ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৭ কার্তিক ১৪৩২, ২৩ অক্টোবর ২০২৫, ০১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

সারাদেশ

মামলা বাড়লেও কমছে না মাদক!

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:১৬, অক্টোবর ২২, ২০২৫
মামলা বাড়লেও কমছে না মাদক!

দফায় দফায় অভিযান ও অসংখ্য মামলার পরও লালমনিরহাটের সীমান্ত ঘেঁষা গ্রামগুলোয় থামছে না মাদকের বিস্তার। প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপের পরও মাদক ব্যবসায়ীরা রীতিমতো বেপরোয়া।

মাত্র একটি ইউনিয়নেই শতাধিক বড় মাদক ব্যবসায়ী সক্রিয়, যাদের মধ্যে অনেক জনপ্রতিনিধি আছেন। একেকজনের বিরুদ্ধে রয়েছে ১৪ থেকে ১৫টি পর্যন্ত মামলা।

জানা গেছে, ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা জেলা লালমনিরহাটের পাঁচটি উপজেলাই সীমান্তবর্তী। এসব গ্রামের চোরাচালান ও মাদকের পরিস্থিতি এখন ভয়াবহ পর্যায়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা কালীগঞ্জ উপজেলার গোড়ল ও চন্দ্রপুর ইউনিয়নে। কালীগঞ্জ থানা থেকে অনেকটা দূরে হওয়ায় ২০২১ সালে গোড়ল ইউনিয়নে একটি তদন্ত কেন্দ্র স্থাপন করা হয়।

স্থানীয় সূত্র জানায়, বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সীমান্ত এলাকার কিছু নেতাকর্মীর আশ্রয়ে গড়ে ওঠে শক্তিশালী মাদক নেটওয়ার্ক। তখন থেকেই গোড়ল ও আশপাশের এলাকা মাদক পাচারের নিরাপদ রুটে পরিণত হয়। এসব মাদকের মধ্যে রয়েছে ফেনসিডিল, ট্যাপেন্টাডল, গাঁজা, ইয়াবা, ভারতীয় মদ ও স্কাফ সিরাপ।

গোড়লে তদন্ত কেন্দ্র স্থাপনের পর প্রথমদিকে রাজনৈতিক তদবিরে পুলিশ তেমন সফল হতে পারেনি। তবে আওয়ামী লীগের পতনের পর পুলিশ যখন কঠোর অবস্থান নেয়, তখন অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়ে মাদক ব্যবসায়ীরা। তদন্ত কেন্দ্রটি গত এক বছরে যে সাফল্য পেয়েছে, তা আগের দুই বছরের সম্মিলিত সাফল্যের চেয়েও বেশি।

তবু মাদকচক্র থেমে নেই। নিজেদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে তারা পুলিশের বিরুদ্ধে নানা প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে অভিযানে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। স্বল্প জনবল নিয়েও পুলিশ প্রতিনিয়ত অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ মাদক জব্দ ও ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করছে। কিন্তু জামিনে বেরিয়ে আবারও পুরোনো ব্যবসায় ফিরে যাচ্ছে অনেকে। স্থানীয় এক আইনজীবী এসব আসামিদের পক্ষেই নিয়মিত লড়ছেন আদালতে। ফলে প্রশাসনের কঠোর অবস্থান সত্ত্বেও মাদক পাচার পুরোপুরি দমন করা যাচ্ছে না।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গোড়ল ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নুরুল আমিন বাদশার নামে রয়েছে ১৪টি, তার স্ত্রী স্বপ্নার নামে দুটি এবং একমাত্র ছেলে শাহীনের নামে আরও দুটি মাদক মামলা। বাদশার ভাই এমদাদুল হকের নামে রয়েছে দুটি এবং আতিকুল ইসলামের নামে পাঁচটি মামলা। তারা একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছেন, মামলার চার্জশিটও আদালতে দাখিল করা হয়েছে। বাদশার আরেক ভাই এরশাদও মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকলেও হাতেনাতে ধরা না পড়ায় তার বিরুদ্ধে মামলা হয়নি।

২০২২ সালে ‘ইউপি সদস্য বাদশার বাড়িতে ফেনসিডিলের বার’ শিরোনামে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ভিডিওসহ সংবাদও প্রকাশিত হয়েছিল।

