ঢাকা, শুক্রবার, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৭ মে ২০২৪, ০৮ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

কলাকোপা মাদরাসায় ওড়ে না জাতীয় পতাকা!

মো. নিজাম উদ্দিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৯ ঘণ্টা, মার্চ ৩০, ২০২২
কলাকোপা মাদরাসায় ওড়ে না জাতীয় পতাকা!

লক্ষ্মীপুর: স্বাধীনতার ৫০ বছরেও লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় না। এছাড়া পালন করা হয় না স্বাধীনতা দিবস বা বিজয় দিবস।

প্রাচীন এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির নাম জামিয়া ইসলামিয়া কলাকোপা মাদরাসা।  

৭১ সালে ওই মাদরাসায় ছিল স্থানীয় রাজাকারদের বিশাল ক্যাম্প। সে সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করতেন ওই রাজাকাররা।  

প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান মোহতামিম (প্রধান) মাওলানা মোহাম্মদ আলী। তিনি জেলার কমলনগর উপজেলার হাজিরহাট ইউনিয়নের চর জাঙ্গালিয়া গ্রামের মৃত সৈয়দ আহম্মদের ছেলে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় একজন চিহ্নিত রাজাকার ছিলেন তিনি। তখন ওই মাদরাসার ছাত্র ছিলেন মোহাম্মদ আলী। বিগত প্রায় ৪০ বছর থেকে তিনি এ মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে আছেন। গত তিন বছর ধরে তিনি মাদরাসার মোহতামিম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।  

রামগতির বেশ কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে৷ এসময় তারা মাদরাসা প্রধানের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।  

এছাড়া মাদরাসা প্রধান মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ এনে উপজেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন মো. ইলিয়াস নামে মাদরাসার নির্বাহী কমিটির একজন সদস্য।  

অভিযোগের সঙ্গে স্থানীয় ৬ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা মাদরাসা প্রধান মোহাম্মদ আলীকে রাজাকার হিসেবে চিহ্নিত করে প্রত্যয়নও দিয়েছেন।  

মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দেশ স্বাধীন হয়েছে ৫০ বছর। কিন্তু এ মাদরাসাটি মনে হয় বাংলাদেশের বাইরে। তারা এদেশের সরকারের নিয়ম-কানুন মানতে নারাজ। মাদরাসা প্রধানের কর্মকাণ্ড দেখলে মনে হয়, দেশ এখনো স্বাধীন হয়নি। বর্তমানে স্বাধীনতার স্বপক্ষের একটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায়। তারপরেও রাজাকাররা কিভাবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে- প্রশ্ন রাখেন তারা।  

রামগতির চর কলাকোপা গ্রামের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মোশতাকুর রহমান। তার গেজেট নম্বর-৯৭৯। কলাকোপা মাদরাসার সামনে মৌলভী লুৎফর রহমান সাহেবের বাড়ির বাসিন্দা তিনি। যুদ্ধ চলাকালীন তিনি নিজেই প্রত্যক্ষ করেছেন এ মাদরাসায় থাকা রাজাকারদের অত্যাচারের দৃশ্য। যুদ্ধ চলাকালীন তিনি ছিলেন উপজেলা ডেপুটি কমান্ডার। বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের ছিলেন তাদের কমান্ডার।  

তিনি বাংলানিউজের কাছে তুলে ধরেন তখনকার চিত্র।  
বলেন, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই জামিয়া মাদরাসায় ছিল রাজাকারদের বিশাল ঘাঁটি। ওই মাদরাসার ছাত্র সফিক উল্যার নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী গড়ে ওঠে। যুদ্ধ চলাকালীন তারা হিন্দু বাড়ি লুটসহ সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার করতো। তারা সবাই ছিল সশস্ত্র। রাতের বেলা তাদের বাড়ি লক্ষ্য করে গুলি চালাতো ওই রাজাকাররা। বঙ্গবন্ধুর ডাকে আমি যুদ্ধে চলে যাই। মাঝে মধ্যে রাতের বেলা লুকিয়ে বাড়িতে এলে হানাদারদের কাছে খবর চলে যেত। তাই মুহূর্তের জন্যেও বাড়ি থাকতে পারতাম না।  

তিনি বলেন, এ মাদরাসার বর্তমান প্রধান মোহাম্মদ আলী তখন এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছিলেন। সে প্রত্যক্ষভাবে নিরীহ লোকদের ওপর অত্যাচার করেছে। যুদ্ধ শেষে সেখানকার অনেক রাজাকার পালিয়ে যায়। কেউ কেউ আবার মারা পড়ে। রাজাকার মোহাম্মদ আলীও পালিয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু রাজাকারদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর মোহাম্মদ আলী এলাকায় ফিরে আসে।  

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দেশ স্বাধীন হয়েছে ৫০ বছর পার হয়েছে। রাজাকার মোহাম্মদ আলী এখনো এ মাদরাসার প্রধান। সে তার রাজাকারি মন মানসিকতা নিয়ে মাদরাসা পরিচালনা করছে। এলাকার প্রভাবশালীদের আসকারায় বীরদর্পে মাদরাসায় বিভিন্ন অনিয়ম করে যাচ্ছে সে। স্বাধীনতার পর কখনো দেখিনি এ মাদরাসাতে জাতীয় পাতাকা উড়তে। কোনো জাতীয় দিবস পালন হয় না এখানে। আমাদের এলাকা এবং মাদরাসা এখনো পরাধীন। এজন্যই কি জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছি?

