ঢাকা, শনিবার, ২১ আষাঢ় ১৪৩২, ০৫ জুলাই ২০২৫, ০৯ মহররম ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

পল্টন ময়দান-মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ঘুরে যেভাবে রাজনীতির কেন্দ্রে শাহবাগ

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:২১, জুলাই ২, ২০২৫
পল্টন ময়দান-মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ঘুরে যেভাবে রাজনীতির কেন্দ্রে শাহবাগ ২০২৪ সালের ৬ জুলাই শাহবাগে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ | ছবি: ডিএইচ বাদল

বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস মানেই একেকটি ভৌগোলিক মঞ্চ— যেখানে সময়ের প্রেক্ষাপটে পরিবর্তিত হয়েছে মানুষের জড়ো হওয়ার স্থান, প্রতিবাদের ভাষা এবং নেতৃত্বের ধরন। পল্টন ময়দান ছিল একদা রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের মঞ্চ; মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ছিল সাংবিধানিক রাজনীতির প্রতিক্রিয়া জানানোর করিডোর; আর শাহবাগ মোড় হয়ে উঠেছে এক নতুন যুগের নাগরিক রাজনীতির হৃৎস্পন্দন।

ঐতিহাসিক পল্টন ময়দান
পল্টন ময়দান রাজধানী ঢাকা শহরে অবস্থিত ঐতিহাসিক মাঠ। এ মাঠে এক সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ, মিছিল অনুষ্ঠিত হতো। পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের স্মারক এ ময়দান। পল্টন ময়দান পূর্ব বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামের স্মৃতিময় স্থান। বাঙালি জাতির দীর্ঘ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এবং স্বাধীন বাংলাদেশ ও স্বাধীনতার পর দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অসংখ্য ঐতিহাসিক আন্দোলন-সংগ্রামের গৌরবগাথার জন্ম দিয়েছে পল্টন ময়দান।

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, ব্রিটিশ আমলে উনিশ শতকের প্রথম দিকে এ অঞ্চলে একটি নতুন সেনানিবাস তৈরির উদ্দেশ্যে ঢাকার তখনকার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ড’স নবাবপুর ও ঠাটারীবাজার ছাড়িয়ে শহরের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত বেশকিছু অংশ সংস্কার করেন। সেখানে সিপাহীদের ছাউনি, অফিসারদের বাসস্থান এবং প্যারেড গ্রাউন্ডসহ বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করা হয়। এ এলাকাটিই বর্তমান পল্টন বা পুরানা পল্টন এলাকা হিসেবে পরিচিত। এ পল্টন এলাকাটি পুরনো পাণ্ড নদীর তীরে অবস্থিত ছিল। এ কারণে পুরানা পল্টন নামকরণ হয়ে থাকতে পারে।

তবে পল্টন এলাকায় সেনাবাহিনীর জন্য তৈরি সেনানিবাসটি পরবর্তীতে মশা, ম্যালেরিয়াসহ বিভিন্ন উপদ্রব এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে পরিত্যক্ত হয়। এর সমর্থনে ১৮৪০ সালে ঢাকা ভ্রমণকারী ডেভিডসনের বক্তব্য পাওয়া যায়। ১৮৫৯ সালে তৎকালীন সার্ভেয়ার জেনারেলের ঢাকার মানচিত্রে পল্টনকে একটি বিরান অঞ্চল হিসেবে দেখানো হয়। সেনানিবাস লালবাগে স্থানান্তরের পর পল্টন এলাকাটির পরিচর্যার দায়িত্ব মিউনিসিপাল কমিটির কাছে দেওয়া হয়। এরপর পল্টনের এক অংশে গড়ে ওঠে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাগান। আরেক অংশ খেলাধুলা এবং বিভিন্ন সময় সিপাহীদের কুচকাওয়াজের জন্য ব্যবহার করা হতো। এই অংশটিই হয় পল্টন ময়দান। উনিশ শতকের শেষার্ধে পল্টনে মাঝে মাঝে রাজনৈতিক জনসভা আয়োজিত হতে শুরু করে। তবে ঐতিহাসিক এ ময়দান থেকে গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের আয়োজন পুরোপুরি হারিয়ে গেছে। এ মাঠটিকে কেন্দ্র করে এখন বিভিন্ন ক্রীড়া কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

