ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

পাহাড় ধসে ১২৭ প্রাণহানি

সাত বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি ৩৬ সুপারিশ, বাড়ছে মৃত্যু ঝুঁকি

ইফতেখার ফয়সাল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২০৪ ঘণ্টা, জুন ১০, ২০১৪
সাত বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি ৩৬ সুপারিশ, বাড়ছে মৃত্যু ঝুঁকি ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে একইদিনে ১২৭ প্রাণহানির সাত বছর পার হতে চললেও বাস্তবায়ন হয়নি এ ঘটনার পর গঠিত তদন্ত কমিটির ৩৬ সুপারিশ।

২০০৭ সালের ১১ জুন পাহাড় ধসে এ মর্মান্তিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছিলো।

মঙ্গলবার এ ঘটনার সাত বছর পূর্ণ হচ্ছে।

পাহাড় ধসের পর তদন্ত কমিটি ভূমি ধসের ২৮টি কারণ চিহ্নিত করে ভবিষ্যতে এ ধরণের দুর্ঘটনা রোধে ৩৬টি সুপারিশ করেছিলো।
সুপারিশগুলোর মধ্যে কেবল দু’একটি নামেমাত্র বাস্তবায়ন হয়েছে।

সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো শুধু নিজেদের মধ্যে চিঠি আদান-প্রদান করে সময় পার করেছে। তাদের কর্মতৎপরতাও সীমাবদ্ধ থেকেছে লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতায়।

ফলে, এখনো বিভিন্ন পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করছে কয়েক হাজার পরিবার, বাড়ছে মৃত্যু ঝুঁকি। গত সাত বছরে শুধু সিটি কর্পোরেশন এলাকায় পাহাড় ধসে অন্তত ১৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে।

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ২০০৭ সালের স্মরণকালের ভয়াবহ পাহাড় ধস ঘটনার পর গঠিত তদন্ত কমিটি পাহাড় ধসের যে ২৮টি কারণ উল্লেখ করেছিলো তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো-ভারী বর্ষণ, পাহাড়ের বালির আধিক্য, পাহাড়ের উপরিভাগে গাছ না থাকা, গাছ কেটে ভারসাম্য নষ্ট করা, পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস গড়ে তোলা, পাহাড় থেকে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না রাখা, বনায়নের পদক্ষেপের অভাব, বর্ষণে পাহাড় থেকে নেমে আসা বালি ও মাটি অপসারণে দুর্বলতা ।

সুপারিশগুলোর মধ্যে ছিলো- পাহাড়ের ৫ কিলোমিটারের মধ্যে হাউজিং প্রকল্প না করা, জরুরি বনায়ন, গাইডওয়াল নির্মাণ, নিষ্কাশন ড্রেন ও মজবুত সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা, পাহাড়ের পানি ও বালি অপসারণের ব্যবস্থা করা, বসতি স্থাপনাসমূহ টেকসই করা, যত্রতত্র পাহাড়ি বালি উত্তোলন নিষিদ্ধ করা, পাহাড়ি এলাকার ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা নিষিদ্ধ করা, মতিঝর্ণা ও বাটালি হিলের পাদদেশে অবৈধ বস্তি উচ্ছেদ করে পর্যটন স্পট করা, ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের পাদদেশে বসতি স্থাপনা নিষিদ্ধ করা, পাহাড় কাটায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা, মহানগরীকে পাহাড়ি এলাকা হাটহাজারীর দিকে সম্প্রসারণ না করে কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ে পটিয়া ও আনোয়ারার দিকে সম্প্রসারণ ও বর্তমানে যেসব পাহাড় প্রায় খাড়া অবস্থায় রয়েছে সেসব পাহাড়ে স্বাভাবিক বনায়ন সম্ভব নয় বিধায় সেখানে মুলি বাঁশ, মিতিঙ্গা রোপণ করা প্রভৃতি।

সুপারিশে পাহাড়ের পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে হাউজিং প্রকল্প না করার কথা বলা হলেও সুপারিশ বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধেই এ ধরণের কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে বিশেষ করে সিডিএ ও সিটি কর্পোরেশনে বিরুদ্ধে পাহাড় কাটার অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন সময়।

একইভাবে অন্য দাবিগুলোরও বাস্তবায়ন তো হয়নি বরং অনেকগুলো দাবি সরকারি ও স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের হাতেই লঙ্ঘন হয়েছে।

২০০৭ সালের প্রাণহানির পর সরকার গঠিত ওই তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জাফর আলম বাংলানিউজকে বলেন,‘পাহাড়গুলোর সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে ভূমি ধস রোধে সুপারিশগুলো করা হয়েছিলো। এর সবগুলোই যে বাস্তবায়ন হয়নি এমন নয়। কমিটি গঠন, অবৈধ বসতি উচ্ছেদসহ বেশ কিছু প্রস্তাব আংশিক বা পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে দীর্ঘিমেয়াদী প্রকল্পগুলো একেবারেই বাস্তবায়ন হয়নি। হলে পাহাড় ধ্বসে ঝুঁকি একেবারেই কমে যেতো। ’

