ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২২ মে ২০২৫, ২৪ জিলকদ ১৪৪৬

মুক্তমত

প্রসঙ্গ: মানবিক করিডর, চট্টগ্রাম বন্দর ও সেন্টমার্টিন

আরেকটি এক-এগারোর ফাঁদে দেশ?

অদিতি করিম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮:৩৫, মে ২২, ২০২৫
আরেকটি এক-এগারোর ফাঁদে দেশ?

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মঙ্গলবার (২০ মে) রাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সেনাপ্রধানসহ তিন বাহিনীর প্রধান উপস্থিত ছিলেন।

সরকারের ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তাও বৈঠকে অংশ নেন। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের আনুষ্ঠানিক বিবৃতি ছাড়া এ বৈঠকের বিস্তারিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে এ ধরনের উচ্চপর্যায়ের বৈঠক যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা সহজে অনুধাবন করা যায়। কোন পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে এ পর্যায়ের বৈঠক হয় তা সবাই কমবেশি অবগত আছেন। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো না। পরিস্থিতি অনুধাবনের জন্য এটুকু বাক্য যথেষ্ট নয়।  

আইনশৃঙ্খলার অবস্থা উদ্বেগজনক, আতঙ্কের এবং উৎকণ্ঠার। দেশ এখন একটা অরাজকতার দ্বারপ্রান্তে। কোথাও কোনো কিছুর নিয়ন্ত্রণ নেই। রাজপথে নানান দাবিদাওয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন, অন্যদিকে বিভিন্ন পেশাজীবীর অবস্থান, অবরোধের কারণে দেশ এখন অচল। চলছে সন্ত্রাস, সহিংসতা, নিয়ন্ত্রণহীন। মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ নেই। মব সন্ত্রাসীদের থানা থেকে ছাড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে আইনবহির্ভূতভাবে।  

একজন গ্রেপ্তার আসামিকে ছাড়ার ন্যূনতম আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে না। বিভিন্ন মামলার নামে হয়রানি এখন একটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। হত্যা মামলাগুলো এখন রীতিমতো তামাশায় পরিণত হয়েছে। দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী, শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র এখন প্রকাশ্য এবং দৃশ্যমান। একদিকে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের হয়রানি করা হচ্ছে, অন্যদিকে মিডিয়া ট্রায়ালে হচ্ছে দেশের অর্থনীতির সর্বনাশ।  

সবকিছু মিলিয়ে দেশটার ওপর রীতিমতো ‘তা ব’ চলছে, পরিকল্পিত তা বে ‘বরবাদ’ হচ্ছে দেশ। এ রকম একটি পরিস্থিতি হঠাৎ করেই হচ্ছে, নাকি উদ্দেশ্যমূলকভাবে তৈরি করা হচ্ছে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে হলে আমাদের একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে। আমরা যদি ২০০৬ সালের বাংলাদেশের চিত্র দেখি, তাহলে সেই চিত্রের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের চিত্রটি অনেকটাই মিলে যায়। ২০০৬ সালের শেষ দিকে রাজনৈতিক দলগুলোকে মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছিল।

রক্তক্ষয়ী সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েছিল তারা ক্ষমতার জন্য। দেশজুড়ে রাজপথ, রেলপথ অবরোধ, নানা রকম কর্মসূচির মাধ্যমে ব্যবসাবাণিজ্য অচল করে দেওয়া হয়েছিল। ওই সময় সুশীলরা দুই পক্ষের বিরোধ উসকে দেওয়ার জন্য আদাজল খেয়ে নেমেছিলেন। টেলিভিশনে, সংবাদপত্রে তাঁদের বিভেদজাগানিয়া লেখা জাতিকে বিভ্রান্ত করেছিল। রাজনৈতিক দলগুলোকে সমঝোতার বদলে সংঘাতের পথে প্ররোচিত করেছিল একটি মহল। উদ্দেশ্য ছিল দেশে জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি।  

আর এ সুযোগেই ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে এক-এগারো সরকার ক্ষমতা দখল করে। এক-এগারো সরকার ক্ষমতা দখল করেই বাংলাদেশকে ধ্বংসের এবং বিরাজনীতিকরণের যে কার্যক্রম শুরু করে, তা থেকেই বোঝা যায় যে ২০০৬ সালের শেষ দিক থেকে যে ঘটনাগুলো বাংলাদেশে ঘটেছিল, সবই ছিল পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। একটি নীলনকশার সুনিপুণ বাস্তবায়ন। এবারও কি সে রকম ঘটনাই হচ্ছে? প্রায় একই অবস্থায় এখন দেশ। অশান্তির আগুনে জ্বলছে বাংলাদেশ।  

