ঢাকা, রবিবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৯ মে ২০২৪, ১০ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

বর্ষা আগমনে নৌকা মেরামতে ব্যস্ত চরের মাঝি-কারিগররা

কাওসার উল্লাহ আরিফ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯১৯ ঘণ্টা, জুন ৯, ২০২০
বর্ষা আগমনে নৌকা মেরামতে ব্যস্ত চরের মাঝি-কারিগররা

বগুড়া: বগুড়ায় চরাঞ্চলের মাঝি ও কারিগররা বর্ষাকালকে সামনে রেখে এর প্রস্তুতি স্বরূপ নৌকা তৈরি ও মেরামতের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। যমুনায় চরাঞ্চলের বিশাল জলরাশিতে জেগে রয়েছে অসংখ্য চর। চরের এসব জমিতে কৃষির নানান কাজের সঙ্গে নৌকা তৈরি ও মেরামতে ব্যস্ত (মাঝি-মাল্লা ও কারিগর) চরাঞ্চলের মানুষগুলো।

সোমবার (৮ জুন) বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলায় চরাঞ্চলের এলাকাগুলো ঘুরে দেখা গেছে, মানুষের এমন কর্মব্যস্ততা। বর্তমান আবহাওয়ায় প্রখর রোদ ও বৃষ্টিকে উপেক্ষা করেই তারা বর্ষার আগাম প্রস্তুতিতে নিরলস সময় কাটাচ্ছেন।

জেলায় চরাঞ্চলের এসব মানুষগুলোর আহার সংগ্রহ থেকে শুরু করে বেঁচে থাকা ও জীবনধারণে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়। প্রয়োজনে প্রায়ই পাড়ি দিতে হয় যমুনার বিশাল জলরাশি। যেখানে পারাপারের মাধ্যম নৌকা। মাছ ধরার কাজেও ব্যবহৃত হয় এই বাহনটি। সবমিলিয়ে যমুনাপাড়ের মানুষের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম মাধ্যম এই নৌকা।

নৌকা মেরামতে ব্যস্ত কারিগর।  ছবি: কাওছার উল্লাহ আরিফসরেজমিনে দেখা গেছে, যমুনা বেষ্টিত বগুড়ার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলায় যমুনার বাঁধ ও চর এলাকাগুলোতে নৌকা মেরামতে ব্যস্ত মাঝি-মাল্লাসহ একাধিক দক্ষ কারিগর। একদিকে কারিগরা তৈরি করছে নতুন নৌকা অন্যদিকে পুরনো নৌকার বিভিন্ন অংশ সংস্কারে মত্ত মাঝি-মাল্লারা। এরমধ্যে সারিয়াকান্দির সিংহভাগ ওপর দিয়ে বহমান যমুনা নদী। যমুনার হিংস্রতা এখন কম। বিশাল জলধারা এখন অনেকটাই ফাঁকা। সেখানে জায়গা করে নিয়েছে অসংখ্য বালুচর।

যমুনার বিশাল জলধার একচর থেকে অন্য করে পাড়ি দেওয়া মাধ্যম নৌকা। পাল তোলা নৌকার সাক্ষাৎ পাওয়া এখন দুষ্কর। বর্তমানের চিত্রটা ভিন্ন। পালের জায়গায় স্থান পেয়েছে ইঞ্জিনচালিত নৌকা। সীমিত আকারে আগের নৌকাও চোখে পড়ে।

সারিয়াকান্দি উপজেলার নৌকা কারিগর গৌরব দাস, মান্নান মিয়া, ইসহাক আলী বাংলাননিউজকে জানান, বর্তমান সময়টা নৌকা মেরামতের উপযুক্ত সময়। অনেকেই নতুন করে তৈরি করছেন ছোট-বড় অনেক নৌকা। সাধারণত যমুনার চরাঞ্চল ও বাধ এলাকাগুলোতেই এ কাজগুলো করা হয়ে থাকে।

তারা জানান, জ্যৈষ্ঠের শেষ সময়টাতে প্রকৃতি এখন তার নিজ খেয়াল-খুশি মতো চলছে। মাঝেমধ্যেই কালবৈশাখী ঝড়সহ মুষলধারে বৃষ্টি হয়। আর এরই ফাঁকে যমুনায় চরাঞ্চলের বাহন নৌকা মেরামত বা নতুন করে তৈরির কাজে ব্যস্ত তারা।

