এশিয়া কাপ আর্চারির সিঙ্গাপুর পর্বে রিকার্ভ এককে স্বর্ণপদক জিতেছেন বিকেএসপির ছাত্র আব্দুর রহমান আলিফ। তার এই যাত্রা সহজ ছিল না।
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোরডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিকেএসপির এই অভিজ্ঞ কোচ তুলে ধরেছেন আলিফের সফলতর নেপথ্যের গল্প।
বাংলানিউজ: আপনার ছাত্র সাগর অলিম্পিকে কোয়ালিফাই করেছে, এবার আলিফ ভালো ফল করেছে। আলিফের এই সাফল্য আপনি কীভাবে দেখছেন?
নূরে আলম: আলিফকে নিয়ে আমি আগেও বলেছি, ওকে নিয়ে সবসময়ই আশাবাদী ছিলাম। ওর পরিবারও ভালো, ওর বাবা সরকারি কলেজের প্রভাষক। আলিফ সবার বড়, ওর ধ্যান-জ্ঞান সবই আর্চারি নিয়ে। আর্চারির বাইরে কিছু ভাবেই না। ২০২১ সালে, যখন সে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে, তখনই কক্সবাজারে সিনিয়র ন্যাশনাল দলে থাকা রোমান সানাদের হারায়। তখন একক, দলগত এবং মিশ্র দলগত, তিনটি ইভেন্টেই স্বর্ণপদক জেতে। আর্চারিতে এর বেশি কিছু জেতার সুযোগ থাকে না। সেই তিন গোল্ড জেতার পর থেকেই সে আলোচনায় আসে।
বাংলানিউজ: আর্চারিতে আলিফের পথচলা নিয়ে বিস্তারিত বলবেন?
নূরে আলম: খুব অল্প বয়সে, কিশোর বয়সেই জাতীয় দলে সুযোগ পায়। কিন্তু সিনিয়র দলে আসার পর ও একটু ডাউন হতে থাকে, পারফরম্যান্সে ঘাটতি দেখা যায়। ২০২৩ সালে আমরা আবার ওকে বিকেএসপিতে ফিরিয়ে আনি। এর আগে যাতায়াত ছিল, তবে ২০২৩ সালে ওকে পুরোপুরি আমাদের ক্যাম্পে নিয়ে আসি। ওর অলিম্পিক স্কলারশিপ থাকায় জাতীয় ক্যাম্প থেকে বিকেএসপিতে আনতে কিছুটা কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।
কোরিয়ান কোচ, আমি এবং আমাদের পুরো টিম মিলে ওর সমস্যা শনাক্ত করে সমাধানের চেষ্টা করি। আলিফ আমার ওপর অনেক ভরসা করে, আমিও ওর ওপর আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। ২০২৪ সালে বিকেএসপির খরচে তাকে কোরিয়ায় খেলতে পাঠানো হয়। সেখানেই দলগত রৌপ্য জিতে সে আবার ছন্দে ফেরে। এরপর জাতীয় দলের ক্যাম্পে গিয়ে কিছুটা ডাউন হয় আবার।
রোজার ঈদের ছুটির পর আমরা ওকে আবার বিকেএসপিতে নিয়ে আসি। সেখানেই তার বিশেষ অনুশীলন করাই। ৩১ মে জুনিয়র ন্যাশনাল শেষে কোরবানি ঈদের ছুটিতে তাকে আবার জাতীয় ক্যাম্পে পাঠাই। জুনিয়র ন্যাশনালেও সে সবগুলো ইভেন্টে স্বর্ণ জেতে। তখনই বলেছিলাম, এই ধারাবাহিকতা থাকলে সে এশিয়া কাপেও স্বর্ণ পাবে। আমি নিজে এই বিশ্বাস নিয়ে ফেসবুকেও লিখেছিলাম।
বাংলানিউজ: আলিফের পারফরম্যান্সে ওঠানামা থাকলেও আপনি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন?