২০০৭ সালের যারা কুশীলব ছিলেন, যারা বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং দেশ ধ্বংসের মিশনে নেমে ক্ষমতা দখল করেছিলেন, তারাই এখন ক্ষমতা কেন্দ্রে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারকে তারাই যেন বিপথে পরিচালিত করছেন। সরকারের একটি প্রভাবশালী অংশ কি আরেকটি এক-এগারোর পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছে? দেশ কি আরেকটি এক-এগারোর ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে? ২০০৭ সালে ড. ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বে এক-এগারো সরকারের তিনটি এজেন্ডা ছিল। প্রথম লক্ষ্য ছিল রাজনীতির মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি এবং বিভাজন সৃষ্টির মাধ্যমে সন্ত্রাস, সহিংসতা উসকে দেওয়া। যেন রাজনীতি সম্পর্কে মানুষের অনীহা তৈরি হয়।  

সুশীল সমাজের ক্ষমতা দখলের পথ তৈরি হয়। ২০০৭ সালেও রাজনৈতিক ইস্যু আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল জল ঘোলা করার জন্য। এবারও তা-ই করা হচ্ছে? এসব করে জনগণকে রাজনীতি সম্পর্কে ত্যক্তবিরক্ত করে অনির্বাচিত সরকারের দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকাই ছিল এক-এগারোর প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য। এক-এগারো সরকারের দ্বিতীয় এজেন্ডা ছিল অর্থনীতি ধ্বংস করা। দেশ পরনির্ভর, বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরশীল করা। যেন দাতাদের ক্রীতদাস হয়ে চলতে আমরা বাধ্য হই। বাংলাদেশে যেসব দেশপ্রেমিক ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তা কোটি মানুষের কর্মসংস্থান করেন, তাদের হয়রানি করা, নানা রকম মিথ্যা মামলা, মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে তাদের ইমেজ নষ্ট করাই ছিল এক-এগারো কুশীলবদের মিশন। অর্থনীতি যেন স্থবির এবং ধ্বংস হয়ে যায়।  

তৃতীয়ত. দীর্ঘমেয়াদি বিদেশিদের অনুগত, সুশীল সমাজের শাসন প্রতিষ্ঠা। দেশ জনগণের ইচ্ছায় নয়, জনগণের স্বার্থে না, চলবে বিদেশি প্রভাবশালীদের প্রেসক্রিপশনে। সুশীল শাসকরা হবেন বিদেশি প্রভুদের ‘বিশ্বস্ত ম্যানেজার’। এবার আমরা জুলাই বিপ্লবের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থানটা একটু বিশ্লেষণ করে দেখতে চাই ২০০৭ সালের ফখরুদ্দীন সরকারের কর্মকাণ্ডের আলোকে। ড. ফখরুদ্দীন আহমদের সরকার যেভাবে বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়া শুরু করেছিল, রাজনৈতিক দল মানেই খারাপ, রাজনৈতিক দল দুর্নীতিবাজ, রাজনৈতিক দলগুলো অশিক্ষিত, মূর্খ, ইত্যাদি যে বয়ান প্রচার করার সংস্কৃতি চালু হয়েছিল, সেই সংস্কৃতি আবার নতুন করে জুলাই বিপ্লবের পর শুরু হয়েছে।  

রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে চলছে নিরন্তর অপপ্রচার। এ সরকারের উপদেষ্টা মহলের অনেকে রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে নেতিবাচক এবং অপমানজনক কথাবার্তা বলছেন। বেশ কিছু উপদেষ্টার এ রকম রাজনীতিবিদ্বেষমূলক বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে এ সরকারের মধ্যে এক-এগারোর ভূত আছে। সেই একই সংস্কৃতি ফিরে এসেছে আবার। বিরাজনীতিকরণের চেষ্টা এখন প্রকাশ্য। এ সরকার যে ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ গঠন করেছে, তারা ঐক্যের জায়গা খোঁজার বদলে রাজনৈতিক বিভেদ সৃষ্টিতেই মরিয়া। তাদের কারণেই বিএনপি, এনসিপি এবং জামায়াত মুখোমুখি। তারাই নারীবাদী আর ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে সংঘাতে প্ররোচনা দিচ্ছে। পরিকল্পিতভাবে জুলাই বিপ্লবের শক্তিগুলোকে বিভক্ত এবং প্রতিপক্ষ করা হচ্ছে; যা রাজনৈতিক সংঘাতের দিকে দেশকে নিয়ে যাচ্ছে।

