ঢাকা, শনিবার, ২৫ আশ্বিন ১৪৩২, ১১ অক্টোবর ২০২৫, ১৮ রবিউস সানি ১৪৪৭

সারাদেশ

তরুণ মাশরুম চাষি সাইফুলের মাসিক আয় দেড় লাখ

জাহিদ হাসান জিহাদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪:২৫, অক্টোবর ১০, ২০২৫
তরুণ মাশরুম চাষি সাইফুলের মাসিক আয় দেড় লাখ নিজের দোকানে কুষ্টিয়ার সফল মাশরুম চাষি সাইফুল ইসলাম এখন হাজারো মানুষের স্বপ্নদ্রষ্টা

কুষ্টিয়া: বাণিজ্যিকভাবে মাশরুম চাষ করে সফল হয়েছেন কুষ্টিয়া সদর উপজেলার সাইফুল ইসলাম। মাসে আয় করছেন এক লাখ ৫০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ ৭০ হাজার টাকা।

 

নিজে সাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি এলাকার বেকারদেরও সাবলম্বী করতে দিচ্ছেন প্রশিক্ষণ। ইতিমধ্যে পাঁচশ’ বেকার তার কাছ থেকে প্রশিক্ষিত হয়েছেন।  

এক সময়ের চাকুরে সাইফুল ইসলাম কাজ হারিয়ে অর্থ সংকটে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। বাড়ি ফিরে মাত্র ছয় হাজার টাকা ধার করে একশ’টি স্পন (মাশরুম চাষে ব্যবহৃত মাইসেলিয়ামযুক্ত বীজ) নিয়ে শুরু করেন চাষ।

বর্তমানে সাইফুল ইসলামের অধীনে কাজ করেন ১৫জন শ্রমিক। সেইসাথে তার কাছ থেকে পাঁচ শতাধিক মানুষ হাতে কলমে প্রশিক্ষণ নিয়ে মাশরুম চাষ করেছেন। এছাড়া প্রতিনিয়ত নতুন ও তরুণ উদ্যোক্তারা এসে তার কাছ থেকে মাশরুমের উৎপাদন কৌশল শিখছেন। একসময় যাকে ‘ব্যাঙের ছাতা তৈরির কারিগর হিসাবে’ বন্ধুরাও দূরে ঠেলে দিয়েছিলেন সেই সাইফুল এখন হাজারো মানুষের স্বপ্নদ্রষ্টা।

কুষ্টিয়া শহরের ব্যস্ততম সাদ্দাম বাজার মোড়ের সদর হাসপাতালে যাওয়ার রাস্তার শুরুতেই সাইফুল ইসলামের মাশরুমের দোকান। মাশরুমের তৈরি বিভিন্ন মুখরোচক খাবার তৈরি হয় এখানে। সেই সাথে মাশরুম এবং ড্রাই ও পাউডার আকারেও বিক্রি করা হয়। দুজন কর্মচারী সবসময় ব্যস্ত থাকেন সেখানে মাশরুমের খাবার তৈরি করতে। মালিক সাইফুল ইসলাম বসে হিসাব দেখাশোনা করেন।  
সাইফুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘২০১৮ সালে মাশরুম চাষ শুরু করি। আমি বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকরি করেছি। চাকরি হারিয়ে বাড়ি ফিরে এসে একটি ব্যবসা শুরু করি। সেখানে লোকসান খেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ি। ’

‘তখন আমার মনে হয় চাকরিতে থাকা অবস্থায় মাশরুমের একটা প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। শুরু করি মাশরুম চাষ’-বলেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘শুরুর সময়ে কোন টাকা ছিল না। খুবই কষ্ট করে মাত্র ছয় হাজার টাকা ধার নিয়ে আমি মাশরুম চাষ শুরু করি। সাভার মাশরুম সেন্টার থেকে একশ’ পিস স্পন কিনে আনি। বর্তমানে আমার প্রতি চালানে আট হাজারের মতো স্পন তৈরি হয়। ১৫ হাজারের মতো স্পন রাখার স্থান রয়েছে আমার খামারে। নিজের খামারে আমি মাশরুমের মাদার, স্পন এবং টিস্যু কালচার করি। ’

তিনি বলেন, ‘এক সময় আমাকে অনেকেই অনেক কটু কথা বলেছেন। ব্যাঙের ছাতা তৈরি করি বলে অনেক বন্ধু আমার সাথে মেশা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এগুলোতে আমি হতাশায় ভুগতাম। কিন্তু সাহস পেয়েছি কৃষি অফিসের পরামর্শ ও সহায়তায়। ’

সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমার এখানে ১৫-১৬জন কাজ করে। প্রতিদিন ৪০-৬০ কেজি মাশরুম উৎপাদন হয়। প্রতিকেজি দুশ’ টাকা করে বিক্রি করি। এছাড়া একটি বিক্রয় কেন্দ্র করেছি। সেখানে দুজন শ্রমিক কাজ করেন। তারা মাশরুম দিয়ে বিভিন্ন মুখরোচক খাবার তৈরি করেন। শুরুতে মাশরুম বিক্রি করতে পারতাম না। তবে বর্তমানে মাশরুমের যে চাহিদা তাতে ড্রাই করার মতো সময় পাই না। ড্রাই করতে পারলে বিদেশে রপ্তানি করা যায়। ’