নৌকা মেরামতে ব্যস্ত কারিগর।  ছবি: কাওছার উল্লাহ আরিফমো. নজরুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, চরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় তিনি ও তার সঙ্গীয় দল প্রায় দুই দশক ধরে নৌকা মেরামত ও নতুন নৌকা তৈরির কাজ করে আসছেন। সেই পালতোলা নৌকার সময়কাল থেকে তাদের এ কাজে পথচলা। আগে তো ইঞ্জিনচালিত নৌকা তেমন ছিলো না। লগি-বৈঠা দিয়ে নৌকা চালাতো মাঝি-মাল্লারা। পরিবর্তনের হাওয়ায় এসব নৌকার জায়গার স্থান করে নিয়েছে ইঞ্জিনচালিত ছোট-বড় অসংখ্য নৌকা।

নজরুল ইসলাম আরও জানান, প্রতিবছর ফাল্গুন মাস থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত সময়টাতে পুরনো নৌকা মেরামত বা সংস্কার আর নতুন নৌকা তৈরির তোড়জোড় চলে যমুনা বেষ্টিত এলাকাগুলোতে। তবে জ্যৈষ্ঠ মাসেই সিংহভাগ কাজ হয়ে থাকে। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। অনেকেই নতুন নৌকা বানিয়ে নিচ্ছেন আবার পুরানো নৌকাগুলোর মেরামত বা সংস্কারের কাজও করছেন।

তিনি আরও জানান, বর্ষা এগিয়ে আসছে। তাই বর্তমান সময়টায় নতুন নৌকা তৈরির চেয়ে পুরানো নৌকা মেরামতের কাজই বেশি হচ্ছে। বর্তমানে তিনি যে নতুন নৌকাটির কাজ করছেন এটির দৈর্ঘ্য ৩৯ হাত এবং প্রস্থ ৬ হাত। এর তলায় রয়েছে আম গাছের কাঠ এবং নৌকার বাকি ফ্রেমে রয়েছে ইউক্যালেক্টর কাঠ। ভালো মানের এ নৌকাটি তৈরিতে রাত-দিনে তাদের পাঁচজনের ৩৩ হাজিরা পারিশ্রমিক ও ভালো ইঞ্জিনসহ এক লাখ ৬০ হাজার টাকার মতো ব্যয় হবে এবং নৌকাটি সম্পূর্ণ তৈরি হতে সময় লাগবে সর্বোচ্চ ৮ থেকে ১০ দিন। তবে এর আগেই নৌকা তৈরির কাজটি শেষ করার চেষ্টা করবেন তারা।

নৌকা মেরামতে ব্যস্ত কারিগর।  ছবি: কাওছার উল্লাহ আরিফসেনাতলা উপজেলার নৌকার মাঝি জব্বার মোল্লা, রুস্তম আলীসহ একাধিক ব্যক্তি বাংলানিউজকে জানান, ডিজিটাল যুগে লগি-বৈঠার দিন শেষের দিকে এলেও সস্পূর্ণ বিলীন হবে না। আর এ পরিবর্তনের যুগেও যমুনা পারাপারে ও মাছ ধরার কাজে নৌকা ছাড়া বিকল্প আর কিছুই নেই।

তারা জানান, প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বেড়েছে ইঞ্জিনচালিত নৌকার ব্যবহার। তবে অনেক মানুষ এখনো লগি-বৈঠার নৌকায় চলাচল করতে অনেকটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে থাকেন।

ধুনট উপজেলার ভান্ডারবারি এলাকার নৌকার মাঝি ছামসুল আলী, জাহিদুল, আমজানসহ কয়েকজন ব্যক্তি বাংলানিউজকে জানান, বগুড়া জেলার ধুনট, সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা উপজেলা যমুনা ঘেঁষা। এ উপজেলার মানুষগুলোর আতঙ্কে দিন কাটাতে হয় বছরের বর্ষা মৌসুমটায়।

তারা জানান, যমুনা তাদের গ্রাস করেই চলছে এটা নতুন কিছু নয়। চরাঞ্চলের মানুষগুলো ইচ্ছে করলেই অন্য কোনো জায়গায় থাকার কথা চিন্তাও করতে পারে না। ইচ্ছে থাকলেও যমুনা ছেড়ে অন্যত্র যেতে পারে না। তাই সংগ্রাম করে বেঁচে থেকে নৌকার মাধ্যমেই জীবিকা নির্বাহ করেন তারা।

চরাঞ্চলের অসংখ্য মানুষের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে নৌকার ব্যবহার। তাই এ এলাকার মানুষগুলো বর্ষা মৌসুমের আগেই তাদের চাহিদা মোতাবেক নৌকা তৈরি ও পুরনো নৌকাগুলো মেরামতের কাজ সস্পূর্ণ করেন। কারণ এই বাহনটি এ অঞ্চলগুলোর মানুষের চলাচল ও জীবিকা নির্বাহে অন্যতম ভূমিকা পালন করে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯১০ ঘণ্টা, জুন ০৯, ২০২০
কেইউএ/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।