তিনি বলেন, ‘চাইলেই তো আর সব সম্ভব হয় না। অবৈধ বসতি উচ্ছেদ করতে গেলে দেখা যায় স্থানীয়রা নিজেদের এর বিরোধীতা করে বাধা দেয়। এমনকি অনেক কাউন্সিলরও এ ধরণের তৎপরতার সঙ্গে জড়িত। ’

তদন্ত কমিটির ৩৬ সুপারিশের বাস্তবায়নে মূখ্য ভূমিকা পালন করার কথা জেলা প্রশাসনের। কিন্তু জেলা প্রশাসন বর্ষাকালে কেবল লোক দেখানো কিছু অবৈধ বসতির অস্থায়ী পুর্ণবাসন করেই দায় সেরেছে। সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের কোন উদ্যোগ নেয়নি।

চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব)  ও পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব এস এম আবদুল কাদেরকে এ বিষয়ে জানতে একাধিক ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

চট্টগ্রামের পরিবেশাবাদী সংগঠন পিপলস ভয়েস’র আহ্বায়ক শরীফ চৌহান বাংলানিউজকে বলেন, ‘ঘটনার সাত বছরেও ৩৬ দফা সুপারিশের একটিও ঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর উদাসীনতার কারণে চট্টগ্রামে পাহাড় ধস রোধ করা যায়নি। পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটিকে দেখা যায় বর্ষা এলেই তাদের যতো তৎপরতা, সারা বছর কোন খবর থাকে না। পাহাড়ে অবৈধ বসতি স্থাপন বন্ধ না করে লোক দেখানো অস্থায়ী পুনর্বাসন কোন কার্যকর উদ্যোগ হতে পারে না। ’

এসময় ১১ জুনকে পাহাড় রক্ষা দিবস ঘোষণা করার দাবিও জানান তিনি।

পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি সূত্র জানায়, সম্প্রতি জরিপ চালিয়ে ৩০টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় চিহ্নিত করে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) এস এম আবদুল কাদেরের নেতৃত্বে গঠিত পুনর্বাসন কমিটি।

কমিটি চট্টগ্রামে ৩০টি পাহাড় ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে। এগুলো হলো সিআরবি পাহাড়, টাইগারপাস-লালখান বাজার রোড সংলগ্ন পাহাড়, টাইগারপাস মোড়ের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ, মোজাফফর নগর, কাট্টলি থেকে সীতাকুন্ড পর্যন্ত পাহাড়, সলিমপুর বাস্তুহারা পাহাড়, প্রবর্তক পাহাড়, গোল পাহাড়, ইস্পাহানী পাহাড়, বন গবেষণাগার ও বন গবেষণা ইনস্টিটিউট সংলগ্ন পাহাড়, জয় পাহাড়, চট্রেশ্বরী পাহাড়, মতিঝর্ণা ও বাটালি হিল সংলগ্ন পাহাড়, রেলওয়ে এমপ্লয়িজ গার্লস স্কুল পাহাড়, আকবর শাহ আবাসিক এলাকা সংলগ্ন পাহাড়, ফয়স লেক আবাসিক এলাকা পাহাড়, জালালাবাদ হাউজিং সোসাইটি সংলগ্ন পাহাড়, বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটি পাহাড়, ডিসি হিলের একাংশ, পরিবেশ অধিদপ্তর সংলগ্ন সিটি কর্পোরেশনের পাহাড়, এ কে খান অ্যান্ড কোং এর পাহাড়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানাধীন পাহাড়, কৈবল্যধামস্থ বিশ্ব কলোনী পাহাড়, চট্রেশ্বরী রোডের জে এফ বাংলাদেশের পাহাড়, জামেয়াতুল উলুম ইসলামী মাদ্রাসা পাহাড়, ফরেস্ট রিসার্চ একাডেমি সংলগ্ন মীর হাসান এর ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড়, ইস্পাহানী পাহাড়ের দক্ষিণ পাশের হারুণ খান সাহেবের পাহাড়, নাসিরাবাদ শিল্প এলাকা সংলগ্ন পাহাড়, লেক সিটি আবাসিক এলাকার পাহাড় এবং নগরীর জিইসি মোড়ের ব্লোসোম গার্ডেন নামের সৈয়দ জিয়াদ হোসেনের ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড়।

এসব পাহাড়ের মধ্যে ১১টিতে ৬৬৬ ঝুঁকিপূর্ণ বসতি চিহ্নিত করেছে পুনর্বাসন কমিটি। এগুলোকে ‍ভারী বর্ষণ শুরু হওয়ার আগে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে কমিটি।

একইভাবে ২০টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের তালিকা পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল্লাহকে পাঠিয়েছে বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তর। গত ৬ মে বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জাফর আলম তালিকাটি (স্মারক নম্বর: পঅ/চবি/পাঃব্যঃকঃ-১২৪৮৮/২০০৮/৩১৫) বিভাগীয় কমিশনার বরাবর পাঠান।

বাংলাদেশ সময়: ২১০৪ ঘণ্টা, জুন ১০, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।