ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

ফিচার

পর্ব ৮

মুর্শিদকুলি খাঁর কলিজাখেকো মেয়ের সমাধি!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০১৭
মুর্শিদকুলি খাঁর কলিজাখেকো মেয়ের সমাধি! মুর্শিদাবাদের পথে পথে

মুর্শিদাবাদ ঘুরে: নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর মেয়ে আজিমুন্নিসা বা জিন্নতউন্নিসা। তার অন্য নাম জায়নাব উন্নিসা। নবাব পরিবারের অত্যন্ত প্রভাবশালী নারী ছিলেন তিনি। মুর্শিদকুলি খাঁর মৃত্যুর পর তার স্বামী সুজাউদ্দিন ও পরে ছেলে সরফরাজ খাঁ বাংলার নবাব হন। 

১৭৩০ সালে আজিমুন্নিসার মৃত্যু হয়। মুর্শিদাবাদের মহিমাপুর রয়েছে তার সমাধি।

মসজিদটি আজ পুরোই ধবংসপ্রাপ্ত। শুধু একটি দেয়ালের অংশবিশেষ আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে। মুঘল স্থাপত্যে গড়া প্রধান ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকলে সোজা একটি পথ উঠে গেছে উঁচু একটি মঞ্চের মতো ঢিবির উপর। এই ঢিবির উপর রয়েছে ফুলের বাগান।  

আজিমুন্নিসার সমাধির প্রধান ফটক 

সিঁড়ি বেয়ে এই ঢিবি বা বাগানে উঠতে হয়। সিড়িতে না উঠে বামদিক দিয়ে সিড়ির নিচের দিকে এগুলেই দেখা যাবে একটি সমাধি। এটিই আজিমুন্নিসার সমাধি।  

১৭৩০ সালে বেগম আজিমুন্নিসা মারা যান।  

১৭৩৪ সালে এখানে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। বাবার সমাধির মতো তিনিও প্রবেশ সোপানের তলদেশে সমাহিত। অলঙ্করণ ও স্থাপত্য বিন্যাসে কাটরা মসজিদের সঙ্গে এর সাদৃশ্য রয়েছে। ব্রিটিশ পূর্ববর্তী স্থাপত্যের মতো এখানেও রয়েছে মুঘল ছাপ।  

মসজিদে ওঠার সিড়ি

মুর্শিদকুলি খাঁর কোনো পুত্র সন্তান ছিলো না। তার একমাত্র কন্যা জিন্নতউন্নিসা। কিন্তু জামাতা সুজাউদ্দিনের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো ছিলো না। ফলে তিনি আজিমুন্নিসার পুত্র দৌহিত্র সরফরাজকে বাংলার পরবর্তী নবাব ঘোষণা করেন এবং দিল্লির সম্রাটের কাছ থেকে অনুমোদন আনার চেষ্টা করেন। ওদিকে, সুজাউদ্দিনকে তিনি উড়িষ্যার ছোট নবাব করেছেন। কিন্তু সুজাউদ্দিনও নিজেকে নবাব করার জন্য দিল্লিতে দূত পাঠান।  

এই সিঁড়ির নিচেই সমাধি

দিল্লির সম্রাট সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ম অনুযায়ী সুজাউদ্দিনকেই অনুমোদন দেয়।

এদিকে, মুর্শিদকুলি খাঁও মৃত্যুসজ্জায়। সুজাউদ্দিন দিল্লির অনুমোদন পেয়ে মুর্শিদাবাদের দিকে অগ্রসর হন। পথিমধ্যেই খবর পান মুর্শিদকুলি খাঁ মারা গেছেন। তাকে আর মুর্শিদকুলি খাঁর মৃত্যু পর্যন্তও অপেক্ষা করতে হলো না। মুর্শিদাবাদ এসে তিনি নিজেকে বাংলার নবাব ঘোষণা করেন ও চেহেলসেতুন প্রাসাদের সিংহাসনে বসেন।  

