প্রণোদনা ও নীতি সহায়তার টোপ দিয়েও কিছুতেই বাংলাদেশের দিকে টানা যাচ্ছে না।
আগামী নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য দেশের মাঠে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো বর্তমানে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সূত্র থেকে নানা মাত্রার আশীর্বাদ সংগ্রহের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জনগণের সমর্থন পাওয়ার আশায় দেশে নয়া কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, কৃষি ও শিল্পোৎপাদনের ক্ষেত্রে বর্ধিত গতিশীলতা আনয়ন, গ্যাস অনুসন্ধান, রাষ্ট্রের পরিচালন ব্যয় হ্রাস করে উন্নয়ন ব্যয় বৃদ্ধি করা, দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে তাদের কথা বলতে হবে। খুব স্বাভাবিকভাবেই পুঁজিবাজার উন্নয়নের মাধ্যমে সেখানে দেশ-বিদেশের বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোও তাদের চিন্তায় স্থান দিতে হবে।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, যেখানে কারসাজির মাধ্যমে বিশেষ বিশেষ কম্পানির শেয়ারের দাম কমানো বা বাড়ানো। এই কারসাজির অন্যতম নিয়ামক হচ্ছে রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্ট শেয়ারধারীদের হীন কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোর চরম মাত্রার অযোগ্যতা ও অদক্ষতা। শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণকারী এই প্রতিষ্ঠানগুলো যদি প্রকৃতপক্ষেই যোগ্য ও দক্ষ হয়ে গড়ে উঠতে পারত এবং তারা যদি পরিপূর্ণ পেশাদারির ভিত্তিতে এই কাজগুলো করত, তাহলে রাজনৈতিক ও অন্যান্য বহিঃসূত্রের কারসাজি এখানে কোনো দিনই জায়গা করে নিতে পারত না। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের আগামী দিনের পুঁজিবাজারকে যদি ক্ষুদ্র ও বৃহৎ এবং দেশি-বিদেশি-নির্বিশেষে সব বিনিয়োগকারীর আস্থা ও ভরসার স্থলে পরিণত করতে হয়, তাহলে সর্বাগ্রে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে দক্ষতা, স্বচ্ছতা, পেশাদারি ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু এসব করার জন্য যাঁরা ক্ষমতায় যেতে চান, তাঁদের রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকা দরকার, সেটিরই এখন বড় অভাব।
লেখক : অ্যাজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি
প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা