ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৪ আশ্বিন ১৪৩২, ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ১৬ রবিউস সানি ১৪৪৭

মুক্তমত

জামায়াতের কৌশল কি বিএনপি সামলাতে পারছে?

অদিতি করিম। সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন |
আপডেট: ০৮:২৮, অক্টোবর ৯, ২০২৫
জামায়াতের কৌশল কি বিএনপি সামলাতে পারছে? অদিতি করিম

রাজনীতিতে চিরস্থায়ী শত্রুমিত্র নেই- এ চিরায়ত উক্তির বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে। এ দেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিনের দুই মিত্র এখন একে অপরের প্রধান প্রতিপক্ষ।

বিএনপি এবং জামায়াত এখন আর বন্ধু নয়, শত্রু। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তারা এখন মুখোমুখি। বিএনপি-জামায়াতের এ লড়াই যে শুধু জনপ্রিয়তার পরীক্ষা, তা নয়, এটি রাজনৈতিক কৌশলের খেলাও বটে। এ কৌশলের খেলায় কে জিতবে? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, বিএনপি কি জামায়াতের কৌশল বুঝতে পারছে?

জুলাই বিপ্লবের পর জামায়াত বাংলাদেশের রাজনীতিতে একের পর এক চমক দেখাচ্ছে। ২০১৩ সালে যে দলের অস্তিত্ব নিয়ে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল, সেই দলটি আজ বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বড় ফ্যাক্টর। জামায়াতকে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফিনিক্স পাখির সঙ্গে তুলনা করেন। ফিনিক্স পাখি যেমন ভস্মীভূত হওয়ার পর আবার নতুন করে জেগে ওঠে, জামায়াতও ঠিক তেমনি। ২০১০ সাল থেকে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হলে দলটি অস্তিত্বের সংকটে পড়ে। দলের শীর্ষ নেতারা গ্রেপ্তার হন। প্রথম সারির সব নেতাই যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে সর্বোচ্চ শাস্তি, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়। দলটি দলীয় প্রতীক হারায়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির দয়ায়, বিএনপির দলীয় প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে জামায়াতের ২০ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সেই জামায়াত বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন বিএনপির জন্য প্রধান মাথাব্যথা। মামলা, হামলা, নির্যাতন, নিপীড়নের পরও জামায়াতের উত্থান শুধু বাংলাদেশের নয়, সারা বিশ্বের রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি উদাহরণ। ২০১৩ সাল থেকেই বাংলাদেশে জামায়াতের কর্মকাণ্ড কার্যত নিষিদ্ধ ছিল। দলটিকে কোনো সভা-সমাবেশ করতে দেওয়া হয়নি। গোপন কিংবা নিষিদ্ধ সংগঠনের মতো কৌশলে তারা সংগঠন গুছিয়েছে। বিভিন্ন দলে তাদের কর্মীদের ঢুকিয়ে তারা তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে আন্দোলন সংগঠিত করে। বিশেষ করে, এ সময়ে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ করে। ছাত্রলীগের মধ্যেই সংগঠিত হয় ছাত্রশিবির। ২০২৪ সালের আন্দোলনে এরাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জুলাই বিপ্লবে জামায়াতের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বের সঙ্গে জামায়াত কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তোলে। ৫ আগস্টের গণ অভ্যুত্থানের পর জামায়াত এবং তাদের সহযোগী সংগঠনগুলো খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে। এ সময় দেখা যায়, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিচার বিভাগ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাষ্ট্রের সব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে তাদের শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে। নীরবে-নিভৃতে দীর্ঘদিন ধরে জামায়াত এভাবেই সর্বস্তরে নিজেদের নেটওয়ার্ক তৈরি করে। এখানেই বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জামায়াতের মৌলিক পার্থক্য। জামায়াতের এই কৌশল প্রথমে বুঝতেই পারেনি বিএনপি। ৫ আগস্টের পর বিএনপি ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। তাদের কেউ কেউ আওয়ামী লীগের ফেলে যাওয়া সম্পদ দখলে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কেউ বা এলাকার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হয়। আর এর ফলে পরিকল্পিতভাবে বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হয়। জামায়াত ২০১৩ সাল থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় হওয়ার কৌশল গ্রহণ করে। ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্ল্যাটফর্মগুলোতে পরিকল্পিতভাবে প্রচারণা চালানো শুরু করে দলটি। প্রশিক্ষিত, সার্বক্ষণিক কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয় শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পরিচালনা করার জন্য। এই কৌশলে অন্য সব রাজনৈতিক দলকে পেছনে ফেলে জামায়াত।