পাকিস্তান আমল থেকে রাজনৈতিক জমায়েতের কেন্দ্রবিন্দু পল্টন
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান এবং দেশভাগের পর ভারত ও পাকিস্তান নামে দুই রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তানের অংশ হিসেবে পুরো বাংলা পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত হয়। এরপর থেকেই রাজনৈতিক সভা সমাবেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে পল্টন ময়দান।

স্বাধীনতার আগে এবং স্বাধীনতার পরে পল্টন ময়দান থেকে ছড়ানো রাজনীতির উত্তাপ মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ত সারা দেশে। সরকারের সমালোচনা, সরকারের গণবিরোধী কাজের প্রতিবাদ, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে জাতিকে দিকনির্দেশনা দেওয়ার প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে পল্টন ময়দান।

১৯৬৪ সালের ১২ জুলাই তখনকার সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবস’-এর জনসভায় পল্টন ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দেন। এই ময়দানের জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে ১৯৭১ সালের ৯ মার্চ মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী স্পষ্টতই জানিয়ে দেন ‘স্বাধীনতাই একমাত্র গন্তব্য পূর্ব পাকিস্তানের‘।

মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান, সাবকে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নানা দিকনির্দেশনামূলক বক্তৃতা দিয়েছেন এখান থেকে। ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের আগে গড়ে ওঠা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বড় বড় সমাবেশগুলো পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৯০ এর দশকে স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে বেগম খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনা পল্টন ময়দানে বড় বড় জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন। এ ছাড়া বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপি সরকারবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে পল্টনে অনেক জনসভা করেছে।

যেভাবে পল্টন ময়দান থেকে রাজনীতি বিদায় নেয়
২০১০ সালের পর থেকে পল্টন ময়দান পুরোপুরি খেলার মাঠে পরিণত হয়। বর্তমানে পল্টন ময়দান জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অধীনে রয়েছে। তবে জাতীয় স্টেডিয়াম, ঢাকা কর্তৃপক্ষ পল্টন ময়দানের প্রশাসকের দায়িত্বে। মূলত গত ২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় পল্টন ময়দানের নিয়ন্ত্রণ পায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। এক সময়ের বিশাল ময়দান চারপাশে বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে উঠতে থাকলে দিন দিন ছোট হতে হতে এক পর্যায়ে এসে মধ্যম সারির মাঠে পরিণত হয়ে। নামে এখনো পল্টন ময়দান থাকলেও পুরনো ঐতিহ্য ও গুরুত্ব হারিয়েছে মাঠটি। পল্টন ময়দানের সঙ্গে এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও এ ময়দান থেকে রাজনীতি বিদায় নিয়েছে। এখন আর সেখানে কোনো সভা-সমাবেশ, মিছিল বা কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয় না। কারণ এ ময়দানের বুক চিরে গড়ে উঠেছে একের পর এক সুবিশাল সব স্থাপনা।

ক্রীড়া সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ফেডারেশনের ভবন নির্মাণ করা হয়েছে পল্টন ময়দানে। বর্তমানে এখানে আর মিছিল মিটিং করার পরিবেশও নেই। প্রতিদিনই এ মাঠে ফুটবল, ক্রিকেট, হকি খেলা ও অনুশীলন হয়। বলতে গেলে দিনভরই কোনো না কোনো খেলা চলে পল্টন ময়দানে। গত এক দশকে খেলাধুলার অবকাঠামোতে ফাঁকা ময়দানটি এখন চতুর্দিকে ঘেরা এক আবদ্ধ জায়গায় পরিণত হয়েছে। পুরো মাঠের চারপাশেই তৈরি হয়েছে হ্যান্ডবল মাঠ, ভলিবল মাঠ, অলিম্পিক ফেডারেশন, অ্যামেচার বক্সিং ফেডারেশন, রোলার স্কেটিং কমপ্লেক্সসহ বিভিন্ন স্থাপনা।

