ঢাকা, সোমবার, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২, ১২ মে ২০২৫, ১৪ জিলকদ ১৪৪৬

সারাদেশ

দখল-দূষণে মৃতপ্রায় রহমতখালী খাল, বর্ষায় ফের জলাবদ্ধতা-বন্যার শঙ্কা

মো. নিজাম উদ্দিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:৩৪, মে ১২, ২০২৫
দখল-দূষণে মৃতপ্রায় রহমতখালী খাল, বর্ষায় ফের জলাবদ্ধতা-বন্যার শঙ্কা রহমতখালী খাল।

গত বছরের বন্যায় লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন এবং নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা দীর্ঘমেয়াদি পানিবন্দি অবস্থার মধ্যে পড়ে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বন্যার প্রধান কারণ ছিল রহমতখালী খালের পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা।

এক সময় আশীর্বাদস্বরূপ খালটি যেন এখন অভিশাপে রূপ নিয়েছে।

উজানের ফেনী নদীর পানি যখন বাড়ে, তখন তা নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলার ওপর দিয়ে রহমতখালী, ভূলুয়া ও ওয়াপদা খাল হয়ে মেঘনা নদীতে গিয়ে পড়ে। তবে এসব খালে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে পানি সঠিকভাবে নিষ্কাশন না হওয়ায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। অতিবৃষ্টির পানি এতে যোগ হয়ে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।

বন্যার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে খালের গভীরতা কমে যাওয়া, দুই পাড় সংকুচিত হওয়া, খাল দখল, দূষণ, মাছ ধরার জন্য বাঁধ নির্মাণ এবং সরু-নিচু ব্রিজ। এছাড়া খালের সংযোগ খালগুলো দখল ও ভরাট হওয়াও অন্যতম কারণ।

বন্যার পরে খাল দখলমুক্ত, খনন ও সংস্কারের দাবি উঠলেও মাঠপর্যায়ে তা বাস্তবায়িত হয়নি। খালের প্রতিবন্ধকতা, নাব্যতা সংকট, বর্জ্য অপসারণ এবং পানি প্রবাহ পুনরুদ্ধারের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বর্ষা মৌসুম আবারও আসছে, কিন্তু খালের সংকট সেই আগের জায়গাতেই রয়ে গেছে। তবে জেলা প্রশাসন বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করে আগামী জুনের মধ্যে তা সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছে।

পরিবেশবাদী সংগঠন ‘সবুজ বাংলাদেশ’-এর প্রতিষ্ঠাতা মো. শাহীন আলম বাংলানিউজকে বলেন, রহমতখালী খাল দখল ও দূষণে প্রায় নিশ্চিহ্ন। বাজার ও বসতবাড়ির বর্জ্য এবং পয়ঃবর্জ্য খালে ফেলা হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ায় খালটির পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়েছে। এ অবস্থায় এবারও বন্যার শঙ্কা রয়েছে।

লক্ষ্মীপুর প্রেসক্লাবের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মীর ফরহাদ হোসেন সুমন বাংলানিউজকে বলেন, প্লাস্টিক ও অপচনশীল বর্জ্যে খালটি ভরে গেছে। এতে পানি দূষিত হচ্ছে এবং খাল হারিয়েছে নাব্যতা। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও আইনি পদক্ষেপের মাধ্যমে খালটির স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

খালপাড়ের বাসিন্দারা জানান, খালের পানি কালো এবং দুর্গন্ধযুক্ত। এতে জন্ম নিচ্ছে মশা-মাছি ও বিভিন্ন কীটপতঙ্গ, বাড়ছে রোগবালাই।

স্থানীয় কলেজিয়েট স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আবু তাহের বলেন, এক সময় খালটিতে স্বচ্ছ পানি ও প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। চলত পণ্যবাহী নৌকা। এখন এসব কেবল স্মৃতি।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্যমতে, রহমতখালী এক সময় নদী ছিল। এখন তা খালে রূপান্তরিত হয়েছে। ফেনী থেকে শুরু হয়ে এটি নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর হয়ে মজুচৌধুরীর হাটে মেঘনায় গিয়ে পড়ে। দৈর্ঘ্য প্রায় ১৩৭ কিলোমিটার, প্রস্থ এক সময় ১২৮ মিটার থাকলেও দখল ও পলি ভরাটে এখন তা সংকুচিত। লক্ষ্মীপুর অংশে প্রায় ৪০ কিলোমিটার, এর মধ্যে পৌরসভার অংশ ৮ কিলোমিটার। বর্ষায় পানি নিষ্কাশন এবং বোরো মৌসুমে কৃষিকাজে খালটির গুরুত্ব অপরিসীম।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, লক্ষ্মীপুর পৌর বাজার, মাদাম, ঝুমুর, জকসিন, মান্দারী, বটতলী ও চন্দ্রগঞ্জ বাজার অংশে খালের দুই পাড়ে অবৈধ স্থাপনা এবং প্লাস্টিক বর্জ্যের স্তূপ।

গত বছরের বন্যার শুরুতে খাল দিয়ে পানি প্রবাহের চাপ গেলেও সংকুচিত ও বর্জ্য-পলি জমে ভরাট খালটি সেই চাপ নিতে পারেনি। ফলে খালসংলগ্ন বসতবাড়ি, ফসলি জমি, পুকুর ও রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে যায়। বিশেষ করে চন্দ্রগঞ্জ, হাজিরপাড়া, মান্দারী, বাঙাখাঁ ও পৌর এলাকায় ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়।

বন্যার ঠিক আগে ভারী বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। কারণ হিসেবে ড্রেনেজ ব্যবস্থার অভাব, পলি জমে খাল ভরাট, দখল এবং নিচু ও সরু কালভার্টকে দায়ী করা হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় বন্যার পানি।

জেলা প্রশাসন বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা নিরসনে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। ২৭ এপ্রিল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় নয়টি সমস্যা চিহ্নিত করে ১০টি পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- খাল দখলমুক্তকরণ, আবর্জনা পরিষ্কার, বাঁধ ও জাল অপসারণ, পরিকল্পিত কালভার্ট নির্মাণ, স্লুইস গেট রক্ষণাবেক্ষণ এবং জনসচেতনতা বাড়ানো।

লক্ষ্মীপুর পৌরসভার প্রশাসক মো. জসীম উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সভা হয়েছে। কচুরিপানা, জলজ উদ্ভিদ ও ময়লা পরিষ্কারের কাজ শুরু হয়েছে। অবৈধ দখলদার চিহ্নিতকরণে কমিটি গঠন করা হয়েছে। রিপোর্টের ভিত্তিতে উচ্ছেদ অভিযান ও অন্যান্য পদক্ষেপ নেওয়া হবে। পুরো জেলায় খাল দখল-দূষণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

সচেতন নাগরিকরা বলছেন, রহমতখালী খালের অস্তিত্ব রক্ষা শুধু পরিবেশ নয়, এই অঞ্চলের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তার প্রশ্ন। দ্রুত ও কার্যকর উদ্যোগ না নিলে সামনে আরও ভয়াবহ দুর্যোগ দেখা দিতে পারে।

এসআরএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।