ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৩০ আশ্বিন ১৪৩২, ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ২৩ রবিউস সানি ১৪৪৭

মুক্তমত

অসহায় জনগণ কষ্টে আছে

অদিতি করিম। সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:৫৫, অক্টোবর ১৫, ২০২৫
অসহায় জনগণ কষ্টে আছে অদিতি করিম

অন্তর্বর্তী সরকারের ১৪ মাস পেরিয়ে গেছে। দেশের নীতিনির্ধারকরা এখন আগামী নির্বাচনের অপেক্ষায়।

অনেকে মনে করছেন, উপদেষ্টারা সেফ এক্সিটের পথ খুঁজছেন। কেউ কেউ এমন অভিযোগও করছেন যে তাদের আখের গোছানো নাকি শেষ। প্রতিদিন উপদেষ্টারা নিরাপদ প্রস্থান নিয়ে গণমাধ্যমে নানানরকম কথা বলছেন। পাল্টাপাল্টি অভিযোগের খেলা চলছে দেশে।

রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার হিসাবনিকাশ করতে ব্যস্ত। পিআর, গণভোট, জুলাই সনদ ইত্যাদি জটিল অঙ্কের হিসাবনিকাশ চলছে রাজনীতির ভিতর-বাইরে। এর মধ্যে সাধারণ মানুষ কোথায়? জনগণ কেমন আছে? তাদের খবর নেওয়ার সময় কি আছে কারও?

দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি কিংবা সমাজ সবখানেই আজ এক অদ্ভুত অস্থিরতা। যার প্রভাব সরাসরি এসে পড়েছে সাধারণ মানুষের জীবনে। আয় নেই, কাজ নেই, ব্যবসাবাণিজ্য স্থবির, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, আর তার সঙ্গে সর্বত্র নিরাপত্তাহীনতার আতঙ্ক-সব মিলে সাধারণ মানুষের জীবন যেন এক অবিরাম দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।

একজন দিনমজুর সকালে ঘুম থেকে উঠে কাজের আশায় বের হন, কিন্তু ফেরেন খালি হাতে। একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী দোকানের ঝাঁপ খুলেও বসে থাকেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কেনাকাটা নেই, ক্রেতা নেই। একজন শিল্পোদ্যোক্তা অসহায়। বিনিয়োগের ন্যূনতম পরিবেশ নেই। শিল্পপতি, ব্যবসায়ীরা নানান ধরনের হয়রানির শিকার।

অনেকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করে রাখা হয়েছে মাসের পর মাস। তদন্তের নামে চলছে কালক্ষেপণ আর চরিত্রহননের কুৎসিত খেলা। এসব দেখে কেউ নতুন বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নন। নতুন কর্মসংস্থান নেই। একজন স্নাতক যুবক প্রতিদিন চাকরির বিজ্ঞাপন খোঁজেন, কিন্তু মেলে না কোনো নিশ্চিত ভবিষ্যৎ। এ বাস্তবতা এখন একক কারও নয়, বরং লাখো মানুষের।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক তথ্যে দেখা যায়, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর বড় অংশই এখন কোনো না কোনোভাবে বেকার বা আংশিক কর্মরত। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যানও আশাব্যঞ্জক নয়। গ্রামীণ অর্থনীতি, ক্ষুদ্র শিল্প, এমনকি শহরের ছোট ব্যবসা-সবখানেই মন্দা। রেমিট্যান্স বৃদ্ধি অর্থনীতিতে একমাত্র স্বস্তি। কিন্তু প্রবাসে কর্মসংস্থান কমে যাওয়ায় রেমিট্যান্স কত দিন এ রকম থাকবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বাংলাদেশের জন্য ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী। বহু দেশে ভিসা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। তরুণ সমাজ হতাশ হয়ে পড়ছে। এ হতাশা অনেকের জীবন থেকে বিশ্বাস, উদ্যম ও স্বপ্ন কেড়ে নিচ্ছে। একসময় যে মানুষটি প্রতিদিনের আয় দিয়ে সংসার চালাতেন, আজ তিনি ধারদেনার জালে জড়িয়ে পড়েছেন। পরিবারের ভরণপোষণ, সন্তানের পড়াশোনা, বয়স্ক পিতা-মাতার চিকিৎসা-সবকিছুই যেন অসম্ভব হয়ে উঠেছে। বাজারের আগুনে পুড়ছে মানুষ। জীবনযাত্রার ব্যয় এখন নাগালের বাইরে। চাল, ডাল, তেল, নুন, সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসের দাম দিনদিন বাড়ছেই। সরকারি প্রতিবেদন বলছে, মূল্যস্ফীতি সামান্য বেড়েছে; কিন্তু বাস্তবে বাজারে গিয়ে যে কোনো মানুষ জানেন দামের সঙ্গে আয় মেলানো আজ অসম্ভব। মাসের শুরুতেই অনেকে ঋণ করে বাজার করেন, মাসের শেষ আসার আগেই হাত খালি। মধ্যবিত্ত শ্রেণি আজ নিম্নবিত্তে পরিণত হচ্ছে। আর নিম্নবিত্তের জীবন চলছে শোচনীয় অবস্থায়। দেশের বাজারে এখন পুঁজির অভাবের পাশাপাশি আস্থারও অভাব দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, প্রশাসনিক জটিলতা ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা পিছিয়ে যাচ্ছেন। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হচ্ছে একের পর এক। গ্রামাঞ্চলের হাটবাজারেও একই অবস্থা। কেনাবেচা নেই, টাকার প্রবাহ নেই। একসময় যে দোকানদার প্রতিদিন পণ্য বিক্রি করে হাসিমুখে ফিরতেন, এখন তিনি সারা দিন বসে থেকেও বিক্রি না হওয়া পণ্যগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকেন।
অর্থনীতির এ স্থবিরতা শুধু সংখ্যার গল্প নয়; এটি হাজারো পরিবারের বেঁচে থাকার প্রশ্ন।

অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সঙ্গে যোগ হয়েছে সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মবসন্ত্রাস-সবকিছুই বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতেও সাধারণ মানুষ নিরাপদ বোধ করছে না। রাতে বাইরে বের হওয়া দূরের কথা, দিনের আলোতেও মানুষ আজ ভয়ে ভয়ে চলাফেরা করছে। অপরাধের শিকার হচ্ছে পথচারী, দোকানি, এমনকি শিক্ষার্থী পর্যন্ত। ১৪ মাসের বেশি সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলছে নানান ধরনের অস্থিরতা। কখনো শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, কখনো শিক্ষকদের দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন, কখনো শিক্ষার্থীদের নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। মবসন্ত্রাসের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো সমাজে নতুন আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। যে সমাজে মানুষ নিজের বিচার নিজেই নিতে চায়, সেখানে আইনের প্রতি আস্থা হারিয়ে যায়। আর আইন ও ন্যায়বিচারের প্রতি এ অবিশ্বাসই সমাজে অরাজকতার বীজ বপন করে।

আমাদের সমাজে দারিদ্র্য এখন আর কেবল খাদ্যের অভাব নয়; এটি আত্মসম্মানের ক্ষয়, নিরাপত্তার অভাব এবং ভবিষ্যতের প্রতি গভীর অনিশ্চয়তা।
দুর্নীতি কমেনি, বরং প্রতিদিন নিত্যনতুন দুর্নীতির খবর আকাশে বাতাসে ভাসছে। মূলধারার গণমাধ্যম অজানা আতঙ্কে সেলফ সেন্সরশিপের চাদরে নিজেদের ঢেকে রেখেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনটা গুজব আর কোনটা সত্যি তা কে বলবে? দেশের মানুষ এখন আশাহত, হতাশ। অনেকে নিজেদের প্রতারিত মনে করছেন। শুধু দেশের জনগণ নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপুলভাবে সমর্থন জানায়। বিশ্বনেতারা অভিনন্দনে সিক্ত করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। এত অভিনন্দন অতীতে কোনো সরকারপ্রধান পেয়েছেন কি না আমার জানা নেই। কিন্তু আন্তর্জাতিক মহলেও এখন বাংলাদেশ নিয়ে হতাশার সুর। সর্বশেষ হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন তার প্রমাণ। পশ্চিমা অনেক দেশ বলতে শুরু করেছে, বাংলাদেশ আরেকটি সুযোগ নষ্ট করেছে। যখন রাষ্ট্র নীতি নির্ধারণে ব্যস্ত, রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার সমীকরণে মত্ত তখন সাধারণ মানুষ দিশাহারা। এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে হেঁটে যাচ্ছে বাংলাদেশ। রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব নাগরিকের নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান ও ন্যায্য জীবনযাত্রা নিশ্চিত করা। কিন্তু আজ এ তিন ক্ষেত্রেই ব্যর্থতার চিত্র প্রকট। নীতি ও বাস্তবতার ফারাক যত বাড়ছে, ততই সাধারণ মানুষের আস্থা কমছে।

রাষ্ট্র যদি মানুষের পাশে না দাঁড়ায়, তাহলে সমাজের স্থিতি নষ্ট হয়ে যায়। মানুষের ক্ষোভ, হতাশা ও অনিশ্চয়তা যখন চরমে পৌঁছায়, তখন তা সামাজিক অস্থিরতায় রূপ নেয়। এ পরিস্থিতি উত্তরণের একমাত্র উপায় জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ধারণ করা। জনগণের কণ্ঠস্বর শোনা। আর জনগণের অনুভূতি উপলব্ধির প্রধানতম উপায় হলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। এ নির্বাচন উপলক্ষে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা সরাসরি জনগণের সঙ্গে কথা বলেন, তাদের চাওয়াপাওয়া, আশানিরাশার কথা জানতে পারেন। বিজয়ী দল ক্ষমতায় গিয়ে জনগণের প্রত্যাশাপূরণে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কাজ করতে পারে।

এ কারণেই বাংলাদেশের সামনে নির্বাচনের বিকল্প নেই। রাজনৈতিক দলগুলো কোনোভাবেই যেন নির্বাচন বানচালের ফাঁদে পা না দেয়। তাদের বিতর্ক, মতবিরোধ নিয়ে যাক জনগণের কাছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া হোক জনগণের হাতে। জনগণই সিদ্ধান্ত নিক তারা কী চায়। নির্বাচন না হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে জনগণ।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।