ঢাকা, শুক্রবার, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৩ জুন ২০২৫, ১৬ জিলহজ ১৪৪৬

সারাদেশ

৫ শতাংশ জমি থেকে কোটিপতি, শেখ হাসিনার বাবুর্চির বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:৪৮, জুন ১২, ২০২৫
৫ শতাংশ জমি থেকে কোটিপতি, শেখ হাসিনার বাবুর্চির বিরুদ্ধে যত অভিযোগ শেখ হাসিনার বাসার বাবুর্চি মোশারফ শেখ

দিনমজুর বাবার ছেলে মো. মোশারফ শেখ (৪৭)। পড়ালেখা করেননি; নিজের নামটা পর্যন্ত লিখতে পারেন না।

বাবার সম্পত্তির ভাগ পেয়েছেন ৫ শতাংশ জমি। ৩০ বছর আগে বাবুর্চি হিসেবে কাজ করতেন একটি হোটেলে। হোটেলে চাকরির মাত্র দুই বছর পর তার ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়।  

১৯৯৬ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসার বাবুর্চির চাকরি পান। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। মোশারফ এখন কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক। গ্রাম থেকে শহরে সব জায়গায় রয়েছে তার বাড়ি-গাড়ি। শুধু তাই নয়; অভিযোগ আছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিজ গ্রামের বাড়ির প্রতিবেশী কৃষকের জমি দখলসহ সাধারণ মানুষকে নানাভাবে হয়রানি করেছেন বাবুর্চি মোশারফ।

ফরিদপুরের সালথা উপজেলার ভাওয়াল ইউনিয়নের বড় কামদিয়া গ্রামের কৃষক রহমান শেখের ছেলে মোশারফ শেখ। তিনি ২৭ বছর ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসার বাবুর্চি ছিলেন। তবে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর গা-ঢাকা দেন মোশারফ। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ দিয়েছেন বড় কামদিয়া গ্রামের কৃষক মো. চাঁনমিয়া ফকিরের ছেলে মো. সাগর মিয়া। এরপর থেকে বেরিয়ে আসছে মোশারফের নানা অপকর্ম, নিরীহ মানুষের ওপর অত্যাচার-জুলুম ও সম্পদের তথ্য।

লিখিত অভিযোগে বলা হয়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কৃষক চাঁনমিয়া ফকিরের বড় কামদিয়া ৮১ নম্বর মৌজার ৬১৮ নম্বর দাগের ৪৩ শতাংশ জমি জোরপূর্বক দখল করে বাড়ি নির্মাণ করেন মোশারফ শেখ। বিভিন্ন সময় ওই জমি ছেড়ে দিতে বললে হুমকি-ধামকি ও মারধর করে কৃষক চাঁনমিয়া ফকির ও তার পরিবারকে এলাকাছাড়া করেন মোশারফ। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ১ জুন চাঁনমিয়ার পরিবারের লোকজন জমি উদ্ধারের চেষ্টার পর মোশারফের লোকেরা ভয়ভীতি ও হুমকি দিয়ে যাচ্ছে।

সালথায় কৃষকের জমি দখল করে বাড়ি নির্মাণ করেছেন হাসিনার বাবুর্চি মোশারফ

ভুক্তভোগী কৃষক চাঁনমিয়া ফকিরের ভাতিজা সেন্টু ফকির বলেন, আমার চাচা একজন গরিব কৃষক। স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে চাঁনমিয়া ফকিরের ৪২ শতাংশ জমি দখল করে পাকা ঘর নির্মাণ করেন শেখ হাসিনার বাবুর্চি মোশারফ হোসেন এবং ওই ঘরের চালের ওপর একটি নৌকা তৈরি করে টানিয়ে রাখেন। তখন আমরা পুলিশ-প্রশাসনের কাছে গিয়েও কোনো সমাধান পাইনি। বরং জমি দখল নিয়ে মুখ খুললেই আমাদেরকে মারধর করে ও মামলা দিয়ে এলাকাছাড়া করে রাখতেন মোশারফ। শুধু আমাদের পরিবার নয়; শেখ হাসিনার বাবুর্চি হওয়ার প্রভাব খাটিয়ে পুরো বড় কামদিয়া গ্রামের সাধারণ মানুষের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালিয়েছেন তিনি।