এক-এগারোতে যেমন মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে ব্যবসায়ী এবং দেশপ্রেমিক শিল্পোদ্যোক্তাদের হয়রানি করা হয়েছিল, এখন ঠিক একই রকম ঘটনা ঘটছে। এক-এগারোতে আমরা দেখেছি বিভিন্ন বড় বড় ব্যবসায়ী-শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মনগড়া, ভিত্তিহীন, বানোয়াট সংবাদ প্রকাশ করে কিছু সংবাদপত্র, যারা এক-এগারো কুশীলবদের এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী ছিল। প্রকৃত দুর্নীতিবাজদের আড়াল করে অর্থনীতি ধ্বংসের ষড়যন্ত্র এক-এগারোর আবিষ্কার। এখন নতুন করে তার বাস্তবায়ন চলছে। ১০টি ব্যাংক দেউলিয়া বলে প্রচার করা হচ্ছে। এসব ব্যাংক বিলুপ্ত করার আইন তৈরি করছে জনগণের ম্যান্ডেটবিহীন অন্তর্বর্তী সরকার। এর ফলে গোটা ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে।  

খেলাপি ঋণ বেড়ে নতুন রেকর্ড স্পর্শ করেছে। আইএমএফের ঋণ পেতে ‘ডলার’-এর বিনিময় হার বাজারে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে ব্যবসাবাণিজ্যে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন সংকট। অর্থনীতি ধ্বংসের মিশনে ২০০৭ সালের এক-এগারো সরকারের মতোই অন্তর্বর্তী সরকার দেশে নির্বাচন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির ব্যাপারে মনোযোগী না হয়ে ‘মানবিক করিডর’, চট্টগ্রাম বন্দর, সেন্টমার্টিন নিয়ে উৎসাহী। কাকে খুশি করার জন্য এসবে কিছু ব্যক্তির আগ্রহ তা সবাই বোঝে। এ সরকারের এখন প্রধান এজেন্ডা হওয়া উচিত একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা। কিন্তু সেখান থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। যে ১১টি বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নানা রকম হয়রানি করা হচ্ছে, যারা এখন মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার, তারাই সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন দেশে। ইতোমধ্যে লাখো শ্রমিক বেকার হয়েছেন। সামনে আরও কত বেকার হবেন কে জানে? 

এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হচ্ছে যেন ব্যবসাবাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ দেশের অর্থনীতির অর্ধেক পঙ্গু করে দিয়ে, অকার্যকর করে দিয়ে এক-এগারোর এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত সরকারের ভিতর একটি গোষ্ঠী। এক-এগারোতে যেমন সুশীল সমাজের দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার উগ্র কামনা জাগ্রত হয়েছিল; এখন সেই লোভ আবার প্রকাশ্য হয়েছে। নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের বেশির ভাগ প্রভাবশালী প্রবল অনাগ্রহী। আসল কাজ বাদ দিয়ে কার স্বার্থে মানবিক করিডর দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে? কারা দেশের সমুদ্রবন্দর বিদেশিদের কাছে ইজারা দিতে চায়? এসব দায়িত্ব কি অন্তর্বর্তী সরকারকে কেউ দিয়েছিল? না তাদের এখতিয়ারে আছে? জুলাই বিপ্লবের প্রধান আকাঙ্ক্ষা ছিল জনগণের ক্ষমতায়ন। জনগণের ক্ষমতা জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া। এ ফিরিয়ে দেওয়ার প্রধান উপায় হলো একটা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, যেটি সেনাপ্রধান শুরু থেকে বারবার বলে আসছেন। কিন্তু সেই লক্ষ্য থেকে আমরা যেন ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছি। এক-এগারোর ফাঁদে যেন আবার পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ।  

এ পরিস্থিতিতে শুধু আমরা আমাদের সামনে একটি আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। তা হলো আমাদের সশস্ত্র বাহিনী। সশস্ত্র বাহিনী এখনো জনগণের ক্ষমতা জনগণের হাতে তুলে দেওয়ার অভিপ্রায়ে কাজ করে যাচ্ছে। এখনো চরম ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে তারা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ থেকে দূরে থেকে তারা দেশের সার্বভৌমত্ব, অখ তা এবং জনগণের জানমালের নিরাপত্তা জন্য কাজ করছে নিরলসভাবে। কিন্তু সশস্ত্র বাহিনীর এ অবস্থানের পরও একটি মহল দেশ নিয়ে নতুন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। আর এ ষড়যন্ত্র থেকে আমাদের রক্ষা পেতে হলে নির্বাচন দিতেই হবে। এক-এগারোর ফাঁদে আবার যদি আমরা পড়ে যাই তাহলে আবার পিছিয়ে যাব। ২০০৭ সালে এক-এগারো বাংলাদেশকে ১০ বছর পিছিয়ে দিয়েছিল। আরেকটি এক-এগারো হলে আমাদের অর্থনীতি, রাজনীতি ভেঙে পড়বে। সেখান থেকে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ হবে অসম্ভব।

নাট্যকার ও কলাম লেখক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।