নূরে আলম: ২০২৩ অলিম্পিকে রিকার্ভে টপ স্কোর ছিল ৬৮৮। অথচ আলিফ অনুশীলনে ৬৯৬ স্কোর করে! এটা নিয়ে আমি ফেসবুকে লিখেছিলাম। এই ধারাবাহিকতা থাকলে অলিম্পিকেও পদক অসম্ভব নয়। আমরা ওর কাছ থেকে সবসময়ই বড় কিছু আশা করছিলাম।
বাংলানিউজ: দলগত ইভেন্টে শুরুটা ভালো হলেও শেষ পর্যন্ত পদকের লড়াইয়ে যাওয়া হয়নি, বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
নূরে আলম: দল নিয়েও আমরা আশাবাদী ছিলাম। দেশে আমাদের রিকার্ভ দল ৬০ এর নিচে ৫৭-৫৮ স্কোর করে না। কিন্তু সিঙ্গাপুরে গিয়ে ওরা ৫১-৫২ স্কোর করে হেরে গেল! বুঝতে পারিনি হঠাৎ কী হয়ে গেল। একমাত্র আলিফই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পেরেছে এবং স্বর্ণ জিতেছে। কম্পাউন্ড নারী দল এবং হিমু বাছারও শুরুতে ভালো খেলেছে। ওরাও আমারই ছাত্র। শুরুতে ওরা যা খেলেছে তা ওয়ার্ল্ড ক্লাস। ২৪০-এর মধ্যে ২৩০ স্কোর করেছে। কিন্তু টেম্পারমেন্ট ধরে রাখতে পারেনি। শেষ ম্যাচে ২২৪ স্কোর করে সেমিফাইনাল হাতছাড়া করে।
বাংলানিউজ: এই আসরে আলিফের পারফরম্যান্স নিয়ে আপনি সন্তুষ্ট? ভবিষ্যতে বড় কিছু কল্পনা করতে পারি কি?
নূরে আলম: অবশ্যই পারি। এবার আলিফ পাঁচটি ম্যাচ জিতে স্বর্ণ জিতেছে, কিন্তু এই পদক আগে যেসব পদক এসেছে তার চেয়ে আলাদা। এবার তিন রাউন্ডে পরপর ৩০ স্কোর করেছে, যা খুবই বিরল। অলিম্পিক বা ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপেও এটা দেখা যায় না। রিকার্ভে এমন স্কোর খুবই কম হয়। বিদেশের মাঠে বৈরি আবহাওয়ায় এমন স্কোর। এটা বিশাল উন্নতি। এমনকি স্বর্ণজয়ের ম্যাচেও যখন দুই রাউন্ডে হেরে যায়, তখন শেষ রাউন্ডে ২৯ মেরে ম্যাচ জিতে নেয়। এটাই আলিফের বড় অর্জন। এখানেই বোঝা যায় ও মানসিকভাবে অনেক পরিপক্ব হয়েছে।
বাংলানিউজ: ভবিষ্যতে সাফল্য ধরে রাখতে কী প্রয়োজন?
নূরে আলম: আমাদের গেম টেম্পারমেন্ট উন্নত হচ্ছে, স্কোরও বাড়ছে। এখন দরকার আরও বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ, সঠিক পরিচর্যা এবং ধারাবাহিক অনুশীলন। যারা অলিম্পিকে পদক পায়, তারা একটি গেমও মিস করে না। আমাদেরও তাই করতে হবে। জেলার পর্যায়ে ভালো কোচ দরকার, এবং জেলা ক্রীড়া সংস্থাগুলোর সহযোগিতা লাগবে।
বাংলানিউজ: আপনি তো আর্চারি ফেডারেশনের ট্রেনিং কমিটিতেও আছেন, পরিকল্পনার কথা বলবেন?
নূরে আলম: আমি বিকেএসপির প্রতিনিধি হিসেবে ট্রেনিং কমিটিতে কাজ করছি। সবার সহযোগিতা পেলে আমরা অনেক দূর যেতে পারি। তবে ট্রেনিং চালাতে টাকা দরকার। স্পন্সর বেশি পেলে আরও ভালোভাবে কাজ করা সম্ভব। আমাদের লক্ষ্য, দেশের ছয় বিভাগের ছয় জেলায় স্থায়ীভাবে আর্চারির অনুশীলন মাঠ গড়ে তোলা এবং সরঞ্জাম দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া।
বিকেএসপি তো আছে, কিন্তু যারা সেখানে সুযোগ পায় না, তাদের জন্যও সুযোগ তৈরি করতে হবে। ট্যালেন্ট হান্ট করার পরিকল্পনাও রয়েছে। তীর দীর্ঘদিন ধরেই পাশে আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে বলে আশা করি। তবে আরও স্পন্সর আসলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ সুগম হবে।
এআর/আরইউ