বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে না কি সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের প্রতিনিধিত্বের পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হবে, তা নিয়ে চলছে বিস্তর বিতর্ক। এই বিতর্কে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের দাবি তোলা রাজনৈতিক দলগুলো ইউরোপের দেশ জার্মানির আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতিকে উদাহরণ হিসেবে সামনে এনেছেন।
ইউরোপের প্রভাবশালী দেশ জার্মানিতে সংসদীয় ব্যবস্থার স্বচ্ছতা, গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক ভারসাম্যের জন্য মিশ্র আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ফেডারেল কাঠামোর দ্বি-কক্ষের সংসদ রয়েছে। ফেডারেল কাঠামোয় নিম্নকক্ষ সংসদের নাম বুন্ডেসটাগ (Bundestag) এবং উচ্চকক্ষ বুন্ডেসরাট (Bundesrat)। এই দুই সংসদ মিলে জার্মানিতে আইন প্রণয়ন ও সরকার গঠনের প্রক্রিয়া পরিচালনা করে। তবে এই কাঠামোতে কোনো দল মোট ভোটের শতকরা ৫ শতাংশের কম পেলে তারা সংসদে কোনো আসন পায় না।
জার্মানির সংসদীয় পদ্ধতি পর্যালোচনায় দেখা যায়, বুন্ডেসটাগ হলো জার্মান ফেডারেল ব্যবস্থায় সংসদের নিম্নকক্ষ, যেটি সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত। বুন্ডেসটাগ অনেকটা বাংলাদেশের সংসদের মতোই। বুন্ডেসটাগে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পাওয়া দলীয় সংসদ সদস্যরাই সরকার গঠন করে থাকে। কেউ এককভাবে পর্যাপ্ত আসন না পেলে তারা জোট সরকার গঠন করে থাকে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বুন্ডেসটাগে সবচেয়ে বেশি আসন পাওয়া দল সিডিইউ/সিএসইউ নেতা ফ্রেডরিখ মার্স দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাওয়া এসপিডির সঙ্গে জোট করে এখন জার্মানির চ্যান্সেলর (প্রধানমন্ত্রী)।
জার্মানিতে নির্বাচনের ধরন
জার্মানির নির্বাচন ব্যবস্থা মিশ্রধর্মী। জার্মানির সংসদের নিম্নকক্ষ বুন্ডেসটাগে ২৯৯টি আসনে সরাসরি ভোট হয়। অনেকটা বাংলাদেশের ৩০০টি সংসদীয় আসনের মতো। এখানে ভোটাররা দুটি ব্যালট পেপারে ভোট দিয়ে থাকেন। প্রথম ব্যালট পেপার বাংলাদেশের ভোটাররা যেমন তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে জয়ী করে থাকেন তেমনি। এখানে বাংলাদেশের মতোই সবচেয়ে বেশি ভোট যিনি পাবেন তিনিই এমপি হবেন। দ্বিতীয় ব্যালট পেপারে সরাসরি দলকে ভোট দেওয়া যায়। এখানে কেউ একজন নির্দিষ্ট আসনে দলীয় একজন প্রার্থীকে ভোট দিয়েও জাতীয়ভাবে ওই প্রার্থীর দলকে বাদ দিয়ে অন্য যেকোনো দলকে ভোট দিতে পারেন। এই দ্বিতীয় ভোটই পার্লামেন্টে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে দলীয়ভাবে আসন বণ্টনে মূল ভূমিকা রাখে।
কেন এই আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি
মূলত ভারসাম্যের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যই জার্মানিতে এই পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। এতে কোনো দলের প্রার্থী ২৯৯টি আসনে সরাসরি ভোটে জয়ী হলেও, সংসদের ভারসাম্যের জন্য যেসব দল শতকরা ৫ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে, তারাও আনুপাতিকহারে সংসদে আসন পাবে। এ কারণে জার্মানির সংসদে বর্তমানে মোট আসন সংখ্যা ৭৩০টি। ২৯৯টি সরাসরি ভোটে, বাকিগুলো আনুপাতিক ভোটে প্রাপ্ত আসন। আনুপাতিক ভোটের হারের হিসেবে এই আসন কমে বা বাড়ে। কেননা, ৫ শতাংশের কম ভোট পেলে কোনো দলই আসন পায় না।
বুন্ডেসরাট: রাজ্য সমন্বয়মূলক উচ্চকক্ষ
বুন্ডেসরাট হলো জার্মানির সংসদের উচ্চকক্ষ। জার্মানিতে ১৬টি ফেডারেল রাজ্য রয়েছে। বুন্ডেসরাটে ১৬টি ফেডারেল রাজ্যের রাজ্য সরকার তাদের নিজস্ব প্রতিনিধি পাঠায়। বুন্ডেসরাটে মোট ৬৯টি আসন রয়েছে। রাজ্যের আয়তন ও জনসংখ্যা অনুযায়ী ৩ থেকে ৬ জন প্রতিনিধি তারা বুন্ডেসরাটে পাঠাতে পারে। বুন্ডেসরাট বা উচ্চকক্ষ মূলত আইন পাস, বাজেট ও ফেডারেল নীতির ওপর যৌথ সিদ্ধান্তে প্রভাব রাখে।
যেভাবে হয় চ্যান্সেলর নির্বাচন
২৯৯টি আসনে নির্বাচনের পর সংসদে ৫ শতাংশের বেশি ভোট পাওয়া দলগুলোর মধ্যে আনুপাতিক হারে বাকি আসনগুলো বণ্টন করা হয়। বর্তমান বুন্ডেসটাগ সংসদে ৭৩০ জন এমপি রয়েছেন। যাদের মধ্যে ২৯৯ জন সরাসরি ভোটে নির্বাচিত। অন্যরা আনুপাতিকহারে বরাদ্দ ভোটের ভিত্তিতে নির্বাচিত এমপি। সব মিলিয়ে সবচেয়ে বেশি আসনপ্রাপ্ত দল বা জোট চ্যান্সেলর প্রার্থী মনোনয়ন দেয়। অনেকটা বাংলাদেশের মতোই। সবচেয়ে বেশি এমপি যে দলের বা জোটের, সেই জোট বা দল থেকেই প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হবেন।
এমজেএফ