৫ আগস্টের পর এসব কৌশলের সমন্বিত প্রয়োগ করে দলটি। একদিকে তাদের নিবেদিত কর্মী বাহিনী, সোশ্যাল মিডিয়ায় একক আধিপত্য, অন্যদিকে প্রশাসনে তাদের আদর্শিক লোকজনের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হওয়ার ফলে রাজনীতির মাঠে জামায়াত নতুন রূপে আবির্ভূত হয়। বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে রীতিমতো চমকে দেয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপি শুরুতে জামায়াতকে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর মনে করেনি। বিএনপি মনে করেছে, তাদের দীর্ঘদিনের বন্ধু বোধহয় আগের মতোই আছে। কিন্তু জামায়াত যে বিএনপির ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে সেটা তারা বুঝতে পারে ডাকসু নির্বাচনের সময়। প্রশাসন, সোশ্যাল মিডিয়া, সুশৃঙ্খল সংগঠন এবং সঠিক নির্বাচনি কৌশল যে জনপ্রিয় দলকেও ধরাশায়ী করতে পারে, ডাকসু এবং জাকসু নির্বাচন তার প্রমাণ। এ নির্বাচন নিয়ে অনেক কথা বলা যেতেই পারে, ডাকসু নির্বাচনের ব্যালট পেপার কেলেঙ্কারি কিংবা জাকসুতে ভোট গণনার ধীরগতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, নির্বাচনে ছাত্রশিবির বিজয়ী হয়েছে।

এই দুই নির্বাচনের পর বিএনপির টনক নড়ে, তারা চোখ খুলে চারপাশে তাকিয়ে দেখে সর্বত্র জামায়াত। বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী তাই, আর্তনাদের মতো করে বলেন, প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জামায়াত, এই প্রশাসন নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারে না। কিন্তু তার কথা বাতাসে হারিয়ে যায়। এখানেও জামায়াতের কৌশলের কাছে পরাজিত হয়েছে বিএনপি।

বিএনপি নেতারা এখন জামায়াতকে উগ্র মৌলবাদী এবং সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হিসেবে চিহ্নিত করছেন। কিন্তু তাতেও অনেক দেরি হয়ে গেছে। জামায়াত এবার শারদীয় দুর্গাপূজায় নতুনভাবে আবির্ভূত হয়েছে। দলটির নেতারা অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা বলছেন। জামায়াত নেতারা পুজোমণ্ডপে ছুটে বেরিয়েছেন। বিএনপি নেতারাও পুজোমণ্ডপে গেছেন। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়ন্ত্রণ থাকার কারণে জামায়াত প্রচার পেয়েছে অনেক বেশি।

জামায়াত এখন নিজেদের ইসলাম পছন্দ রাজনৈতিক দলের খোলস থেকে বেরিয়ে আসছে। নিজেদের মডারেট উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে উপস্থাপন করছে। এই বার্তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরতে জামায়াত একের পর এক বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করছে। গত এক মাসে জামায়াতের নেতারা অন্তত এক ডজন কূটনীতিকের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। প্রভাবশালী পশ্চিমা দেশগুলো এখন জামায়াতের নতুন অবস্থান গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। গত তিন মাস জামায়াতের ভারতবিরোধী অবস্থানের পরিবর্তন লক্ষণীয়। সব মিলিয়ে জামায়াত তাদের রাজনীতির মৌলিক পরিবর্তন করছে, সবার অলক্ষে। নিঃসন্দেহে এটি তাদের রাজনৈতিক কৌশল। এ কৌশল কতটা বুঝতে পারছে বিএনপি? আগামী নির্বাচন হবে জামায়াতের কৌশলের সঙ্গে বিএনপির জনপ্রিয়তার লড়াই। এ কথা ঠিক সারা দেশে বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি অনেক শক্তিশালী। দলের নেতা-কর্মী ছাড়াও দলটির রয়েছে বিপুল সমর্থক। বিএনপি এই মুহূর্তে নিঃসন্দেহে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল। কিন্তু জনগণের সমর্থন ভোটের বাক্সে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে বিএনপি কি সফল হতে পারবে? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে একটা কথা বলা যায়, আগামী নির্বাচন বিএনপির জন্য সহজ পরীক্ষা হবে না। জেতার আগেই জিতে গেছি-এই মানসিকতা বিএনপির জন্য বিপন্ন বিস্ময় হতে পারে।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।