২০০৮ সালের নির্বাচনের পর পল্টন ময়দানে বড় জনসভা সমাবেশ তেমন দেখা যায়নি। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর সর্বশেষ ২০১০ সালে পল্টন ময়দানে বড় কোনো জনসভা হয়েছে, সেটি আওয়ামী লীগের জনসভা ছিল এবং দলের সভাপতি ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনান ওই জনসভায় সভাপতিত্ব করেন। এরপর থেকে সেখানে আর কোনো জনসভা হয়নি। এরপর থেকে আওয়ামী লীগের বড় সমাবেশগুলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই হয়েছে। কখনো কখনো বায়তুল মোকারম মসজিদের দক্ষিণ গেটে স্টেডিয়ামের সামনের রাস্তায় সমাবেশ করেছে আওয়ামী লীগ। আর বিএনপি সোহরাওয়ার্দী ও নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় সভা-সমাবেশ করেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ৬০-এর দশকের ছাত্রনেতা, প্রবীণ রাজনীতিক ও বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়া বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে যেমন রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের ক্ষেত্রে পল্টন ময়দানের ভূমিকা ছিল, স্বাধীনতার পরেও দেশের গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলন সংগ্রামে পল্টন ময়দানের ভূমিকা ছিল। বাঙালির স্বায়ত্তশাসন, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের ঐতিহ্য ধারণ করে আছে পল্টন ময়দান। এখানে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন বড় বড় জনসভার সমাবেশ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে, যার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে দুর্বার গণআন্দোলন। শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা ভাসানীসহ জাতীয় নেতারা এসব জনসভার সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছেন ও কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের আগে গড়ে ওঠা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বড় বড় কর্মসূচি পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর ১৯৭২ সালে পল্টন ময়দানে মুক্তিযোদ্ধারা বঙ্গবন্ধুর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র জমা দেন। স্বাধীনতা উত্তর কালে দেশে সামরিক ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলন সংগ্রামে পল্টন ময়দানের ঐতিহ্য রয়েছে। আন্দোলনরত বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের বড় বড় জনসভা সমাবেশ হয়েছে এই পল্টন ময়দান। গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের সাক্ষী সেই পল্টন ময়দান এখন খেলাধুলার স্থান ও মার্কেটে পরিণত হয়েছে।

মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ
বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার নামে ১৯৭৪ সালের জুনে বর্তমান জাতীয় সংসদ ভবনের সামনের রাস্তাটির নামকরণ করা হয়েছিল ‘মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ’। মানিক মিয়া দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। এই মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ শেরে বাংলা নগর এলাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক। এটি খামারবাড়ি মোড় থেকে শুরু হয়, যেখানে ইন্দিরা রোড ও সংসদ অ্যাভিনিউ মিলিত হয়েছে। সড়কটি ধানমন্ডি ২৭ নম্বর মোড়ে শেষ হয়, যেখানে এটি মিরপুর সড়ক এবং ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার ২৭ নম্বর রোডের সঙ্গে সংযুক্ত।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০১ সালে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের সড়কটিতে ডিভাইডার স্থাপন করে। এর আগে আগে, এই সড়ক বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহৃত হতো। কারণ সড়কটি ঢাকার সড়কগুলোর মধ্যে একটি সর্বোচ্চ প্রশস্ত সড়ক। এই সড়কের আশেপাশে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও ভবন রয়েছে। এগুলো  হলো— জাতীয় সংসদ ভবন, রাজধানী হাই স্কুল, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, সংসদ সদস্যদের সরকারি বাসভবন।

রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ
বিশাল প্রশস্ত সড়ক মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ রাজনৈতিক দলগুলোর বড় বড় জনসভা করার জন্য ছিল সুবিধাজনক স্থান। লাখ লাখ মানুষের সমাবেশ করা যেত এই সড়কে। আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময় এই মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ জনসভা জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনরত দলগুলোর জোট ১৫ দলের (আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন আট দল ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন সাত দল) সভা-সমাবেশগুলোতে বিপুল মানুষের সমাগম ঘটতো। বিশাল জনসমাগমের জন্য মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ছিল সবচেয়ে সুবিধাজনক স্থান। তাই ১৫ দলের অনেক জনসভা মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে আয়োজন করা হতো। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগও অনেক জনসভা মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে করেছে।