তিনি আরও বলেন, আমি এ মাদরাসার লোকজনকে বার বার বলেছি পতাকার স্ট্যান্ড বানিয়ে পতাকা ওড়াতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। শুধুমাত্র জাতীয় দিবস আসলে লাঠির আগায় কোনোমতে একটি পতাকা টাঙ্গিয়ে রাখে। এটি শুধু লোক দেখানো এবং পতাকার অবমাননা। তারা মন থেকে দেশ এবং পতাকার প্রতি সম্মান জানিয়ে সঠিক নিয়মে পতাকা উত্তোলন করে না। যা আমাদের ব্যথিত করে।  

তিনি বলেন, মাদরাসা পরিচালনা কমিটিতে যারাই থাকে তারা অবৈধ সুবিধা নিয়ে প্রধানের কথামতো চলে। তাই এখন শুধু দেখেই যাচ্ছি। স্থানীয় একজন ব্যক্তি রাজাকার মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে। আমরাও সেটাকে সমর্থন দিয়ে প্রত্যয়ন দিয়েছি।  

একইভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন উপজেলার চরসীতা এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবুল কালাম। তার গেজেট নম্বর-১১৯৪। তিনিও মোহাম্মদ আলীকে একজন নামকরা রাজাকার হিসেবে শনাক্ত করে লিখিত প্রত্যয়ন দিয়েছেন।  

বাংলানিউজকে বলেন, যুদ্ধ শেষ হবার পর মোহাম্মদ আলী প্রথমে পালিয়ে যান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজাকারদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করায় তিনি বেঁচে যান। পরে বেশ কয়েক বছর এলাকা ছাড়া ছিলেন। বর্তমানে তিনি জামিয়া ইসলামিয়া কলাকোপা মাদরাসার প্রধান। সেখানে এখন তিনি বিতর্কিত কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন।  

উপজেলার পশ্চিম চর কলাকোপা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা ফয়েজ আহম্মদ (গেজেট নম্বর- ১০৫৪) বাংলানিউজকে বলেন, খুব কষ্ট হয়, যখন স্বাধীন দেশে একজন রাজাকার তার পূর্বের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যায়। আর আমাদের অসহায় হয়ে সেগুলো দেখতে হয়। একজন বড় মাপের রাজাকার মাদরাসার প্রধান৷ তিনি তার ইচ্ছে মতো মাদরাসা চালাচ্ছেন। এ দেশের সরকারের আইন অচল এ মাদরাসায়। এখানে কখনো জাতীয় পতাকা ওড়েনি। বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবস পালন হয় না। কিন্তু আমরা মুক্তিযোদ্ধারা এ পতাকা এবং স্বাধীনতার জন্য জীবন বাজি রেখেছি।  

স্থানীয়রা জানায়, গত শনিবার ২৬ মার্চের দিন জাতীয় এবং স্বাধীনতা দিবসে উপলক্ষে মাদরাসায় কোনো আয়োজন করা হয়নি। তবে অন্যান্য দিন জাতীয় পতাকা না ওড়ালেও এদিন সঠিক নিয়ম না মেনেই পতাকা কোনোমতে টাঙ্গানো হয়েছিলো। এখানে বাংলাদেশের কোনো নিয়ম-কানুন মানা হয় না। ৭১ এর অপশক্তি পুরো প্রতিষ্ঠানকে জিম্মি করে রেখেছে। প্রতিষ্ঠানের সভাপতি আবদুল্যা আল ইস্রাফিল ও মাদরাসা মোহতামিম মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে উপজেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।  

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মাদরাসার মোহতামিম মোহাম্মদ আলী বাংলানিউজকে বলেন, গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বাদ জোহর দোয়ার আয়োজন করা হয়েছে। জাতীয় পতাকাও উত্তোলন করা হয়।  

৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার কর্মকাণ্ডের বিষয়ে তিনি বলেন, তখন আমি এ মাদরাসার ছাত্র ছিলাম। সেসময় আমার দ্বারা কারো কোনো ক্ষতি হয়নি। আমি রাজাকার ছিলাম না।  

বিষয়টি নিয়ে রামগতি উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ওয়াহিদুর রহমান মুরাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, বিষয়টি আমি শুনেছি। আমি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা এবং দলীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে খোঁজ নেব। এছাড়া প্রশাসনকেও এ ব্যাপারে অবগত করবো।  

এ ব্যাপারে রামগতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম শান্তুনু চৌধুরী বলেন, মাদরাসার সভাপতির বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ ছিল, সেটা নিয়ে একটি বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠকে মাদরাসা প্রধানের বিষয়গুলো উঠে এসেছে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, জনপ্রতিনিধি এবং রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৩ ঘণ্টা, মার্চ ৩০, ২০২২
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।