ঢাকা: শিক্ষা জীবনের দ্বিতীয় ধাপে যশোরের নওয়াপাড়া শংকরপাশা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম আমি। এ স্কুলে আমাদের ইংরেজি পড়াতেন নিতাই স্যার ও নিমাই স্যার।
স্বাভাবিকভাবে সংবাদ লিখতে হয় ইংরেজিতে। এছাড়া একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ইংরেজি পড়াই। কিন্তু আমি ইংরেজিতে অনার্স বা মাস্টার্স করিনি। করেছি বাংলায়।
জানি না নিজের যোগ্যতা কতটুকু। কিন্তু কিছু ইংরেজি তো জানতে হয়। তা না হলে এসব প্রতিষ্ঠানে থাকা সম্ভব না। এ সম্ভবটুকু করে দিয়েছেন যে দুই স্যারের নাম বললাম তারা। আর আমার বাবা মরহুম শেখ মুহাম্মদ আব্দুর রহমান। কারণ আমার কোনো প্রাইভেট শিক্ষক ছিল না।
৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস। ১৯৯৫ সাল থেকে এটি পালিত হয়ে আসছে। ইউনেস্কোর মতে, বিশ্ব শিক্ষক দিবস শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ পালন করা হয়। বিশ্বের ১০০টি দেশে এই দিবসটি পালিত হয়ে থাকে। এই দিবসটি পালনে এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল ও তার সহযোগী ৪০১টি সদস্য সংগঠন মূল ভূমিকা রাখে।
বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপনে জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেস্কো) ও এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল(ইআই) প্রতি বছর প্রচারণা চালায় যাতে বিশ্বকে শিক্ষকদের সম্পর্কে আরও ভালভাবে বোঝাতে যায় যে তারা শিক্ষার্থী ও সমাজকে বিকশিত করতে কতটা ভূমিকা পালন করেন।
শিক্ষক দিবসের আগ মুহূতে এ লেখা প্রস্তুতের সময় মনে পড়ছে আমার দু স্কুল জীবনের স্যারকে। যাদের কারণে আজ এতদূর এগুতে পেরেছি। নিতাই স্যার ইংরেজি গ্রামার পড়াতেন। টেন্সসহ ব্যাকরণের খুঁটিনাটি তিনি বুঝিয়ে দিতেন। আর নিমাই স্যার ইংরেজিতে কথা বলতেন। যেভাবে পড়ালে একটি বিদেশি ভাষা ছাত্ররা শিখবে সেভাবে পড়াতেন। তাই প্রাইভেট টিউটরের কাছে যাওয়া লাগেনি।
আজ আমার মেয়ে সাউদা বিনতে সাইফ সবে একাদশ শ্রেণিতে পড়া শুরু করেছে। এসএসসিতে সে জিপিএ ৫ পেয়েছে। পেয়েছে বৃত্তি। এ পর্যন্ত আসতে গিয়ে আমার মেয়ে ও ওর সহপাঠীদের যে কী করতে হয়েছে তা তাদের অভিভাবকরা জানেন। বিশেষ করে নারী অভিভাবকরা। সন্তানদের এ পর্যন্ত আনতো গিয়ে তাদের পায়ের তলায় মাটি থাকেনা।
আমি ও সন্তান এ দুয়ের ভেতরের এই এত বড় পার্থক্য কি এমনি এমনি হয়েছে? না। এটা তৈরি করেছে শিক্ষা কারিকুলাম। কথিত সৃজনশীলতার নামে শিক্ষাকে ব্যবসায়িক পণ্য বানিয়েছে পতিত স্বৈরাচার। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে গৌন করে শিক্ষাকে করা হয়েছে কোচিং ও প্রাইভেট টিউটর নির্ভর। কারণ কথিত সৃজনশীলতার ভেতর নেই কোন সৃজনশীলতা। গাইড থেকে গাদা গাদা পড়া মুখস্থ করে তারপর যেতে হয় পরীক্ষার হলে। এ পড়া বুঝতে যেতে হয় কোচিং সেন্টার বা প্রাইভেট টিউটরের কাছে। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা এ সুযোগ কাজে লাগান। তারা ঝুঁকে পড়েন কোচিং বা প্রাইভেট টিউশনির দিকে। কিন্তু তারপরও শেষ রক্ষা হয় না। ভর্তি পরীক্ষায় গিয়ে শুধুমাত্র ইংরেজির কারণে ৯২ ভাগ শিক্ষার্থী ফেল করে।
এই ফেল করা নিয়ে আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহদের মালিকানার নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউন একটি প্রতিবেদন তৈরি করে ২০১৬ সালের ৮ অক্টোবর। প্রতিবেদনে আওআমী লীগের সুবিধাভোগী দু শিক্ষাবিদ এ সম্পর্কে তাদের মন্তব্য দেন।
পরীক্ষায় এত ফেলের কারণ কি জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই সময়কার উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, আমরা পরিসংখ্যান করে দেখেছি ইংরেজিতেই ফেল বেশি হচ্ছে। স্কুল-কলেজ পর্যায়ে ইংরেজি আরও ভালোভাবে পড়াতে হবে। কারিকুলাম যাচাই-বাছাই করে দেখা উচিত ইংরেজিতে আরও ভালো কারিকুলাম প্রয়োজন কিনা। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের ইংরেজির ওপর ভীতি কাজ করে, তারা ইংরেজি পড়তে চায় না।
অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের মন্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে আমাদের কারিকুলামে সমস্যা আছে। আর কেন ইংরেজিতে ভীতি তাও উঠে এসেছে। কারণটি হলো তারা পড়তে চায় না। এ না- কে হ্যাঁ - তে রূপান্তরিত করতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। আর সে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে মুখস্থ বিদ্যা। যার পেছনে ভূমিকা রয়েছে কারিকুলামের।
এবার জানা যাক আরেকজনে মন্তব্য।
শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব অধ্যাপক নজরুল ইসলাম খানও মনে করেন ইংরেজিতে শিক্ষার্থীরা অনেক দুর্বল। শিক্ষার মানেরও অনেক ঘাটতি রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
আমরা জানি, সৃজনশীলতা মানে নিজে থেকে কিছু সৃষ্টি করা। কিন্তু ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সৃজনশীলতা ছিল মুখস্থ বিদ্যা নির্ভর- এত এত গাইড, কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট টিউটর নির্ভর। এজন্যে আমাদের শিক্ষার বারোটা বেজেছে। যা স্বীকার করেছেন আওয়ামী লীগেরই দু সুবিধাভোগী।
ফি বছর শিক্ষক দিবস আসে। পালিত হয় গতানুগতিক ধারায়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়না। কারণ পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সময়ে যতগুলো দিবস ছিল ও বানানো হয়েছিল তা পালন করা হতো শুধু ফ্যাসিস্ট সরকারকে তোয়াজ করতে। এ থেকে আমরা কিছু শিখতাম না। শেখার সুযোগ ছিল না। শুধু একজন মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে ছিল যত আয়োজন। ওই ব্যক্তির খুঁটিনাটি নিয়ে যত চর্চা হতো অন্য কোনা কিছু নিয়ে তা হতো না। ওই ব্যক্তি কখন কী বলেছেন, কীভাবে চলেছেন, কী পরেছেন, তাকে কীভাবে অনুকরণ করা যায় -তা নিয়েই ছিল যত আয়োজন। এছাড়া স্বৈরাচারের তোয়াজে মেনে থাকতো সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানমালা। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা স্বৈরাচার শেখ হাসিনার স্তুতি গাইতে গাইতে সময় পার করতেন। দেশের মানুষকে অন্যকিছু ভাববার সময় দেওয়া হতো না। সাংবাদিক যাদের বলা হয় সমাজের দর্পন- তাদের একটি বড় অংশও পৃথিবীর নিকৃষ্টতম স্বৈরশাসকের স্তুতি গাইতে গাইতে মুখে ফেনা তুলে দিতেন। পতিত প্রধানমন্ত্রী কী শাড়ি পরেছেন, এতে তাকে কেমন দেখাচ্ছে- এরকম নানা অবান্তর বিষয়ের ভেতর সীমাবদ্ধ থাকতো তাদের আলোচনা। তারা আরো একটি কাজ করতেন। তা হলো স্বৈরাচারের ভয়ে পালিয়ে বেড়ানো বিরোধীদলের নেতা-কর্মীদের নিয়ে বানোয়াট তথ্য আবিষ্কার। আর তাদের দমনে আরো কতটা কঠোর হওয়া যায় সে ব্যাপারে স্বৈরশাসককে উসকে দিতে থাকেন তারা। ফলে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা নিজের নেতিবাচক কাজগুলোকে ভালো মনে করে বিরোধী দল ও মতের প্রতি আরো কঠোর আচরণ করেন। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ জঙ্গি নাটক সাজিয়ে বিরোধী মতের মানুষকে হত্যা করা, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় নিরীহ -নিরপরাধ ছাত্রদের ওপর মারনাস্ত্র চালানোর হুকুম। এবং তার ফলশ্রুতিতে হেলিকপ্টার দিয়ে মানুষ হত্যা। স্নাইপারের ব্যবহার। আহতদের চিকিৎসার সুযোগ না দেওয়া, পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করা।
এরকম এক পরিস্থিতিতে দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয় দেশ। সরকারি এমন কোন বিভাগ নেই যেখানে দুর্নীতি ছিলনা। কারণ স্বৈরাচারের তোয়াজ ও একজন মৃত ব্যক্তির নামে জিকির তুলতে পারলে সবকিছু মাফ।
২০২৪ - এর ৫ আগস্ট স্বৈরাচার পালিয়েছে। পালিয়েছে তার সভাসদ। পালিয়েছে মসজিদের ইমাম পর্যন্ত। অথচ কেউ তাদের পালাতে বলেনি। নিজেদের অন্যায়ের মাত্রা তারা নিজেরাই বুঝেছিল। তাই পালিয়েছে সবাই। যা বিশ্বে নজিরবিহীন।
এ নজিরবিহীন ঘটনার পর আমাদের সামনে সময় এসেছে। সময় এসেছে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করার। আর তা করতে পারলেই স্বার্থক হবে বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালন।
সাইফুর রহান সাইফ, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, সাংবাদিক ইউনিয়ন যশোর।
এসআই