মোশারফের প্রতিবেশী মো. জামাল শেখ বলেন, মোশারফের বাবা অন্যের জমিতে শ্রমিকের কাজ করে সংসার চালাতেন। অভাবের সংসার হওয়ায় মোশারফ পড়ালেখাও করতে পারেননি। ছোটবেলা থেকেই তিনি পাবনা শহরের একটি হোটেলের বাবুর্চির কাজ করতেন। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার বাসার বাবুর্চির চাকরি পাওয়ার পর থেকে যেন আলাউদ্দীনের চেরাগ পেয়ে যান মোশারফ। বর্তমানে কামদিয়া গ্রামে ২ বিঘা জমির ওপর করেছেন বাড়ি। মাঠেও ৩ বিঘা জমি রয়েছে তার।

তিনি আরো বলেন, ফরিদপুরের শহরের হাড়োকান্দী এলাকায় ১২ শতাংশ জমির ওপর একটি বাড়ি ও রাজবাড়ি রাস্তামোড় এলাকায় ৮ শতাংশ জমির ওপর একটি বাড়ি রয়েছে তার। এ ছাড়া ঢাকা ও ফরিদপুর শহরে একাধিক ফ্ল্যাট-প্লট ও গাড়ি রয়েছে বলে আমাদের কাছে মোশারফ নিজেই বলেছেন। বর্তমান সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা যদি অনুসন্ধান করে তাহলে মোশারফের অনেক অজানা তথ্য ও সম্পদের হিসেব বেরিয়ে আসবে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শেখ হাসিনার বাবুর্চি হওয়ার সুবাদে সম্পদ গড়ার পাশাপাশি মোশারফ তার নিজ গ্রামের ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে চেয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের ওপর হামলা-মামলা ও তাদেরকে জিম্মি করে জমি দখল ও সালিশ বাণিজ্য করার চেষ্টা করেছিলেন। তবে ওই গ্রামের যুবলীগ নেতা নুর ইসলাম প্রতিপক্ষ হওয়ায় তেমন সুবিধা করতে পারেনি তিনি। ২০১৫ সালে নুর ইসলামের সমর্থকরা তাকে ধাওয়া দিয়ে এলাকা ছাড়া করে দেয়। এরপর তিনি নুর ইসলামের সঙ্গে মিলে ফের এলাকা নিয়ন্ত্রণে নেন।

বড় কামদিয়া গ্রামের বাসিন্দারা জানান, আওয়ামী লীগের ক্ষমতাবলে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন মোশারফ। শুধু গ্রামবাসীর ওপর অত্যাচার করে ক্ষান্ত হননি তিনি, নিজের পরিবারও রেহাই পায়নি তার কাছ থেকে। চার বছর আগে দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে আটকে রেখে নিজের স্ত্রীকে জোর করে বাড়ি থেকে বের করে দেন মোশারফ। এখনও তার বাড়িতে স্ত্রী আসার আর সুযোগ পায়নি।

এসব অভিযোগের বিষয় বক্তব্য নেওয়ার জন্য শেখ হাসিনার বাবুর্চি মোশারফের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার মোবাইলফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। তার গ্রামের বাড়িতে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।

ফরিদপুর জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক হাসানউজ্জামান বলেন, ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার বাসার একজন বাবুর্চি কত টাকা বেতন পেয়েছেন? বেতন অনুযায়ী তার তো এত সম্পদের মালিক হওয়ার কথা না। নিশ্চয় তিনি দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন। এখন তার সম্পদের বিষয়টি যেহেতু সামনে এসেছে, বিষয়টি অবশ্যই সরকারের খতিয়ে দেখা উচিত।  

সালথা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আতাউর রহমান বলেন, জমি দখলের বিষয় নিয়ে মোশারফের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগ তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।