১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদের শেষ দিকে অর্থাৎ ২০০১ সালে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে ডিভাইডার স্থাপন করা হয়। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন সড়কটিতে ডিভাইডার স্থাপন করে। এর ফলে স্থানটি জনসভা করার উপযোগিতা হারায়। তাছাড়া এই স্থানে সভা-সমাবেশের অনুমতি আর দেওয়া হতো না।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়া বাংলানিউজকে বলেন, পল্টনের মতো মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়েরও রাজনৈতিক ইতিহাস ও গুরুত্ব রয়েছে। আশির দশকে এরশাদের স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলন সংগ্রামের সময় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ বড় বড় সভা-সমাবেশ করা হতো। বিশেষ করে ১৫ দলীয় জোটের সভা-সমাবেশ এখানে হতো। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিও মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে বড় বড় সমাবেশ করেছে। ৯০ এর দশক থেকে এখানে সভা-সমাবেশ কমে আসতে থাকে। সভা-সমাবেশের অনুমতি পাওয়া যেত না। আসলে যারাই যখন ক্ষমতায় এসেছে তারা নিজেদের স্বার্থে রাজনৈতিক বড় বড় সভা-সমাবেশের মাধ্যমে জনসমাগম ঘটানোর ওপর বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। গণজমায়েত করার স্থানগুলো সংকুচিত ও বন্ধ করে দেয়।

একুশ শতকের নাগরিক প্রতিরোধের মঞ্চ শাহবাগ
২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আবদুল কাদের মোল্লার ‘তুলনামূলক লঘু শাস্তি’র রায় হয়েছে অভিযোগ তুলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী শাহবাগ মোড়ে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তা রূপ নেয় এক বিশাল নাগরিক আন্দোলনে, যা ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ নামে পরিচিতি পায়। ২০১৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি আনুমানিক ৩ লাখ মানুষ জড়ো হয়েছিল শাহবাগ মোড়ে। ১৯ দিন ধরে চলা লাগাতার অবস্থান কর্মসূচিতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষজন উপস্থিত হয়ে সংহতি জানায়।

কাদের মোল্লার রায়ের প্রতিবাদে যে আন্দোলনের জন্ম সেদিন শাহবাগে হয়েছিল, তা ধীরে ধীরে বাংলাদেশের নাগরিক রাজনীতির মানচিত্র পাল্টে দেয়। সময় গড়াতে গড়াতে এই শাহবাগই পরিণত হয় ছাত্র-তরুণদের অভ্যুত্থানের প্রতীকী ও বাস্তব কেন্দ্রবিন্দুতে, যার সবশেষ রূপ আমরা দেখেছি ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানে।

২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন
২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছাত্র-আন্দোলন শুরু হয়, যা পরিচিত ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’ নামে। মূলত সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে সারা দেশের শিক্ষার্থী ও চাকরি-প্রত্যাশীরা রাস্তায় নামেন। এই আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে ঢাকার শাহবাগ মোড় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা।

সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা সংরক্ষিত ছিল নিম্নরূপ। এর ফলে মেধা ভিত্তিক প্রতিযোগিতার জন্য মাত্র ৪৪ শতাংশ পদ খোলা থাকত, যেখানে প্রতিবছর লক্ষাধিক প্রার্থী পরীক্ষা দিতেন।

কোটা পদ্ধতির সংস্কার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা পাঁচ দফা দাবি উত্থাপন করেন। মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ সকল কোটা যৌক্তিক হারে কমিয়ে ১০%-এ আনা; কোটা থেকে নিয়োগযোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্য পদগুলো মেধা তালিকা থেকে পূরণ; একই ব্যক্তি যেন একাধিকবার কোটা সুবিধা না পায়; বিশেষ কোটার কোনো অব্যবহৃত সুবিধা যেন আরেক বছর বহাল না থাকে এবং কোটার বিষয়ে স্বচ্ছতা ও নিয়োগ পরীক্ষায় লিখিত-প্রকাশসহ সব ধাপে প্রকাশযোগ্যতা নিশ্চিত করার দাবি তোলেন শিক্ষার্থীরা।