এছাড়াও গোড়ল ইউনিয়নের আলোচিত মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকায় রয়েছেন— মোফা মিয়া (২টি মামলা), দুলাল ওরফে ঘুগরি দুলাল (৭টি), রহিম বাদশা (৪টি), নান্নু মিয়া (৪টি) প্রমুখ। সাবেক ইউপি সদস্য রফিকুল ইসলাম, মতিন, হযরত বেলাল হোসেন বুড়া, মিন্টু হুজুর, লিমন, রুবেল, মালগড়ার মজিবরের ছেলে আব্দুর রাজ্জাক, মৃত জব্বারের ছেলে সাইদুল, দুলালের ছেলে শরিফুলসহ আরও অনেকে মাদকের বড় ডিলার হলেও অনেকের বিরুদ্ধেই মামলা হয়নি।

শুধুমাত্র গোড়ল ইউনিয়নেই শতাধিক সক্রিয় মাদক ব্যবসায়ী ও অসংখ্য খুচরা বিক্রেতা রয়েছে। মাদক বেচে অনেকে গরিব থেকে কোটিপতি হয়েছেন— তাদের রয়েছে আলিশান বাড়ি, দামি গাড়ি ও বিপুল জমিজমা। ফলে এসব গ্রাম এখন ‘মাদকের গ্রাম’ নামে পরিচিত।

এলাকার সামাজিক ও পারিবারিক জীবনেও পড়েছে বিরূপ প্রভাব। গ্রামের নাম শুনে অনেকের বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে, কেউ এসব গ্রামে আত্মীয়তা করতেও চায় না। হাতে-কলমে মাদক পাওয়া যাচ্ছে বলে তরুণ সমাজ ধীরে ধীরে আসক্ত হয়ে পড়ছে। সাধারণ মানুষ এখন মাদকের অভিশাপ থেকে মুক্তি চায়।

স্থানীয় কৃষক তমিজ উদ্দিন বলেন, মাদক ব্যবসায়ীরা সীমান্ত এলাকার জমিতে ফসল নষ্ট করে রাতের আঁধারে মাদক পাচার করে। শীত আসছে, এখন মাদকের পাশাপাশি গরু পাচারও বাড়বে। এতে শুধু যুব সমাজ নয়, কৃষিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

অরণ্য স্কুল অ্যান্ড কলেজের নির্বাহী পরিচালক আনজুরুল হক সরকার মিন্টু বলেন, গুটি কয়েক মাদক ব্যবসায়ীর কারণে এলাকার শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরাও সহজে মাদক পেয়ে আসক্ত হচ্ছে। এমনকি গ্রামগুলোর নামের সাথেও এখন মাদকের ট্যাগ লেগে গেছে।

গোড়ল চাকলার হাট কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমাম আবুল কাশেম বলেন, অল্প কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ীর কাছে পুরো গ্রাম জিম্মি। কেউ প্রতিবাদ করলেই হুমকি আসে।

গোড়ল ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নুরুল আমিন বাদশা নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেন, এখানে সবাই কোনো না কোনো সময় মাদক ব্যবসা করেছে। আমি একসময় করতাম, কিন্তু সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর ছেড়ে দিয়েছি। তবুও পুলিশ হয়রানি করতে এখনো আমার নামে মামলা দিচ্ছে।

মাদক ব্যবসায় জড়িত অভিযুক্তদের অনেকের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও সম্ভব হয়নি।

গোড়ল তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক এসআই মোস্তাকিন জানান, গত এক বছরে আমরা বিপুল পরিমাণ মাদকসহ ৭০ জনকে গ্রেপ্তার করেছি এবং ৬৮টি মামলা রুজু করা হয়েছে। অধিকাংশ মামলার অভিযোগপত্র ইতিমধ্যে আদালতে দাখিল হয়েছে। মাদকের সঙ্গে আপোষ না করায় মাদকচক্র আমাকে নানাভাবে হয়রানি করার চেষ্টা করছে।

কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাকির হোসেন বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রণে অভিযান অব্যাহত আছে। সীমান্ত গ্রাম থেকে ‘মাদকের ট্যাগ’ মুছে ফেলতে আমরা জোরদার অভিযান চালাচ্ছি। মাদক ব্যবসায়ীদের কোনো ষড়যন্ত্রই সফল হবে না।

এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।