অন্যদিকে, দৌহিত্র সরফরাজ খাঁও মানসিকভাকে নবাব হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলেন। ফলে পিতা-পুত্রের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্ব বেঁধে গেলো। এ দ্বন্দ্ব নিরসনে মুর্শিদকুলি খাঁর স্ত্রী নৌসেরী বানু ও মেয়ে আজিমুন্নিসা এগিয়ে এলেন। তারা বোঝালেন যে, বাবার পরে তুমিই হবে নবাব। তাই অকারণ রক্তক্ষয় করো না। সরফরাজ পিতা সুজাউদ্দিনকেই নবাব হিসেবে মেনে নিলেন। সুজাউদ্দিন ১৭২৪ সালে বাংলার নবাব হলেন। তার অন্য নাম সুজাউদ্দৌলা।  

ধবংসপ্রাপ্ত মসজিদের দেয়াল

সুজাউদ্দিন ও তার স্ত্রী আজিমুন্নিসার সম্পর্ক ভালো ছিলো না। সুজা উড়িষ্যায় ছোট নবাব থাকাকালে আজিমুন্নিসা সেখানে যাননি। তিনি বাবার সঙ্গে মুর্শিদাবাদেই ছিলেন। সুজাউদ্দিন উচ্ছৃংখল স্বভাবের ছিলেন। সে কারণে পিতা নবাব মুর্শিদকুলি খাঁও জামাতা সুজাউদ্দিনকে পছন্দ করতেন না। তাই তাকে উত্তরাধিকারী মনোনীত না করে দোহিত্র সরফরাজকে নবাব করার জন্য মনোনীত করেন।  

কথিত আছে, জিন্নাতউন্নিসা একসময় কঠিন ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। ফলে হেকিমের নিদান অনুযায়ী জীবন্ত মানুষের কলিজা মিশ্রিত ওষুধ খেয়ে সুস্থতা লাভ করেন। কিন্তু সুস্থ হয়ে ওঠার পরেও কলিজা খাওয়ার অভ্যাসটি তিনি পরিত্যাগ করতে পারেননি। অনেকে বলেন, তিনি শিশুদের কলিজা খেতেন। বলা হয়, এর ফলে বহু নগরবাসী ও হেরেমবাসীদের প্রাণনাশও করেছেন। আজিমুন্নিসাকে ‘কলিজাখালী’ বলেও অনেকে অবহিত করেন।  

আজিমুন্নিসার সমাধি

এতে ক্রুদ্ধ হয়ে নবাব সুজাউদ্দিন নিজের স্ত্রীকে জীবন্ত অবস্থায় কবর দেন। অনেকে বলেন, তার পিতাই তাকে জীবন্ত কবর দেন।  

মসজিদে ওঠার সিঁড়ির নিচেই তার সমাধি। সাধারণ মানুষের পদধূলিতে তার পাপ মোচনের জন্যই মসজিদে ওঠার সিঁড়ির নিচে তাকে সমাহিত করা হয়।

আজিমুন্নিসার মৃত্যু নিয়ে আরও নানা গল্প-গুজব ও রহস্য রয়েছে। মৃত্যুর প্রায় তিনশো বছর পরেও রহস্যের অন্তরালেই রয়ে গেলেন আজিমুন্নিসা।  

বাংলাদেশ সময়: ১৯২৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০১৭
এসএনএস

আগের পর্ব পড়ুন-
** ১ম পর্ব: এক যে ছিলো মুর্শিদাবাদ
** ২য় পর্ব: কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ
** ৩য় পর্ব: মানুষ যে হায় ভুলে গেছে চির মধুর ভালোবাসা
** ৪র্থ পর্ব: চার ভাইয়ের বাগান বিলাস ও একটি গুপ্তপথ

** ৫ম পর্ব: জগৎশেঠকে সপরিবারে হত্যা করা হয় যে প্রাসাদে
** ৬ষ্ঠ পর্ব: নুরলদীনের ‘জাগো বাহে’ শোনা যায় নসীপুর প্রাসাদে
** ৭ম পর্ব: কিরীটেশ্বরী মন্দির ও জগদ্বন্ধু সুন্দরের আশ্রম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।