কোটা সংস্কারের দাবির আন্দোলনে প্রথম দিকে সরকার অনড় অবস্থান নেয়। তবে গণচাপ বাড়তে থাকলে ১১ এপ্রিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে ঘোষণা দেন, সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করা হবে। এটি ছিল গণজাগরণ মঞ্চের পর সবচেয়ে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলন।

২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন প্রমাণ করেছে, তরুণরা ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতার প্রশ্নে দলীয় বিভাজনের বাইরে গিয়েও একত্রিত হতে পারে। এই আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল শাহবাগ।

জুলাই অভ্যুত্থান: শাহবাগে পতন ফ্যাসিবাদের
২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নাগরিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ ও বিক্ষোভের প্রধানতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় শাহবাগ।

কোটা সংস্কার আন্দোলনে শাহবাগ থেকে ব্লকেড কর্মসূচি পরিচালিত হয়ে পৌঁছে যেত চারপাশে। বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, সায়েন্স ল্যাব, নীলক্ষেত মোড়, চানখারপুল, মৎস্যভবন এবং পুরানা পল্টন মোড়; প্রতিদিন একটু একটু করে ঢাকা অচল করে দিয়েছিলেন কোটা আন্দোলনকারীরা। কোটা আন্দোলন পরিণত হয় স্বৈরাচারী হাসিনার পতনের এক দফার আন্দোলনে। প্রায় দেড় হাজার ছাত্র-জনতার প্রাণের বিনিময়ে ১৫ বছরের স্বৈরাশাসনের অবসান ঘটে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে।  

৫ আগস্টের পরেও আন্দোলনের রাজধানী শাহবাগ
জুলাই অভ্যুত্থানের পর বছরজুড়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন পেশাজীবীদের অবরোধ ও অবস্থান কর্মসূচিতে আন্দোলনের রাজধানীতে পরিণত হয় শাহবাগ।

এসব আন্দোলনের অনেকগুলোতেই নিজেদের দাবিদাওয়া আদায় করে নিতে পেরেছেন আন্দোলনকারীরা। আবার দীর্ঘ অবরোধের কারণে তীব্র ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে রাজধানীবাসীকে।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত এক বছরে প্রায় ৩০টি ঘটনায় শাহবাগ এলাকা অচল করে দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। রিকশাচালক থেকে শুরু করে শিক্ষক, পেশাজীবী সংগঠন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দল; সবার আন্দোলনের কেন্দ্রে পরিণত হয় শাহবাগ।

জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পরপরই বাংলাদেশের কয়েকটি স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এর অধিকাংশই ছিল রাজনৈতিক। ৯ আগস্ট সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় বিক্ষোভ ডেকে রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন সনাতনধর্মাবলম্বীরা।

কয়েকদিন ধরে এই আন্দোলন চলে। ১২ আগস্ট দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনায় দ্রুত বিচার চেয়ে পৃথক ট্রাইব্যুনাল গঠনের দাবি জানিয়ে শাহবাগ অবরোধ করেছেন হিন্দু জাগরণ মঞ্চ এবং বাংলাদেশ সনাতন ছাত্র ও নাগরিক সমাজ।

১৫ আগস্ট রাজধানীর শাহবাগে ‘রেজিস্ট্যান্স উইক’ ঘোষণা পালন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ১৭ আগস্ট চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন সরকারি সব দপ্তর ও অধিদপ্তরের আউটসোর্সিং দৈনিক মজুরিভিত্তিক ও প্রকল্পে কর্মরত কর্মচারীরা। পরে ২৬ আগস্ট ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের দাবিতে প্যাডেলচালিত রিকশাচালকরা শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন।

২২ আগস্ট চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন আনসার সদস্যরা। ৩০ আগস্ট ভারতীয় পানি আগ্রাসনের প্রতিবাদ ও স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে গণহত্যার বিচারের দাবিতে শাহবাগে ইসলামী আন্দোলনের ছাত্র আন্দোলনের সমাবেশ করেন।