তিনি জানান, বর্তমানে তার প্রায় ২৬ লাখ টাকার মতো মূলধন সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিমাসে আমার দেড় লাখ টাকা থেকে এক লাখ ৭০ হাজার টাকা আয় হয়। সারাদেশে মাশরুমের বীজ সরবারহ করতে চাই। যার মাধ্যমে ৬০ থেকে ৮০ হাজার মানুষের বেকারত্ব দূর করতে পারবো। ’

তিনি বলেন, ‘আমার এখান থেকে প্রায় পাঁচশ’জন হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। এর মধ্যে দশ শতাংশ টিকে রয়েছেন, যারা বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করছেন। তবে, নারীরা ঘরে বসে এ মাশরুম চাষ করতে পারছে বিধায় তারা বেশি উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। ’

সাইফুল ইসলাম আরো বলেন, ‘আমার এ মাশরুম চাষ, বাজারজাত এবং পরামর্শ দিয়ে সর্বক্ষণিক সহযোগিতা করছে যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্প। এ প্রকল্প থেকেই আমি প্রশিক্ষণ নিয়েছি মাশরুম চাষ ও বাজারজাত করণের ওপরে। তারা আমাদের বিক্রির ব্যবস্থা করছে। সেইসাথে আমাদের প্রয়োজনীয় উপকরণ বিনামূল্যে দিয়েছে। আগামীতে ড্রাই করা এবং প্যাকেট করার জন্য কিছু মেশিনারিজ বিনামূল্যে দেওয়ার কথা রয়েছে, সেগুলো পেলে আরো উপকৃত হবো। ’

দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন আসে সাইফুল ইসলামের মাশরুম খামার দেখতে। তাদের মধ্যে একজন কুমারখালীর মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমি সাইফুল ভাইয়ের মাশরুম খামার দেখতে এবং এখান থেকে শিখতে এসেছি। নিজ বাড়িতে এ ধরনের একটি খামার করার ইচ্ছা আছে। শুনেছি এটি বেশ লাভজনক। এজন্য আমি শিখতে এসেছি। আমার মতো অনেকেই আসছেন। ’

সাইফুল ইসলামের কাছ থেকে মাশরুম চাষ শিখে বাণিজ্যিকভাবে চাষ শুরু করেছেন কুষ্টিয়ার জগতি এলাকার শিরিনা আক্তার। তিনি মোবাইলে ইউটিউব থেকে সাইফুল ইসলামের কাছে মাশরুম চাষ সম্পর্কে শিখে নিজেই এখন মাশরুমের স্পন (বীজ) তৈরি করছেন এবং চাষাবাদ করছেন।

শিরিনা আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমি গৃহস্থালীর কাজের পাশাপাশি কাঁথা সেলাই করতাম। এখন মাশরুম চাষ করছি। আমার বাড়িতেই ছোট একটি ঘরে ৫০০ প্যাকেট মাশরুমের স্পন দিয়ে চাষ শুরু করেছি। ইতিমধ্যে মাশরুম বিক্রি শুরু হয়েছে। সব মিলিয়ে আমার খরচ হয়েছে ২০ হাজার টাকার মতো। আশা করছি আমি ৫০ হাজার টাকার মাশরুম পাবো এই মৌসুমেই। এটি বাড়িতে করা যায় এবং নারীরাও বেশ সহজেই করতে পারে। ’

স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা নাসিম রেজা বাংলানিউজকে বলেন, ‘মাশরুম চাষের জন্য আলাদা করে জমির প্রয়োজন হয় না। বাড়িতেই এ চাষ করা যায়। আমরা যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও উপকরণ সহায়তা দিচ্ছি। এই এলাকায় সাইফুলের দেখাদেখি ৩০জন কৃষক-কৃষাণি মাশরুম চাষে উদ্বুদ্ধ হয়ে চাষ করছেন। ’

কুষ্টিয়া সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রুপালী খাতুন বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা মাশরুম চাষ সম্প্রসারণে যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় সাইফুল ইসলামকে চাষি প্রশিক্ষণ ও বাজারজাতকরণে উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ প্রদান করি। সেইসাথে তাকে একটি মাশরুমের প্রদর্শনী প্রদান করি। যার মাধ্যমে তিনি বাণিজ্যিকভাবে মাশরুম উৎপাদন করছেন। তিনি ইতিমধ্যে শহরে একটি সেল্স সেন্টারের মাধ্যমে মাশরুম বিক্রি করছেন এবং বিভিন্ন মুখরোচক খাবার তৈরি করে বিক্রি করছেন। ’

যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিচালক রবিউল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘মাশরুম অত্যন্ত পুষ্টিকর একটি সবজি। এটির চাষাবাদ খুবই লাভজনক। আমরা এ চাষ সম্প্রসারণে কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও প্রদর্শনী প্রদান করছি। সেই সাথে বাজারজাতকরণে সার্বিক সহযোগিতা করছি। ’

তিনি জানান, মাশরুম উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি তাদের প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়াজাতকরণ যন্ত্রপাতি বিনামূল্যে বিতরণ করছেন তারা। যার মাধ্যে নতুন কৃষি উদ্যোক্তা ও চাষিরা মাশরুম চাষ করে বেশ সফল হচ্ছেন।

রবিউল ইসলাম বলেন, ‘কুষ্টিয়া সদর উপজেলার সাইফুল ইসলাম আমাদের একজন সফল কৃষি উদ্যোক্তা। তিনি আমাদের সহযোগিতায় মাশরুম উৎপাদন করে নিজেসহ এলাকার অনেক মানুষের কর্মস্থান সৃষ্টি করেছেন। ’

এসএইচ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।