৭ সেপ্টেম্বর সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার দাবিতে আন্দোলনে নামেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। পরে তারা একাধিকবার শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন। ৯ সেপ্টেম্বর সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরত আউটসোর্সিং কর্মকর্তারা স্থায়ী নিয়োগের দাবি জানিয়ে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন।

১৩ সেপ্টেম্বর সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন বন্ধ এবং দোষী ব্যাক্তিদের বিচারের ৮ দফা দাবিতে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যরা। পরে ১৬ অক্টোবর বৈষম্যহীন ফলাফল দেওয়ার দাবি জানিয়ে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন এইচএসসি শিক্ষার্থীরা।

১৯ অক্টোবর ফের আউটসোর্সিং কর্মকর্তারা শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন। ২৬ নভেম্বর দুর্নীবিরোধী বিশেষ সমাবেশের ঘোষণা দেওয়া হয়। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ততপরতায় তা পণ্ড হয়ে যায়।

২৯ ডিসেম্বর পোস্টগ্র্যাজুয়েট প্রাইভেট ট্রেইনি চিকিৎসকদের ভাতা ৩০ হাজার টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকা করার দাবিতে তারা রাজধানীর শাহবাগ মোড়ও অবরোধ করেন। একইদাবিতে ২২ ডিসেম্বরও তারা অবরোধ করেছিলেন।

২০২৫ সালেও নাগরিক আন্দোলনের কেন্দ্র শাহবাগ
এ বছরের ৯ জানুয়ারি সাবেক বিডিআর সদস্য এবং নিহতদের পরিবার রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন। পরে ২২ জানুয়ারি দশম গ্রেডের শূন্য পদে নিয়োগ, কর্মসংস্থান ও সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে নতুন পদ সৃজন, কোর্স কারিকুলাম সংশোধন ও প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে মেডিকেল ইনস্টিটিউট করাসহ একাধিক দাবিতে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন ম্যাটসের শিক্ষার্থীরা।

২৬ জানুয়ারি চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে শাহবাগে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষকরা অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। পরে তাদের ওপর জলকামান ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হয়। ৬ ফেব্রুয়ারি জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ও হতাহতদের পরিবার ৩ দফা দাবিতে শাহবাগ অবরোধ করেন।

১০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর শাহবাগে নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কতৃপক্ষের নিবন্ধন প্রত্যাশী ও সুপারিশপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষকরা অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। পরে তাদের উপর লাঠিচার্জ করে পুলিশ। এই অবস্থান কর্মসূচি কয়েকদিন চলে।

১৬ ফেব্রুয়ারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে বাতিল হওয়া নিয়োগ ফিরে পাওয়ার আশায় ঢাকার শাহবাগে যাদুঘরেরে সামনে সমাবেশ করেন একদল শিক্ষক। ১৭ ফেব্রুয়ারি জুলাই অভ্যুত্থানে আহতরা ফের শাহবাগ অবরোধ করেন।

২৩ এপ্রিল খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের একদল শিক্ষার্থী। পরে ২৭ এপ্রিল সরকারি কর্মকমিশন সংস্কারের দাবিতে শাহবাগ অবরোধ করেন একদল শিক্ষার্থী।

৯ মে আওয়ামীলীগ নিষিদ্ধের দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন ছাত্রজনতা। পরে আওয়ামীলীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া পর্যন্ত তারা শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন। তবে নিষিদ্ধের পর শাহবাগ ছেড়ে যাননি জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা। তারা আওয়ামীলীগকে নিষিদ্ধের পাশাপাশি জুলাই সনদ ঘোষণা করা এবং জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ব্যাক্তিদের চিকিৎসা নিশ্চিতের দাবিতে ১১ মে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন।

একইদিন নারীর ওপর ধর্ষণ ও সহিংসতার ঘটনায় আন্দোলন করেন প্রায় ৩০ কলেজের শিক্ষার্থীরা। ১৪ মে ডিপ্লোমাকে ডিগ্রির মান দেওয়ার জন্য নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থীরা শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন।

পরে ১৮ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যার বিচার চেয়ে রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন ছাত্রদল নেতারা। এই অবরোধ কয়েকদিন চলে।

এসকে/এফএইচ/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।